হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
গত সোমবার দশম জাতীয় সংসদের চার বছর পূর্তি হয়েছে। সংসদীয় গণতন্ত্রে জাতির গণতান্ত্রিক অধিকার অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে সংসদের বিভিন্ন অধিবেশনের চালচিত্রের মাধ্যমে। সে নিরিখে বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের অভিযাত্রা গত চার বছরে কতটা সফল অথবা ব্যর্থ হয়েছে, সে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। কোন দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রচলিত থাকলে সংসদের অধিবেশনের যে চিত্র দেখা যাওয়ার কথা, তা কতটা গত চার বছরে বাংলাদেশে দেখা গেছে, এ প্রশ্ন উঠলে তার কোন সন্তোষজনক জবাব পাওয়ার কথা নয়। কারণ বাহ্যত দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রচলিত থাকলেও সংসদীয় গণতন্ত্রের সার্থকতা নির্ভর করে যে ব¯ু‘টার উপর, সেটাই ছিল এ সংসদে অনুপস্থিত।
গণতন্ত্রের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে গণতন্ত্র হচ্ছে এমন এক শকট যা সচল থাকে দু’টি চাকার উপর। এ দু’চাকার একটি হচ্ছে সরকার আরেকটি হচ্ছে বিরোধী দল। এ ব্যাখ্যা যতটা সত্য সাধারণ গণতন্ত্র সম্পর্কে, তার চাইতেও অনেক বেশী সত্য সংসদীয় গণতন্ত্র সম্পর্কে। জাতীয় সংসদে একটি প্রকৃত কার্যকর বিরোধী দলের প্রাণবন্ত উপস্থিতি ব্যতীত সংসদীয় গণতন্ত্রের কথা কল্পনা করাই সম্ভব নয়। অথচ দু:খের বিষয় দশম জাতীয় সংসদে সেই অর্থের কোন প্রকৃত বিরোধী দলই নেই। এই দুর্ভাগ্যজনক অবস্থার জন্য কে বা কারা দায়ী তা স্পষ্ট হয়ে উঠবে যদি আমরা অতীতের দিকে ভালভাবে তাকাই।
বাংলাদেশের যে চারটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতি রয়েছে তার মধ্যে সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ ‘গণতন্ত্র’ হলেও স্বাধীন বাংলাদেশে বাস্তবতা বিচারে এই গণতন্ত্রের উপরই বারবার আঘাত এসেছে। প্রথম আঘাত তো আসে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের আমলেই, যখন সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে একটি মাত্র সরকারী দল রেখে দেশে একদলীয় বাকশালী ব্যবস্থা কায়েম করা হয়।
বেশ কিছু দু:খজনক ঘটনার মধ্যদিয়ে দেশে একদলীয় বাকশালী ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুন:প্রতিষ্ঠিত হলেও এক পর্যায়ে একটা নির্বাচিত সরকারকে সামরিক ক্যুর মাধ্যমে উৎখাত করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে বসেন তদানীন্তন সেনাপ্রধান জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এ সময় সারা বিশ্বকে অবাক করে দিয়ে ঐ সামরিক ক্যুর প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে বসেন দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা। এ ধরনের অকল্পনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল হয়তো এই বিবেচনায় যে, সামরিক ক্যুর মাধ্যমে উৎখাত হওয়া নির্বাচিত ঐ সরকারের নেতৃত্বে ছিল আওয়ামী লীগের নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি। নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের চাইতে সামরিক ক্যুর নেতৃত্বদানকারী জেনারেলের শাসন তাঁর কাছে অধিক সমর্থনযোগ্য বিবেচিত হওয়াটা কিন্তু তাঁর গণতন্ত্র-প্রীতির প্রমাণ বহন করে না।
সংবাদপত্রের পাঠক মাত্রই জানেন, এর পর শুরু হয় জেনারেল এরশাদের সুদীর্ঘ স্বৈরতান্ত্রিক শাসন। পাশাপাশি বিএনপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে চলতে থাকে জেনারেল এরশাদের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন। আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা অনেক দিন পর্যন্ত জেনারেল এরশাদের স্বৈরশাসন সম্পর্ক রহস্যজনক নীরবতা পালন করেন। পরবর্তীকালে এক পর্যায়ে তিনিও এরশাদ-বিরোধী আন্দোলন যোগ দিলেও ততদিনে বিএনপি চেয়ারপারসন রাজনীতিতে নবাগতা বেগম খালেদা জিয়া একটানা এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে আপোষহীন নেত্রী হিসাবে জনগণের কাছে সুনাম অর্জন করে বসেছেন। পরবতীকালে দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুন:প্রতিষ্ঠা লক্ষ্যে অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রশ্ন উঠলে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ এই দুই প্রধান দলই সুপ্রিম কোর্টের তদানীন্তন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বাধীন নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে একমত হন।
যেমনটি আশা করা গিয়েছিল, নির্বাচন অত্যন্ত সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়। প্রাচীনতম রাজনৈতিক দলের নেত্রী হিসাবে শেখ হাসিনা আশা করেছিলেন, নির্বাচনে তাঁর দল জয় লাভ করবে। তিনি নির্বাচন চলাকালে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপচারিতার এক পর্যায়ে বলেন, আমি সকল জেলার খবর নিয়েছি। নির্বাচন অত্যন্ত সুষ্ঠু হয়েছে। আপনারা লক্ষ্য রাখবেন ভোটে হেরে গিয়ে এরমধ্যে কেউ যেন আবার ‘কারচুপি’ আবিষ্কার না করে। নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পর দেখা গেল বিজয়ী হয়েছে আওয়ামী লীগ নয়, বিএনপি।
নির্বাচনের ফলাফল অনুসারে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া প্রধান মন্ত্রী আর শেখ হাসিনা হন সংসদে বিরোধী দলীয় নেত্রী। বেগম খালেদা জিয়ার শাসনআমলের মেয়াদ শেষ হলে নতুন নির্বাচনের প্রশ্ন উঠলে প্রধানত শেখ হাসিনার দাবীর মুখেই নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে সকল জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধানসহ সংবিধান সংশোধিত হয়।
বাংলাদেশের বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানই যে গণতন্ত্রের নিরিখে সব চাইতে উপযোগী, তা সুপ্রমাণিত হয়। বেশ কয়েকটি নির্বাচন এ পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হওয়ার ফলে দেশের দুই প্রধান দলই পরপর জয়ী হয়ে দেশ চালানোর অধিকার লাভ করে। কিন্তু দু:খের বিষয় এই সুন্দর পদ্ধতিকেও বা এক পর্যায়ে পচিয়ে ফেলা হয়। এরপর শেখ হাসিনার সরকারের আমলে এক পর্যায়ে সংবিধান সংশোধিত করে নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের পরিবর্তে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হলে বিএনপি অতীতের সমঝোতা লংঘনের অভিযোগে সে নির্বাচন বয়কট করে।
দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের একটি নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলে যে নির্বাচন কার্যত হয়ে পড়ে একটি নির্বাচনী প্রহসন। বিরোধী দলের নেতাকর্মী তো দূরের কথা, সরকারী দলের অনেক নেতাকর্মীও সে নির্বাচনে ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার গরজ অনুভব করেননি। তারা জানতেন তারা ভোট কেন্দ্রে না গেলেও দলের পক্ষ থেকে তাদের ভোট দানের ব্যবস্থা ঠিকই করা হবে।
কার্যত হয়ও সেটাই। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের অনুপস্থিতির সুযোগে শাসক দলের অল্পসংখ্যক নেতাকর্মীই ইচ্ছা মত সরকারী দলের প্রার্থীদের সপক্ষে ব্যালটপত্রে সীলমেরে সরকারী দলের প্রার্থীদের পক্ষে প্রদত্ত ভোট সংখ্যা মাত্রাতিরিক্তভাবে বাড়িয়ে দেখানোর সুযোগের দ্বাবহার করেন। এভাবেই সরকারী দলের প্রার্থীরা বিপুল ভোটে জয়ী হওয়ার সুযোগ লাভ করেন, যদিও ভোট প্রদানের নির্দিষ্ট সময়ে অধিকাংশ ভোটকেন্দ্র ছিল প্রায় ফাঁকা ও জনশূণ্য।
এওতো ছিল যেসব আসনে ভোটের মহড়া অনুষ্ঠিত হয় সেসব আসনের অবস্থা। ৩০০ আসন বিশিষ্ট জাতীয় সংসদের অধিকাংশ ১৫৩ আসনে তো কোন ভোটই হয়নি। কারণ সেসব আসনে সরকারী দলের বাইরে কোন প্রার্থীই ছিল না বিধায় এসব আসনের প্রার্থীরা সবাই বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় নির্বাচিত হন। ভোটারদের সাথে সম্পর্কবিহীন এভাবে নির্বাচন হওয়ায় ৫ জানুয়ারীর এ নির্বাচনকে জনগণ নাম দেয় ভোটারবিহীন নির্বাচন।
ভোটারবিহীন নির্বাচনের এ মহড়ার অর্থ এই নয় যে এদেশের জনগণ ভোট, নির্বাচন বা গণতন্ত্রে আগ্রাহী নয়। বৃটিশ আমল থেকেই দেখা গেছে নির্বাচনের দিন জনগণ সকল কাজ ফেলে রেখে প্রথমে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ভোটের জন্য লাইনে দাঁড়াতে অভ্যস্ত। দেশের বড় বড় সকল রাজনৈতিক অর্জন তারা সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমেই লাভ করেছে। ১৯৪৬ সালের পাকিস্তান দাবীর পক্ষে সাধারণ নির্বাচনে, ১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে নির্বাচনে, এবং ১৯৭০ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের ভিত্তি বাংলাদেশের স্বাধিকার দাবীর পক্ষে ভোটদানের মাধ্যমে এদেশের জনগণ প্রমাণ করেছে তারা সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে বড় বড় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে কতটা আগ্রহী।
দু:খের বিষয় আমাদের অতীতের গণতান্ত্রিক গৌরবজনক ঐতিহ্যকে আমরা এখন কালিমালিপ্ত করে চলতে বসেছি। জনগণের আন্তরিক সমর্থনের ভিত্তিতে, দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে জোরদার করে তোলার পরিবর্তে যে কোন মূল্যে ক্ষমতায় যাওয়া ও ক্ষমতায় টিকে থাকা আমাদের এক শ্রেণীর রাজনীতিকের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফল দাঁড়িয়েছে এই যে ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার যাওয়াতে আমরা এখন আর লজ্জা পাই না। আমরা উল্টো প্রধান বিরোধীদল নির্বাচন বয়কট করায় এই বলে সংসদে আনন্দ প্রকাশ করি যে, বিরোধী দল নির্বাচন বয়কট করায় এক হিসাবে ভালই হয়েছে। সংসদে তাদের খিস্তিÍ খেউর শুনতে হচ্ছে না।
বিরোধী দলের বক্তব্যকে যারা খিস্তিÍ খেউর বলে মনে করেন, তারা কি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী? গণতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে বিরোধী চিন্তাধারার প্রতি সহনশীল, শ্রদ্ধাশীল হওয়া। তাই আজ প্রশ্ন জাগছে, আমাদের পূর্ব পুরুষরা গণতন্ত্রের পথে চলে যে ঐতিহ্য সৃষ্টি করে গেছেন তার থেকে আমরা কি শিক্ষা গ্রহণ করে নতুন করে গৌরবময় ঐতিহ্য সৃষ্টি করতে সক্ষম হব, না গণতন্ত্রের আদর্শ অবহেলা করে যে কোন মূল্যে ক্ষমতায় যাওয়া ও ক্ষমতায় টিকে থাকার লজ্জাকর পথচলাকেই আঁকড়ে ধরে জাতিকে অধিক থেকে অধিকতর ¯ø্যানির মুখে নিক্ষেপ করব?
অন্য কথায়, সারা পৃথিবীতে আমাদের পরিচিতি কি হবে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে না স্বৈরতন্ত্রী ও স্বেচ্ছাতন্ত্রী রাষ্ট্র হিসাবে? যে দেশের অতীতে আমরা গণতান্ত্রিক আদর্শের মাধ্যমে অনেক মহৎ অর্জন লাভে সক্ষম হয়েছি, আজ কি তা ক্ষুদ্র ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থে বিসর্জন দিয়ে আমাদের অতীতের গৌরবময় গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের পরিবর্তে স্বৈরতন্ত্রী রাষ্ট্র হিসাবে পরিচিত হওয়ার দুর্ভাগ্য বরণ করে নেব? এটাই যদি হয় আমাদের নিয়তি তা হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের কিছুতেই ক্ষমা করবেনা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।