পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
হযরত দানিয়াল (আ) এক অসীম সাহসী নবীর নাম। কোরআন শরীফে তাঁর নাম উল্লেখ না থাকলেও একজন সাহাবী বলেছেন যে, হযরত দানিয়াল (আ) এর নাম উল্লেখ করে দোয়া করলে বাঘ ভীতি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। দোয়াটি এই; ‘আউজুবিদ্দানিয়ালি ওয়া বিলজুব্বি মিন শাররিল আসাদ’। অর্থাৎ ‘আমি দানিয়ালের অসিলায় এবং গর্তে বাঘের ক্ষতি সাধন হতে আশ্রয় প্রার্থনা করছি’।
রিজাল শাস্ত্রের পরিভাষায় সাহাবীর এরূপ বক্তব্যকে আছর বলা হয়, যা হাদীসেরই এক শ্রেণী বিশেষ। এই বর্ণনার সূত্র ‘ঈমাম ইবনুস সুন্নী’। তিনি বর্ণনা করেন যে, হযরত আলী (রা) হযরত ইবনে আব্বাস (রা)-কে বললেন; ‘তুমি যখন এমন উপত্যকায় থাকবে যেখানে তুমি বাঘ ভীতির সম্মুখীন। সেখানে তুমি বর্ণিত দোয়া পাঠ করবে।’ হযরত দানিয়াল (আ) তওরাতপন্থী নবী ছিলেন। সুতরাং তাঁর অসিলায় দোয়া করার বিষয়টি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এ পর্যায়ে প্রথমে কয়েকটি প্রশ্নের মীমাংসা করা প্রয়োজন। যেমন: দানিয়াল (আ) কোন যুগের নবী ছিলেন, কোন বাদশাহ্র শাসন আমলে তার আবির্ভাব ঘটেছিল এবং কেন তাকে বাঘের খাঁচায় বন্দি করার মতো পরিস্থিতি উদ্ভব হয়েছিল?
আম্বিয়া চরিত কাহিনীগুলোর মধ্যে হযরত দানিয়াল (আ) এর উল্লেখ খুব বেশি পাওয়া যায় না। যারা উল্লেখ করেছেন তাদের বর্ণনাও পরস্পরবিরোধী। কেউ কেউ সংক্ষেপে বলেছেন যে, হযরত দানিয়াল (আ) হয়রত হুদ (আ) ও হযরত ছালেহ্ (আ) এর মধ্যবর্তী সময়ের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন। তিনি আদ জাতির লোক ছিলেন। তিনি দাজলা ও ফোরাত নদী খনন করেছিলেন। তাঁর নাক এক গজ দীর্ঘ ছিল।
‘মাজালিসুল মোমেনীন’-এর এ বর্ণনা। অন্যান্য সূত্রগুলো পরস্পরবিরোধী। সৃষ্টি সন অনুযায়ী লিখিত ইতিহাস গণনায় দেখা যায় যে, হযরত হুদ (আ) এর জন্ম ১৭২৩ এবং ওফাত ২১৮৭ সৃষ্টি সন। তিনি ৪৬৪ বছর জীবিত ছিলেন। হযরত ছালেহ্ (আ) এর জন্ম ১৭৫৭ এবং ওফাত ২০৭৭ সৃষ্টি সন। এ দু’জন নবীর মধ্যবর্তী সময়কে যদি হযরত দানিয়াল (আ) এর যুগ গণ্য করা হয় তাহলে তিনি হযরত নূহ (আ) এরও পূর্বের নবী।
‘তাজকেরাতুল আম্বিয়া’ নামক পুস্তকে হযরত দানিয়াল (আ) এর নবুওয়াত বর্ষ ৩৩৯৮ এবং ওফাত ৩৪৭০ সৃষ্টি সন লেখা হয়েছে। অর্থাৎ এটি খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর কথা। অধিকাংশ নবী কাহিনীতে এটাকেই যুক্তিযুক্ত বলা হয়েছে। তাঁর জন্ম সন বা জীবনের বিশদ বিবরণ জানা না গেলেও তওহীদ প্রচার করতে গিয়ে তাকে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছিল এবং এক পর্যায়ে সে যুগের বাদশার রোষানলে পড়তে হয়েছিল। বাদশা তাকে বাঘের খাঁচায় আবদ্ধ করলে বাঘও তার প্রতি সদয় হয় এবং আল্লাহর পক্ষ হতে ফেরেশতা তাকে খাদ্য পৌঁছান। এ অলৌকিক ঘটনা দেখে বাদশা তাকে বাঘের খাঁচা হতে মুক্ত করে দেন।
এ ঘটনার পূর্বাপর অনেক কথা বিভিন্ন পুস্তকে বর্ণিত হয়েছে। তবে হযরত দানিয়াল (আ) ছিলেন জালেম-অত্যাচারী বাদশা ‘বখতে নছর’ এর যুগের। বখতে নছরের কাহিনীও অদ্ভুত বিস্ময়কর। বর্ণিত হয়েছে যে, বখতে নছরের দৈহিক বিকৃতি বা বিবর্তন নজিরবিহীন। প্রথমে তার বিকৃতি ঘটে সিংহের আকারে। তাই হিং- জন্তুদের রাজা হয়। দ্বিতীয়বার সে শকুনের রূপ ধারণ করে। তাই সে বিহঙ্গ (পাখি) কূলের রাজা হয়। অতঃপর সে বলদ বা ষাঁড় এ রূপান্তরিত হয়। এজন্য তাকে গবাদী পশুর রাজা বলা হয়। এভাবে বখতে নছর মানুষের রূপ হতে লাগাতার সাত বার নানা রূপে রূপান্তরিত হতে থাকে। কিন্তু তার সকল দেহরূপে মানুষের অন্তর রূপ অক্ষু্ণ্ণ ছিল। একারণে সে সকল আকারে মানবীয় জ্ঞানবুদ্ধি অনুযায়ী কাজ সম্পাদন করতে থাকে এবং তখন পর্যন্ত তার রাষ্ট্র কায়েম ছিল। অতঃপর আল্লাহ তা’আলা তাকে মানবীয় দেহ কাঠামোতে পরিবর্তন করেন এবং তার আত্মাও ফিরিয়ে দেন। এরপর বখতে নছর লোকদেরকে তওহীদে এলাহীর আহবান জানায়। তখন সে এই কথাও প্রচার করতে থাকে আল্লাহ ব্যতীত সকল মা’বুদ বাতিল।
বখতে নছরের ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে মতবিরোধ রয়েছে। কারো কারো মতে, মৃত্যুর পূর্বে সে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। অর্থাৎ ঈমান এনেছিল। অন্যান্যদের মতে, বখতে নছর বহু নবী হত্যাকারী, ‘বায়তুল মুকাদ্দাছ’ (মস্জিদ এ আকসা) ধ্বংসকারী এবং সেখানে বিদ্যমান পবিত্র গ্রন্থাবলীতে অগ্নি সংযোগকারী। আল্লাহ’র গজব তার উপর নাযিল হয়। তার তওবাও কবুল হয়নি। বখতে নছর সম্পর্কে আরও বর্ণিত আছে যে, আল্লাহ তা’আলা তাকে দ্বিতীয়বার আসল সুরত ফিরিয়ে দেন। তখন সে তার রাজত্ব ফিরে পায়। সেসময় হযরত দানিয়াল (আ) ও তার সঙ্গীগণ বখতে নছরের সবচেয়ে ঘনিষ্টজন ও সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন। এজন্য ইহুদার তার প্রতি হিংসা হয়। সে বখতে নছরকে হযরত দানিয়াল (আ) এর বিরুদ্ধে প্ররোচিত করে এবং তার কুৎসা বর্ণনা করে এবং বলে যে, দানিয়াল যখন পানি পান করেন তখন প্র¯্রাব নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। বখতে নছরের কাছে এ অভ্যাসটি ছিল খুবই লজ্জাকর। তাই সে এ বিষয়ের বাস্তবতা পরীক্ষা করার জন্য একটি উপায় বের করে এবং সে অনুযায়ী এক বিরাট আয়োজন করে। সে সকলকে সমবেত হওয়ার জন্য দাওয়াত করে। সে তার দারোয়ানকে বলে দেয় যে, ‘তুমি দেখতে থাকো খাবার গ্রহণের পর কে সর্বপ্রথম প্রস্তাব করতে বের হয়। যে বের হয় তাকে কুড়াল দ্বারা হত্যা করবে। আর যদি সে নিজেকে বখতে নছর বলে দাবিও করে তাহলে তার কথাও শুনবে না এবং তাকে বলবে যে তোমাকে হত্যা করার জন্যই বখতে নছর আমাকে নির্দেশ দিয়েছে।’ ঘটনাচক্রে অনুষ্ঠান শেষে বখতে নছরই প্রস্তাব করার জন্য সর্ব প্রথম বের হয় এবং প্রস্তাব নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয় এবং দারোয়ান দেখা মাত্র তাকে হযরত দানিয়াল (আ) মনে করে অন্ধকারে তার উপর হামলা চালায়।
(চলবে)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।