Inqilab Logo

বুধবার, ২৬ জুন ২০২৪, ১২ আষাঢ় ১৪৩১, ১৯ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

আমরা মর্মাহত, আমরা শোকাহত

| প্রকাশের সময় : ১৪ মার্চ, ২০১৮, ১২:০০ এএম

‘এ-কোন মৃত্যু ? কেউ কি দেখেছে মৃত্যু এমন, শিয়রে যাহার ওঠেনা কান্না, ঝরেনা অশ্রু ? হিমালয় থেকে সাগর অবধি সহসা বরং সকল বেদনা হয়ে ওঠে এক পতাকার রং’। কবি আলাউদ্দিন আল আজাদের লেখা এই কাব্যাংশের দৃশ্যকল্পের সাথে মিলে যায় এই মৃত্যুর শোক।
কাঠমান্ডুর ত্রিভ‚বন আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে বাংলাদেশের বেসরকারী এয়ারলাইন্স ইউএস-বাংলার বিএস ২১১ ফ্লাইটের দুর্ঘটনাকবলিত যাত্রীদের জন্য শোকে মুহ্যমান পুরো জাতি। গতকাল দুপুর সাড়ে বারোটায় ঢাকা হযরত শাহজালাল আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দর থেকে ছেড়ে যাওয়ার দু ঘন্টা পর কাঠমান্ডুর ত্রিভ‚বন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের সময় রানওয়েতে বিধ্বস্ত হয়। ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের ড্যাশ এইট কিউ ৪০২ বিমানটিতে ৬৭ যাত্রী ও ৪ জনক্রুসহ মোট ৭১জন ছিল। বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে নেপালী সেনাবাহিনীর এক মুখপাত্রের দেয়া তথ্য অনুসারে এঁদের মধ্যে ৫০ জন নিহত হয়েছেন। যাত্রীদের মধ্যে ৩৬ জন বাংলাদেশী, ৩২ নেপালী, একজন চীনা ও একজন মালদ্বীপের নাগরিক ছিলেন বলে জানা যায়। নিহতদের বেশীরভাগ বাংলাদেশী নাগরিক। ভাগ্যবান কেউ কেউ সামান্য আহত হয়ে বেঁচে গেলেও দুর্ঘটনাকবলিত বিমানের বেশ কয়েকজন যাত্রী এখনো কাঠমান্ডুর কয়েকটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। গুরুতর আহতদের কয়েকজনের অবস্থা আশংকাজনক বলে জানা গেছে। আমরা নিহত বিমানযাত্রীদের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি এবং আহত যাত্রীদের দ্রুত সুস্থ্যতা কামনা করছি। এই দুর্ঘটনা দেশের ১৬ কোটি মানুষের হৃদয়ে গভীর ক্ষতের জন্ম দিয়েছে। বিদেশের মাটিতে দেশের প্রতিনিধিত্বকারী এয়ারলাইনসের এমন মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় অর্ধশত মানুষের এই করুণ মৃত্যুর কোন ক্ষতিপুরণ হয়না। দিনে দুপুরে মেঘমুক্ত আকাশে বিমানবন্দরে অবতরনের পর বিমানটির দুর্ঘটনার পেছনে কি কারণ নিহিত ছিল তা এখনো রহস্যাবৃত। তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়ায় ইউএস বাংলার পক্ষ থেকে ত্রিভ‚বণ বিমানবন্দরের কন্ট্রোলরুম থেকে ভুল বার্তা এবং পাইলটের অনুরোধে সাড়া না দেয়াকে দায়ী করা হয়েছে। অন্যদিকে নেপালের সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ এই দুর্ঘটনার জন্য পাইলটের ভুল সিদ্ধান্তকেই দায়ী করেছেন। এটা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, একটি মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক বিমান দুর্ঘটনার জন্য সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো পরস্পরের উপর দোষারোপ করে দায় এড়াতে চাইছে। এ ক্ষেত্রে ত্রিভুবন বিমান বন্দরের মহাব্যবস্থাপক রাজকুমার ছেত্রি এবং ইউএস বাংলা এয়ারলাইনসের প্রধান নির্বাহী(সিইও) ইমরান আসিফ দুজনই নিজ নিজ দাবীর সপক্ষে কন্ট্রোলরুমের সাথে পাইলটের কথপোকথনের রেকর্ড তুলে ধরেছেন। ইউএস-বাংলার তরফে ত্রিভ‚বন বিমানবন্দরের কন্ট্রোলরুম থেকে বার বার রানওয়ে পরিবর্তনের নির্দেশনায় পাইলটের বিভ্রান্ত হওয়ার যে দাবী তোলা হয়েছে, তা অগ্রাহ্য করার কোন সুযোগ নেই। তবে ইতিমধ্যেই দুর্ঘটনার কারণ উদঘাটনে একাধিক তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। এসব তদন্তে দুর্ঘটনার প্রকৃত রহস্য বের হয়ে আসবে বলে আমরা আশা করি। নিরপেক্ষ ও কার্যকর তদন্তের স্বার্থে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের কমিটিতে অর্ন্তভুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায়না। সঠিক তদন্ত এবং সুপারিশমালার আলোকে ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা হয়তো সম্ভব হবে। এই মুহূর্তে নিহতদের শনাক্ত করে পরিবারের কাছে পৌছে দেয়া, আহতদের প্রয়োজনীয় সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা এবং পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়ানো সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থার অন্যতম নৈতিক দায়িত্ব।
অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের প্রায় এককোটি মানুষের বৈদেশিক কর্মসংস্থানের পাশাপাশি নানাখাতে বেসরকারী বিনিয়োগই হচ্ছে এই উন্নয়ন-অগ্রগতির মূল শক্তি। বিদেশে অবস্থানরত লাখ লাখ বাংলাদেশী নাগরিকের সহজে দেশে যাতায়াত নিশ্চিত করতে জাতীয় বিমান সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি বেসরকারী বিমান সংস্থা গড়ে উঠেছে। বিমানের নানা দুর্বলতা, অস্বচ্ছতা ও ব্যর্থতার কারণেই আভ্যন্তরীন ও আঞ্চলিক রুটে বেসরকারী এয়ারলাইন্সগুলোর মধ্যে প্রথম সারির কয়েকটি জনপ্রিয়তা, আস্থা ও ব্যবসায়িক সাফল্য লাভ করে। ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স তাদের অন্যতম। মাত্র দুটি উড়োজাহাজ নিয়ে ২০১৪ সালে ইউএস বাংলার বাণিজ্যিক যাত্রা শুরু হলেও মাত্র চার বছরের মধ্যে বহরে মোট ৮টি উড়োজাহাজ সংযুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়েই তার প্রতি যাত্রিদের আস্থা ও বাণিজ্যিক সাফল্যের প্রমান পাওয়া যায়। দেশের অভ্যন্তরে বেশ কয়েকটি নিয়মিত ফ্লাইট পরিচালনার পাশাপাশি ইউএস-বাংলা নেপাল, ভারত, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ওমান, থাইল্যান্ড ও কাতারে ফ্লাইট পরিচালনা করে আসছে। দেশের বৃহত্তম এবং একমাত্র সরকারী এভিয়েশন সংস্থা বিমান যেখানে বিশাল সম্পদ নিয়েও ফ্লাইট সংকুচিত করে চলেছে, সেখানে ইউএস-বাংলা দ্রæতই তাদের ফ্লাইট বৃদ্ধি করে চলেছে। আগামী মাসে চীনের গুয়াংজুতে তাদের ফ্লাইট শুরু করার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানা যায়। নেপালের ত্রিভূবন বিমানবন্দরে গত সোমবারের দুর্ঘটনা শুধু ইউএস-বাংলার অগ্রযাত্রার উপরই নেতিবাচক প্রভাব ফেলবেনা, সেই সাথে বাংলাদেশের সরকারী-বেসরকারী এভিয়েশন ব্যবসাও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এর ফলে দেশের বিমান সংস্থাগুলোর প্রতি যেন যাত্রিদের আস্থার সংকট দেখা না দেয় সে জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ও কর্মকৌশল গ্রহন করা প্রয়োজন। উল্লেখ করা দরকার, দুর্ঘটনা ও নিরাপত্তাহীনতার জন্য নেপালের ত্রিভ‚বন বিমানবন্দরের কুখ্যাতি রয়েছে। বিবিসি থেকে প্রচারিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, পাহাড় ঘেরা এই বিমান বন্দর থেকে ১৯৭২ সালে ফ্লাইট পরিচালনা শুরুর পর এ পর্যন্ত ৭০টির বেশী বিমান দুর্ঘটনায় পতিত হয়েছে। এসব দুর্ঘটনায় সাড়ে ৬শতাধিক মানুষ নিহত ও বহু আহত হয়েছে। এ কারণেই নেপালের ত্রিভূবন বিমানবন্দর বিশ্বের অন্যতম দুর্ঘটনাপ্রবণ বিমান বন্দর হিসেবে আলোচিত হয়। তবে এই বিমানবন্দরের দুর্ঘটনা প্রবণতা ও বৈশিষ্ট্য মাথায় রেখেই এখানে আন্তর্জাতিক ফ্লাইটগুলো পরিচালিত হয়ে আসছে। বিমান বন্দরের ভ‚-প্রাকৃতিক অবস্থান বিবেচনায় পাইলটদের বাড়তি সর্তকতা অবলম্বনের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায়না। তবে কন্ট্রোলরুম থেকে ভুল তথ্য ও অনাকাঙ্খিত নির্দেশনা, বা পাইলটের ভুলের কারণে এ ধরনের দুর্ঘটনা হয়ে থাকলে তা দু:খজনক। আমরা এ ধরনের ভুলত্রæটি এবং মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে চাইনা।
দেশের সিভিল এভিয়েশনের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত এটি সবচে বড় ও মর্মান্তিক দুর্ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করা যায়। ইতিপূর্বে ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ বিমানের একটি আভ্যন্তরীণ ফ্লাইট ঢাকা বিমান বন্দরে বিধ্বস্ত হয়ে ৪৯জন যাত্রী নিহত হয়েছিল। এরপর বিমান আর কোন বড় ধরনের দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়নি। এমনকি দেশের বেসরকারী বিমান সংস্থাগুলোও নিরাপদে ও সাফল্যের সাথে ফ্লাইট পরিচালনা করে আসছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রাইভেট এভিয়েশনের সাথে যুক্ত হয়েছে বেসরকারী হেলিকপ্টার সার্ভিস। বাণিজ্যিক ও সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে এসব সার্ভিস দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন এনে দিয়েছে। নেপালে ইউএস-বাংলার বিমান দুর্ঘটনা সব এভিয়েশন সার্ভিসের জন্যও একটি সতর্ক বার্তা। দুর্ঘটনাকবলিত উড়োজাহাজটিতে ইতিপূর্বেও যান্ত্রিক ত্রæটি দেখা দিয়েছিল বলে বলে জানা যায়। তবে বেসামরিক এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ ড্যাশ-৮ -৪০২ বিমানটির ফিটনেস ছিল বলে দাবী করেছে। বিমানের ফিটনেস, পাইলটের ভুলত্রæটি এবং কাঠমান্ডু বিমানবন্দরের কন্ট্রোলরুমের ভুল পদক্ষেপ ও নির্দেশনা ইত্যাদি বিষয়কে ঘিরেই হয়তো দুর্ঘটনার তদন্ত কার্যক্রম আবর্তিত হবে। কারণ যাই হোক, এই দুর্ঘটনার ফলে যেন দেশের বেসরকারী ও বাণিজ্যিক এভিয়েশন সার্ভিসের বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। সরকারী-বেসরকারী সব এয়ারলাইন্স ও এভিয়েশন সার্ভিস থেকে পুরনো, যান্ত্রিক ত্রæটিপূর্ণ এয়ারক্রাফ্টগুলোকে বাদ দিতে হবে। যাত্রী নিরাপত্তার বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে ফ্লাইট পরিচালনায় সর্বোচ্চ দক্ষতা ও সর্তকর্তা থাকতে হবে। বেশী নিরাপত্তা, বেশী সুযোগ সুবিধা ও নিয়মানুবর্তিতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের এভিয়েশন সার্ভিস তার নিরাপত্তা, অগ্রযাত্রা ও সুনাম ধরে রাখার প্রয়াস বাড়াবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। একটি দুর্ঘটনার কারণে যে সব সম্ভাবনাময় জীবনের মর্মান্তিক পরিনতি ঘটল। পার্থিব কোন কিছুর বিনিময়ে সে সব জীবনের মূল্য পরিশোধ করা সম্ভব নয়। নিহত নেপালীদের মধ্যে সিলেটে রাগিব রাবেয়া মেডিকেল কলেজের ১৩ জন শিক্ষার্থী ছিল। বিমানটির একাধিক পাইলট, ক্রু এবং বেশ কয়েকটি পরিবারের সদস্যদের সাথে শিশুরাও দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে। প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রীসহ দেশি-বিদেশি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা গভীর সমবেদনা প্রকাশ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী তার সিঙ্গাপুর সফল সংক্ষিপ্ত করে দেশে ফিরে এসেছেন। নেপালে উদ্ধার অভিযানসহ তাৎক্ষণিক সহায়তা পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। সরকারের পাশাপাশি ইউএস-বাংলাও হতাহত পরিবারগুলোর পাশে দাড়ানোর ঘোষনা দিয়েছে। তবে সবচে বড় কথা হচ্ছে, দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করা এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ এবং নিহত ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি পরিবারগুলোর ক্ষতিপুরণের ব্যবস্থা করা। পরিশেষে নিহতদের জন্য পারলৌকিক শান্তি কামনা করি এবং শোক কে শক্তিতে পরিনত করে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো ঘুরে দাঁড়াবে এমনটাই আশা করি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: শোকাহত
আরও পড়ুন