শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
মানুষ যুুগে যুগে যেসব শিল্পের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছে, তন্মধ্যে অন্যতম হলো স্থাপত্য শিল্প। কারণ মানুষের এ পৃথিবীতে আগমনের পর হতেই শীতকালে ঠান্ডা হতে, গ্রীষ্মকালে গরম হতে, বর্ষাকালে বৃষ্টি হতে এবং রাতের অন্ধকারে পশু-প্রাণীর আক্রমণ হতে নিজেদেরকে বাঁচাবার জন্য এ শিল্পের প্রয়োজন হয়েছে। তা ছাড়া বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা বা অন্য কোন প্রয়োজনে এক স্থানে একত্রিত হবার জন্যও তাদের এই স্থাপত্য শিল্পের প্রয়োজন হয়েছে।
ইসলাম মুসলিমদেরকে শিখিয়েছে যে, মানুষ চাইলে তার সমস্ত কর্মকান্ডের মধ্য দিয়েই তার প্রতিপালকের নিকটবর্তী হতে পারে, তার সন্তুষ্টি পেতে পারে, যদি তা দীনের শিক্ষা ও বিধান অনুযায়ী আদায় করা হয়। সুতরাং আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য এবং তার সন্তুষ্টি পাওয়ার জন্য বৈরাগ্য সাধনের প্রয়োজন নেই। দুনিয়াদারী ছেড়ে দিয়ে ইবাদত-বন্দেগীতে ব্যস্ত হয়ে পড়ার এবং দেহকে নানাভাবে কষ্ট দেয়ারও কোন প্রয়োজন নেই। আল্লাহকে পাওয়ার জন্য আল্লাহ কর্তৃক মানুষের জন্য প্রদত্ত কোন নিয়ামতকেও হারাম করার কোন প্রয়োজন নেই। অন্যদিকে আমরা হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মের ধর্মীয় দর্শনে দেখতে পাই যে, স্রষ্টার সন্তুষ্টি ও সান্নিধ্য লাভ করতে হলে বৈরাগ্য সাধনা করতে হবে। দুনিয়ার ভোগ বিলাস ত্যাগ করে পাহাড় পর্বতে চলে যেতে হবে। সেখানে রাত দিন স্রষ্টার উপাসনায় ব্যস্ত থাকতে হবে। দুনিয়ার সমস্ত ভোগ বিলাস ছেড়ে দিয়ে; মানবদেহকে নানাভাবে কষ্ট দিয়ে স্রষ্টার ধ্যান উপাসনায় মগ্ন থাকলেই তবে পাওয়া যাবে স্রষ্টার সন্তুষ্টি। তাই এসব ধর্মে অনুসারীদেরকে দুনিয়ার সমস্ত ভোগ বিলাস ত্যাগ করে মানবদেহকে নানাভাবে কষ্ট দিয়ে পাহাড়ে-পর্বতে উপাসনায় ব্যস্ত হতে দেখা যায়।
উপর্যুক্ত এই দর্শনের প্রভাব আমরা দেখতে পাই বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর স্থাপত্য শিল্পেও। বিশেষত তাদের ইবাদত বন্দেগী ও ধর্মের জন্য নির্মিত বাড়ি-ঘরে। তাই আমরা মুসলিমদের মসজিদগুলো দেখতে পাই যে, তা নির্মিত হয় ভিতর-বাইরে অতি সহজভাবে এবং সাদাসিধে করে, তাদের ধর্মের শিক্ষা ও ধর্মীয় দর্শনের আলোকে। তার অভ্যন্তর ভাগে থাকে না তেমন কোন কারুকার্য, যাতে ভিতরে সালাতরত মুসলিমদের মন সে দিকে মগ্ন হয়ে না পড়ে। আর তার বাহির ভাগ নির্মিত হয় ইসলামী দর্শনের আলোকে প্রায় মিনারা বা আযানখানা সহকারে। আর তাও নির্মিত হয় জনগণের সমাবেশ স্থলে, সড়কের পাশে, বাজারে, চৌরাস্তার মোড়ে এবং এমন সব স্থানে যেখানে সহজেই পৌঁছা যায়। আর তাতে রাখা হয় সামনের বা কিবলার দিক ছাড়া বাকি তিন দিকে পর্যাপ্ত পরিমাণের জানালা ও দরজা। যাতে তাতে প্রচুর পরিমাণে আলো-বাতাস প্রবেশ করতে পারে। অতএব, মুসলিমরা তাদের দুনিয়াবী কর্মকান্ড সম্পন্ন করার পাশাপাশি তাদের ধর্মীয় এবং দুনিয়াবী কর্মকান্ড একই সাথে তাদের প্রতিপালকের আদেশ-নিষেধ মতে আদায় করে তার নৈকট্য লাভ করেন।
অন্য দিকে হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানরা তাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান তথা মন্দির, মঠ ও গির্জাগুলো নির্মাণ করে পাহাড়ের চূড়ায়, জঙ্গলে এবং লোকালয় থেকে বহু দূরে। আর যদি লোকালয়ের মধ্যে নির্মাণ করা হয়; তবে তার স্থাপত্য রীতিটি করা হয় প্রায় অন্ধকার করে, যাতে মানব সমাজ থেকে অন্তত রূপকভাবে হলেও দূরে অবস্থান করে দুনিয়ার ভোগ-বিলাস থেকে দূরে থেকে তাতে একান্ত মনে উপাসনায় নিয়োজিত হওয়া যায়। এভাবেই হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানরা যেমন তাদের স্থাপত্য শিল্পগুলো তাদের ধর্মীয় দর্শনের আলোকে তৈরি করেছে, তেমনিভাবে মুসলিমরাও তাদের ধর্মীয় দর্শন অনুযায়ী তাদের ধর্মীয় ইবাদতের স্থান মসজিদগুলোর স্থাপত্য রীতি আলাদা করে নিয়েছে। ফলে তাদের নিজস্ব স্থাপত্য শিল্প তৈরি হয়েছে।
আমরা যদি প্রাচীন মিসরীয় স্থাপত্য শিল্পগুলো দেখি তার সাথে গ্রিক স্থাপত্য শিল্পের তুলনা করি তাহলে আমরা দেখতে পাব যে, এতদুভয়ের নির্মাণ কৌশলে বিরাট ব্যবধান রয়েছে। প্রথমোক্তদের স্থাপত্য শিল্পগুলো যেমন আকারে বড়, তেমনি শক্ত মজবুতও বটে। তা থেকেই বুঝা যায় যে, তারা একটি ধর্মে দৃঢ়ভাবেই বিশ্বাসী ছিল। তাদের জীবন-যাপন রীতি থেকে মনে হয়, তারা এ জীবনের পরে আরো একটি জীবনে বিশ্বাসী ছিল। অন্য দিকে গ্রিক জাতির স্থাপত্য শিল্পের দিকে তাকালে মনে হয়, তারা তা অতি সূ²ভাবে সুন্দর ও সুনিপুণভাবে তৈরি করেছে। কারণ তারা কেবল দুনিয়ার এ জীবনেই বিশ্বাসী ছিল। তাদের জীবনযাপন রীতিতে যুক্তির প্রখরতা ও বস্তবাদী দর্শনের প্রতিফলন হয়েছে। মোট কথা হলো, যে কোন জাতির স্থাপত্য শিল্পে তাদের ধর্ম বিশ্বাস ও ধর্মীয় দর্শনের প্রতিফলন ঘটে। তেমনিভাবে শিল্পীর ব্যক্তিগত অভিব্যক্তি ও চিন্তা ভাবনার প্রতিফলনও ঘটে। আর যে যুগে তা নির্মিত হয়েছে সে যুগের মন মানসিকতা চিন্তা-ভাবনাও তাতে সুষ্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়। তাই প্রত্যেক জাতি ও প্রত্যেক যুগের আলাদা বিশেষ স্থাপত্য শিল্প তৈরি হয়।
স্থাপত্য শিল্প সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি ইতিবাচক; নেতিবাচক নয়। ইসলাম মুসলিমদেরকে স্থাপত্য শিল্প নির্মাণের অনুমোদন দেয়। তাতে শৈল্পিক ভাবনার প্রতিফলন ঘটানোর অনুমোদনও দেয়। বাড়ি-ঘর এবং অট্টালিকা কারুকার্যময় করার অনুমতিও দেয়। তবে তা সবই হতে হবে অহংকার প্রকাশ না করার ও বিলাসিতা প্রকাশ না করার শর্তে এবং অপব্যয় ব্যতিরেকে। আল কুরআন এবং মহানবীর হাদীসে এর প্রতি বার বার ইঙ্গিত করা হয়েছে। আল-কুরআনে ‘হুসূন’ বা কিল্লা, সায়াসি বা দুর্গ, বুরুজ বা উচ্চ অট্টালিকা ও দুর্গ, কুসূর বা অট্টালিকা, গুরুফ, বা কক্ষ, জুদুর বা দেয়াল, র্সাহ বা প্রাসাদ, কুরা মুহাস্সানা বা ‘সুরক্ষিত জনপদ’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার হয়েছে। যেমন এক আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেন, তোমরা যেখানেই থাক না কেন মৃত্যু তোমাদের নাগাল পাবে, যদিও তোমরা সুদৃঢ় দুর্গে অবস্থান কর। অর্থাৎ তোমরা সৃদুঢ় উচ্চ দুর্গে অবস্থান করলেও তোমাদের মৃত্যু অবশ্যই আসবে। তোমরা মৃত্যু থেকে কিছুতেই রেহাই পাবে না, পালাতে পারবে না। এ আয়াত থেকে প্রমাণ হয়, সুদৃঢ় উচ্চ দুর্গ ও অট্টালিকা নির্মাণ করা ও তাতে বসবাস করা বৈধ। আল্লাহ তা’আলা অপর এক আয়াতে বলেন, তাকে বলা হল, ‘প্রাসাদটিতে প্রবেশ কর’। অত:পর যখন সে তা দেখল, সে তাকে এক গভীর জলাশয় মনে করল এবং তার পায়ের নলাদ্বয় অনাবৃত করল। সুলাইমান বললেন, ‘এটি আসলে স্বচ্ছ কাঁচ-নির্মিত প্রাসাদ। এ আয়াতটিও প্রমাণ করে যে, অতি উচ্চমানের শিল্পসম্মত সুরম্য বাড়ি ও প্রাসাদ নির্মাণ করা বৈধ। কারণ সুলাইমান আ. একটি স্বচ্ছ কাঁচের উচ্চমানের শিল্পসম্মত প্রাসাদ নির্মান করে তার তলদেশ দিয়ে পানি প্রবাহিত করেন। তা এমন সুকৌশলে নির্মাণ করেন যে, যারা এর সম্পর্কে অবগত নয়, তারা মনে করে যে, তা পানি। অথচ পানি এবং পথচারীর মধ্যে স্বচ্ছ কাঁচের আবরণ রয়েছে। ফলে তার পায়ে পানি লাগার কোন সম্ভাবনা নেই। এ থেকে বুঝা যায় যে, সুলাইমান আ. নির্মিত এ প্রাসাদটিতে অতি উচ্চমানের শিল্প নৈপুণ্যের সমাবেশ ঘটেছিল। এ ঘটনা প্রমাণ করে যে, এ জাতীয় শিল্পমানের প্রাসাদ তৈরি করা এবং প্রাসাদকে কারুকার্যময় করা, তাতে বসবাস করা ইসলামে বৈধ।
আমি মনে করি, কেবল নিজের পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাসের জন্য বহুতল অট্টালিকা ও প্রাসাদ নির্মাণ করা মাকরূহ থেকে মুক্ত নয়। তবে ব্যবসার মাধ্যম হিসেবে ভাড়া দিয়ে অর্থ রোজগার করার জন্য অট্টালিকা ও প্রাসাদ নির্মাণ করা মাকরূহ নয়। বরং তা ছাওয়াবের কাজও হতে পারে, যদি মানুষের আবাসন সমস্যার সমাধান কল্পে তা তৈরি করা হয়। বিশেষত তা যদি বড় বড় শহরগুলোতে তৈরি করা হয়। কারণ বর্তমান যুগে আমাদের এই ঢাকা শহরের মত শহরে বহুতল ভবন নির্মাণ করা না হলে; আরো দু চার দশটি ঢাকা শহরের মত শহরের প্রয়োজন হবে। তখন দেখা দিবে তীব্র ভূমি সংকট। ইসলাম এমন কোন সিদ্ধান্ত দেয় না, যা মানুষের সমস্যা বাড়ায়। ইসলাম এসেছে মানুষের সমস্যা সমাধানের জন্য, সমস্যা বাড়াবার জন্য নয়। এ কারণেই ফকীহগণ বলেছেন, ‘যেখানেই মানব কল্যাণ সেখানেই ইসলাম’।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।