শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
মাওলানা জালাল উদ্দীন রূমী রহ.
কাব্যানুবাদ : রূহুল আমীন খান
তোতা ও মুদীর গল্প
এক মুদী দোকানদারের ছিল একটি পোষা তোতা। তোতাটি মানুষের মত কথা বলত, সুমিষ্টস্বরে গান গাইত, আবার দোকানীকে বেচা কেনার কাজে সাহায্যও করত। মানুষ আসত তোতার মধুকণ্ঠের সুমিষ্ট গান শুনতে। এতে দোকানের কেনা-বেচাও হত জমজমাট। একদা দোকানী তোতাকে দোকান পাহারায় রেখে, ঘর বন্ধ করে চলে গেল নিজ বাড়িতে। ইত্যাবসরে এক বিড়াল সেখানে ঢুকে আক্রমণ করল তোতার উপরে। প্রাণভয়ে তোতা এদিক থেকে সেদিক পালাতে লাগল। তার পাখার ঝাপটায় তেলের বোতল উল্টে পড়ল। তেল ঢেলে পড়ল দোকানদারের গদিতে, দোকানের মেঝে। দোকানদার ফিরে এসে তেলে একাকার এ অবস্থা দেখে মনে করল এ সব তোতারই অপকাÐ। রাগে বেসামাল হয়ে সে তোতার মাথায় মারল এক থাপ্পর। তাতে উপরে গেল তোতার মাথার সব পালক-পশম। একেবারে টাক্কু হয়ে গেল সে। থাপ্পর খেয়ে এবং টাক্কু মাথা হয়ে বিমর্ষ তোতা কথা বলা, গান গাওয়া একদম বন্ধ করে দিল। বহু সাধ্য-সাধনা করেও দোকানী আর ফিরিয়ে আনতে পারল না তোতার মুখে কথা ও সংগীত। নিরাশ হল সে।
কিছুদিন পরের কথা : ঐ দোকানের সমুখ দিয়ে যাচ্ছিলেন আলখেল্লা পরা এক দরবেশ। তাঁর মাথা ভরা ছিল মস্ত টাক। টাক্কু মাথা দেখে অমনি তোতা সরব হয়ে উঠল। দরবেশকে লক্ষ করে বলল, ওহে ! তুমিও কি আমার মত তোমার মালিকের তেল ঢেলে দিয়েছিলে? সে অপরাধে তোমাকে মেরে কি এরূপ টাক্কু বানিয়ে দিয়েছে? উপস্থিত সবাই তোতার মুখে এ কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠল।
একটি বাঙলা প্রবাদ আছেÑ ‘যে জন যেমনি জগৎ বোঝে তেমনি’। গল্পটির মাধ্যমে মাওলানা রূমী সে রূপই ইঙ্গিত করেছেন যে, সাধারণ মানুষ কামিল লোকদের কাজ কর্ম দেখে মনে করে তাদের ক্রিয়া-কর্ম তো আমাদেরই মত। মূলতঃ তা নয় , বাহ্যতঃ এক দেখা গেলেও উভয়ের মাঝে দুস্তর ব্যবধান বিদ্যমান।
মসনবী :
৫০৩. এখন আমি বলব তোমায় গল্প সে এক চমৎকার
হয়ত তাতে খুলবে কিছু গুপ্ত ভেদের রুদ্ধদ্বার।
৫০৪. এক যে ছিল পশারী আর তোতা ছিল একটি তার
রংটি সবুজ, কণ্ঠ মধুর, বলত কথা চমৎকার।
৫০৫. পশারী তার দোকানটাতে রাখত তোতায় সর্বক্ষণ
মিষ্টি কথায়, সঙ্গীতে সে করত সবায় আকর্ষণ।
৫০৬. মুগ্ধ হতো শ্রোতারা তার মিষ্টি কথার ভঙ্গিতে
জুড়িয়ে যেত পরান সবার তাহার কলসঙ্গীতে।
৫০৭. একদা সে মুদী গেল নিজ বাড়িতে, দোকান তার
দিয়ে গেল তোতার পরে দেখা শোনা করার ভার।
৫০৮. ওদিকে এক বিড়াল হঠাৎ ইঁদুর ধরার ধান্ধাতে
লম্ফ দিল, আতঙ্কিত হলো তোতা খুব তাতে।
৫০৯. প্রাণ-ভয়ে সে উড়াল দিয়ে এদিক সেদিক দ্রæত ধায়
পড়ল ঢেলে বাদাম তেলের বোতল তাহার পাখার ঘায়।
৫১০. কার্য শেষে বাড়ি থেকে আসল ফিরে দোকানদার
যথারীতি কায়দা করে নিজ আসনে বসল তার।
৫১১. কিন্তু একী! গোটা ঘরেই সপসপে তেল, তৈলে তার
ভিজে গেল জামা-কাপড়, কান্ডটা কী হায় তোতার!
৫১২. ক্রুদ্ধ হয়ে মারল থাপর লক্ষ করে তোতার শির
উপড়ে গেল পালক মাথার টাক্কু মাথা হয় পাখির।
৫১৩. থাপর খেয়ে সাধের তোতার বন্ধ হলো মুখের ভাষ
দুঃখীত মন মুদী ভাবে কী বাধালাম সর্বনাশ !
৫১৪. ক্ষোভে খেদে দাড়ি ছিড়ে, বলছে কেবল হায় কপাল!
নিজ দোষে মোর ভাগ্য রবি পালাল মেঘ-অন্তরাল।
৫১৫. হায়রে আমার সেই সময়ে থাকত যদি ভাঙ্গা হাত
হানতে তবে পারত কি সে তোতার শিরে এই আঘাত।
৫১৬. মানত করে, করে মুদী দীন দুঃখীদের সদকা দান
যেন আসে ফিরে আবার কণ্ঠে তোতার মিষ্টিগান।
৫১৭. সামনে তোতার ভেল্কি দেখায়, দেখায় খেলা পাল্টে ভোল
যাতে তোতার কণ্ঠ থেকে বেরোয় আবার মিষ্টি বোল।
৫১৮. পেরেশানি হয়রানিতে ভারি হলো দিনগুজার
হা-হুতাসের মধ্যে মুদী তিনটি দিবস করল পাড়।
৫১৯. এই সময়ে দেখল তোতা, যাচ্ছে চলে এক ফকীর
বসন ভ‚ষণ ছিন্ন তাহার, তার মতোই টাক্কু শির।
৫২০. হঠাৎ তোতা কণ্ঠ ছেড়ে ডাক দিয়ে কয় তার উদ্দেশ
বলো বলো, বলো দেখি খবর তোমার কী দরবেশ ?
৫২১. তুমিও কি আমার মতো ঢেলে ছিলে বাদাম তেল
সেই হেতু কি আমার মতো নেড়ে মাথা টাক্কু বেল ?
৫২২. এ রূপ কথা শুনে তোতার উঠল হেসে সর্বজন
বলল দেখ! দরবেশে ওই ভাবছে তোতা নিজ-মতন।
৫২৩. পুন্যবানের কাজকে তুমি ভেবোনা নিজ কাজের ন্যায়
যদিওবা লেখার মাঝে ‘শের’ ও ‘শী-র’ এক দেখায়।
৫২৪. পরম উপাদেয় খাবার ‘শী-র’ তো হলো মানবদের
বক্ষ ফেরে হত্যা করে মানব কে খায় হিং¯্র ‘শের’।
৫২৫. ভাবখানা এই গোমরা লোকের তারাই যেন খোদ নবী
তারা এবং পুণ্যশ্লোক কামিল ওলী এক সবি !
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।