শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
অ্যাডোনিস আধুনিক কাব্যজগতে পরিচিত নাম। তাঁর জন্ম ১ জানুয়ারি ১৯৩০ সালে সিরিয়ার উত্তরে লাতিকিয়ার আল-কাসাবিন গ্রামে। অ্যাডোনিসের পুরো নাম আলী আহমেদ সাই’দ আসবার। তবে সিরিয়ার এ সাহিত্যিককে গোটা বিশ্ব সংক্ষিপ্ত অ্যাডোনিস নামেই চেনে। সাহিত্য জীবনের শুরুর দিকে অ্যাডোনিস নামক ছদ্মনামটি গ্রহণ করেন তিনি। গ্রিক মিথলজিতে অ্যাডোনিস অর্থ ‘সুদর্শন যুবক’।
পাশ্চাত্য দর্শন ও সাহিত্যবোধকে সঙ্গী করেও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির বিরোধিতা করেন অ্যাডোনিস।নিজস্ব সংস্কৃতির সঙ্গে অন্য সংস্কৃতির মেল-বন্ধনে বিশ্বাস করতেন তিনি। তবে তা নিজস্বতাকে বিকিয়ে দিয়ে নয় কিংবা প্রশ্নহীনভাবে পাশ্চাত্য আধুনিকতাকে গ্রহণ করেও নয়।
প্যারিসে বসবাসকারি ৮৬ বছর বয়সি সিরিয়ান কবি এডোনিস সাম্প্রতিক সাক্ষাতকারে বলেন- “পুর্ব এবং পশ্চিম হচ্ছে সামরিক ও অর্থনৈতিক ধারনা, যা এসেছে উপনিবেশবাদ থেকে। ভৌগলিকভাবে বলা যাবে, এটা পুর্ব, ওটা পশ্চিম এবং উপনিবেশবাদ তা ব্যাবহার করেছে। শিল্পের ক্ষেত্রে কোন পুর্ব-পশ্চিম নাই। পল ক্লি তিউনিসিয়া এবং পুর্ব আরব থেকে অনুপ্রানিত হয়েছে। মরক্কোর লোকশিল্প থেকে প্রমানিত হয়েছে দেলাক্রোয়া। র্যাবো জন্মেছে পশ্চিমে, কিন্তু বরাবর পশ্চিম বিরোধি। আবু নাওয়াস, আবু আল-মারিকে পুর্বের বা পশ্চিমের বলা যাবে না। সৃজনশিলেরা সবাই একই বিশ্বের, তারা একটা মানবিক বিশ্বে একত্রে বসবাস করে। হুইটম্যান এবং আবু তাম্মান আমার জন্য একই বিশ্বের লোক!”
অ্যাডোনিসের কবিতাকে বলা যায় মহাকাব্যিক। সমগ্র বিশ্ব, বৃহত্তর মানবজাতি, সৌন্দর্যের অনুভূতি, ঘটনাপ্রবাহ, বস্তু ও প্রাকৃতিক নানা বিস্ময় তার কাব্যের অনুষঙ্গ হয়ে আসে। ফলে এগুলো তার কাব্যবোধের মহারণ্যিক এক পরিব্যাপ্ততাকে প্রকাশ করে। অ্যাডোনিসের কবিতায় রয়েছে তার প্রখর ভাষাবোধের প্রতিফলন। তিনি কাব্যছন্দ কিংবা অলংকার ব্যবহার করে বিষয়ের অন্তঃস্থলে প্রবেশ করতে চান। আরব-কাব্যজগতে গদ্যকবিতা তার হাত দিয়েই পরিচিতি লাভ করে।
অভিবাসনের ওপর লিখেছেন এডোনিস, এটা আরব সংস্কৃতির একটা গুরুত্বপুর্ন অংশ। এডোনিস বলেন- অভিবাসন ঘটছে দুটো কারণে, হয় কর্মসংস্থান নেই অথবা স্বাধীনতা নেই। ফলে নাগরিকেরা কাজ করতে এবং তুলনামূলকভাবে মুক্ত বোধ করতে নতুন জায়গাতে যাচ্ছে। আরব দেশগুলো অত্যন্ত গরিব। দুই’শ বছর ধরে এখানে কোন ভালো বিশ্ববিদ্যালয়, ভালো গবেষণাগার গড়ে ওঠে নি। অথচ আমাদের বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে। আমরা সেগুলো সমরাস্ত্র কিনতে, যুদ্ধ্ব বিমান কিনতে ব্যায় করি, আমরা এমন কি বৈমানিকও কিনে আনি আমাদের হয়ে যুদ্ধবিমান ওড়াতে এবং যুদ্ধ করতে, যেমনটা সৌদিরা করছে ইয়েমেনে। দুনিয়াটা কাদাময় এবং আমরা প্রাগৈতিহাসিক পর্জায়ে আছি এখনো। আমরা এখনো মধ্যযুগে আটকে আছি।”
কবি হিসেবে তিনি নিরীক্ষাধর্মী। গতানুগতিকতার হাত থেকে কাব্যকে বাঁচানোর সংগ্রাম তিনি করেছেন। সমকালীন সমাজ ও রাজনৈতিক চিন্তাকে তিনি কবিতার আঙ্গিকের মধ্য দিয়েই প্রকাশ করতে চাইতেন। ইন রেজারেকশন অ্যান্ড অ্যাশেশ-কাব্যে অ্যাডোনিস লেখেন :
হায় ফিনিক্স, যখন তোমার প্রিয় পাখায় আগুন ধরে/বল তখন কী তোমার অবলম্বন?/কী করেই বা কর পাখার প্রতিস্থাপন?/তুমি কি মুছে ফেল তোমার প্রমাদ?/যখন ছাই-ভস্ম ঘিরে ফেলে তোমায়,/তখন অনুভবের পৃথিবী তোমার কেমন?
সাম্প্রতিক লেখাতে এডোনিস ‘আরব-পরিচয়’ নিয়ে বলেন “এটা শুধু একজন আরবের জন্য নয়, এটা সমগ্র মানুষের জন্যই একটা চড়াদাগের সমস্যা।ধর্ম অনেক প্রশ্নের নিস্পত্তি করে আসছিলো, খ্রিস্টান হচ্ছে খ্রিস্টান, ইহুদি হচ্ছে ইহুদি, মুসলিম হচ্ছে মুসলিম। প্রত্যেক ‘অন্যপক্ষ্যের’ পরিচয় সেখানে প্রশ্নের মুখোমুখি। সে যদি আমার মত বিশ্বাস করে, তাহলে তাকে স্বিকৃতি দেব, আমার মত না করলে স্বিকৃতি দেব না। এর একটা কারন হচ্ছে একেশ্বরবাদি ধর্মগুলোতে ‘অন্যপক্ষ্য’কে হয় সংগায়িত করা হয় নাই, কিম্বা শত্রু হিশাবে দেখানো হয়েছে। সুতরাং ব্যাক্তি যখন ধর্মের কাঠামোর বাইরে আসতে চাচ্ছে, সে পরিচয় জটিলতায় পড়ে যাচ্ছে।
আরব সুফিরা অবস্য এ-জটিলতার নিস্পত্তি করতে চেয়েছে।ফরাসি কবি র্যাবো বলেছিলো, ‘আমি হচ্ছি অপর’! ইসলাম ধর্মে মুসলমান তার পরিচয় লাভ করে উত্তরাধিকার সুত্রে, যেভাবে সে তার বাবার অর্থ, সম্পদ, খামার উত্তরাধিকার সুত্রে পায়। সুফিরা বলছে, পরিচয় উত্তরাধিকার নয়, বরং একে সৃষ্টি করতে হয় এবং অর্জন করতে হয়।মানুষ তার কর্মদর্শনের ভেতর দিয়ে পরিচয় নির্মান করে! সুতরাং, পরিচয় যদি সৃজনশিল নির্মিতি হয়, তাহলে আর ‘আমি’ থাকে না, সে অপরে বিনির্মিত হয়। আমাকে নিজত্বে উপনিত হতে হলে, আমাকে অপরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হতে হবে! সুফিবাদে, পরিচয়ের সম্ভাবনা অসিমভাবে খোলা।
যতক্ষন একজন বেচে আছে ততক্ষন সে তার পরিচয়কে নবায়িত করতে পারে। একজন যদি উত্তির্ন কবিতা লিখে যায়, তার মৃত্যুতে তার পরিচয় শেষ হচ্ছে না, কারন তার কবিতা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে পড়া হবে। নব্বই দশকের শুরুর দিকে অ্যাডোনিস কবিতার পাশাপাশি তার অনুভবের জগতকে ধরার জন্য ছবি আঁকার কাজে হাত দেন। এ সময়ের কিছু কোলাজ কর্মে (দুবাইয়ের হানার গ্যালারিতে প্রদর্শিত) অ্যাডোনিসের আঁকা ক্যালিগ্রাফি ও শব্দ দিয়ে তৈরি চিত্রকর্মগুলো সাংস্কৃতিক মিলনের কথা বলে। শিল্পী হিসেবে তিনি বিশ্বাস করেন জগতে বেঁচে থাকার কিছু না কিছু অর্থ আছে। তিনি মানেন, শুধু জীবন ও জগতের লেনদেন নয় বরং মানুষের অন্তর্গত অনুভূতি ও স্বভাব দ্বারা পরস্পরের মধ্যে কিছু একটা সঞ্চার করতে পারলে জীবনের অর্থ আবিষ্কার করা সম্ভব।
এডোনিসকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আরব-সংস্কৃতির ভবিষ্যত কি? জবাবে তিনি বললেন - “যতদিন মৃত্যু ও প্রেম থাকবে, ততদিন শিল্প থাকবে। ভয়ের কিছু নাই। আরব বিশ্বে গভিরতরো লেখাগুলোর পাঠক হয়ত কম,তাতে কিছু যায় আসে না! যে নিক্সন আজকের আধুনিক চিন্তাকে উস্কেছিলো, কেউ তাকে চিন্তো না, একটা রচনাও প্রকাশ হয় নাই তার জিবত কালে! এটাই শিল্পের নিয়তি, সবসময়। অনেকে প্রকাশিত হয়, বাজারে তাদের কাটতিও হয়, কিন্তু তাদের বইগুলো নিক্ষেপিত হয় ইতিহাসের আস্তাকুড়ে।”
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।