শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
কু ত ুব উ দ্দি ন আ হ মে দ
আসছে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। এই মাসটি দোরের সন্নিকটে এলেই বুকের ভেতর একধরনের হাহাকার করে ওঠে; আর্তনাদ করে ওঠে। এই সেই মাস; যে মাসে কয়েকটি তাজা বুক শুধুমাত্র বাংলা ভাষার ন্যায্য দাবিতে বন্দুকের নলের সামনে ঝাঁঝড়া হয়ে গিয়েছিল। এই জন্য, এই মাসটি হৃদয়ে কড়া নাড়লেই মনটা বিষণœতায় ভরে ওঠে। তাই কবি হুমায়ুন আজাদ এই মাসটিকে ‘ভীষণ দস্যি মাস’ বলে অভিহিত করেছেন।
ফেব্রুয়ারি এলেই আমরা বাংলা ভাষাভাষী মানুষগুলো বাংলা ভাষার প্রতি অনেকটা আবেগি হয়ে উঠি; এর একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটটি আমরা অল্পবিস্তর সকলেই জানি। কিন্তু বাংলা ভাষার ওপর এইযে আঘাত; এই আঘাত যে পাকিস্তানিরাই প্রথম করেছে; তা কিন্তু নয়। বুঝতে হবে, আমাদের এই বাংলা ভাষার সবচে’ বড় শত্রæ কিন্তু আমরাই। কালে কালে আমরাই বাংলা ভাষার ওপর সবচে’ বেশি ও বড় আঘাতগুলো করে এসেছি। কেন এই আঘাতগুলো দিয়েছি এবং কীভাবে দিয়েছি সে-আলোচনায় এখন আর যাচ্ছি না; এই বিষয়ে আমরা সকলেই কম-বেশি ওয়াকিবহাল আছি। আমারা জানি, বাংলা ভাষার এ-আঘাত প্রাপ্তির ইতিহাস অতি দীর্ঘ। এর প্রমাণ মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিম [১৬২০Ñ ১৬৯০ ]। নিশ্চয়ই মধ্যযুগেও বাংলা ভাষার শত্রæর অভাব ছিল না। ঐ সময়ে বাংলা ভাষার অবস্থা প্রকট ও শোচনীয় না হলে কবি আবদুল হাকিমকে কলম ধরতে হত না। ঐ সময়ে, ঐ মধ্যযুগেও আমাদের বাংলা ভাষার অবস্থা কতটা শোচনীয় ছিল আবদুল হাকিমের কবিতা পাঠান্তে তা সহজেই অনুমান করা যায়। কবি আবদুল হাকিম লিখেছেন:
কিতাব পড়িতে যার নাহিক অভ্যাস।
সে সবে কহিল মোতে মনে হাবিলাষ।।
তে কাজে নিবেদি বাংলা করিয়া রচন।
নিজ পরিশ্রম তোষি আমি সর্বজন।।
আরবি ফারসি শাস্ত্রে নাই কোন রাগ।
দেশী ভাষে বুঝিতে ললাটে পুরে ভাগ।।
আরবি ফারসি হিন্দে নাই দুই মত।
যদি বা লিখয়ে আল্লা নবীর ছিফত।
যেই দেশে যেই বাক্য কহে নরগণ।
সেই বাক্য বুঝে প্রভু আপে নিরঞ্জন।।
সর্ববাক্য বুঝে প্রভু কিবা হিন্দুয়ানী।
বঙ্গদেশী বাক্য কিবা যত ইতি বাণী।।
মারফত ভেদে যার নাহিক গমন।
হিন্দুর অক্ষর হিংসে সে সবের গণ।।
যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।।
দেশি ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়।
নিজ দেশ তেয়াগি কেন বিদেশ ন যায়।
মাতা পিতামহ ক্রমে বঙ্গেত বসতি।
দেশী ভাষা উপদেশ মনে হিত অতি।
[বঙ্গবাণী ঃ নূরনামা]
কবি আবদুল হাকিমের স্বভাষার প্রতি ছিল গভীর শ্রদ্ধা ও মমতা। সেই শ্রদ্ধা আর মমতায় উৎসারিত হয়েই তিনি উপর্যুক্ত কবিতাটি লেখায় হাত দিয়েছেন। সেই মধ্যযুগেও কারো যে মাতৃভাষার প্রতি এতোটা মমত্ববোধ, প্রগাঢ় ভালোবাসা ছিল, সত্যিই বিষয়টি ভাবনার উদ্রেককারী।
এখন দেখা যেতে পারে, কবি আবদুল হাকিমের ভাষ্যমতে তৎকালে বাংলা ভাষার সংকটটা [ ক্রাইসিস] কী ছিল। তাঁর কবিতার অনুগামী হলে দেখা যায়, তৎকালে মানুষ ধর্মীয় ভুল ব্যাখ্যার অনুগামী হয়ে বাংলা ভাষার প্রতি চরম বৈরি আচরণ করেছে। তাদের হয়তো ধারণা ছিল যে, আরবি-ফারসি আল্লাহর ভাষা; এই ভাষা ব্যতীত অন্যসকল ভাষায় আল্লাহকে ডাকলে সাড়া দেন না; বা তৎকালের অতি মূর্খদের হয়তো ধারণা ছিল যে, আরবি-ফারসি ছাড়া খোদাতায়ালা অন্য ভাষা বুঝতেই পারেন না। সম্পূর্ণ এই ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে তৎকালে মানুষ বাংলা ভাষাকে মনে-প্রাণে গ্রহণ করতে পারেনি; তারা এই ভাষাটির সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ করেছে। তারা এই দেশে বাস করেছে, এই দেশের আলো-হাওয়ায় বেড়ে উঠেছে; কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই দেশের ভাষাটিকে গ্রহণ করতে পারেনি; একে হিন্দুর ভাষা বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে। তারা এতোটাই অজ্ঞ ও নাদান ছিল যে, তারা জানতই না যে কোন ভাষাবিশেষের প্রতি সৃষ্টিকর্তার রাগ-অনুরাগ নেই। তিনি সকল ভাষাই বোঝেন, সকল ভাষাতেই সমানভাবে সাড়া দেন।
কবি আবদুল হাকিমের কবিতাটি পাঠান্তে এতোটুকু অনুমান করা যায় যে, বাংলা ভাষার প্রতি তাদের যে শুধু বিরাগ ছিল তাই না, এই ভাষাকে তারা বিভিন্নভাবে অপমাণিত ও লাঞ্ছিতও করেছে। নচেৎ কবি আবদুল হাকিম তাদের জন্মদাতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতেন না এবং দেশ ত্যাগেরও উপদেশ দিতেন না। নিশ্চয়ই বাংলা ভাষার প্রতি তাদের আচরণ দেখে এই কবি অতিশয় রুষ্ট হয়েছিলেন।
এইভাবে কালে কালে, যুগে যুগে আমাদের বাংলা ভাষা বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন হাতে নিগৃহীত ও লাঞ্ছিত হয়ে আসছে। আজও বাংলা ভাষার এ অধ্যায় শেষ হয়নি। এই আমরা, যাদের মাতৃভাষা বাংলা, যাদের মমতা ও ভালোবাসায় বাংলা ভাষা আরও ফলবতী হওয়ার কথা; তারাই কিনা বাংলাকে চরমভাবে অবজ্ঞা করে আসছি। প্রকৃত অর্থে বাংলা ভাষাকে কি আমরা ভালবাসি? কবি শামসুর রাহমান কেন বলেছেন:
এখন তোমাকে নিয়ে খেঙরার নোংরামি
এখন তোমাকে ঘিরে খিস্তি-খেউড়ের পৌষমাস!
তোমার মুখের দিকে আজ আর যায় না তাকানো,
বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা।
কবি শামসুর রাহমানের ‘এখন’ আসলে কখন? ‘এখন’ মানে আসলে ‘তখন’ নয়; ‘এখন’ মানে ‘এখন’; ঠিক যখন এই লেখাটি লিখছি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।