হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত শুক্রবার জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে বলেছেন সংবিধান অনুযায়ী এ বছর (২০১৮) সাধারণ নির্বাচন। শুধু তাই নয়, নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে এ বছরের ১৮ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ রীতিমত চিন্তাভাবনা শুরু করে দিয়েছেন। বাংলাদেশের জনগণ গভীরভাবে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। আর দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে জোরদার করে তুলতে নিয়মিত ব্যবধানে অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোন বিকল্প নেই।
এর পরও দু:খজনকভাবে সত্য এই যে, বাংলাদেশে অদ্যাবধি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা জোরদার হতে পারেনি। এর ঐতিহাসিক কারণও ছিল। প্রথমত পাকিস্তান আমলে সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রের অসাধারণ প্রভাবের কারণে সে আমলে দেশে কখনও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা জোরদার ও স্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারেনি। এ কারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিচ্ছ্যে অংশ হয়ে উঠেছিল গণতান্ত্রিক সংগ্রাম। একই কারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য যে চারটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতি স্থিরিকৃত হয় তার অন্যতম ছিল গণতন্ত্র। অন্যতম বললেও ভুল বলা হবে, গণতন্ত্র ছিল জনগণের কাছে সব চাইতে গ্রহণযোগ্য রাষ্ট্রীয় মূলনীতি। এ কারণে অপর তিন রাষ্ট্রীয় মূলনীতি সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদকে বিভিন্ন সরকারের আমলে মাঝে মাঝে পরিবর্তন করা হলেও গণতন্ত্রের গায়ে আঁচড় কাটতে সাহস পায়নি কোন সরকার।
দু:খের বিষয়, যে রাষ্ট্রীয় মূলনীতির প্রতি জনগণের অবিচল আস্থা বিবেচনায় এনে কোন সরকার তার পরিবর্তন বা সংশোধন করতে সাহস পায়নি, সেই গণতন্ত্রের প্রতিই সব চাইতে বেশী অবিচার করা হয়েছে বাস্তব ক্ষেত্রে। এবং সেটা শুরু হয় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের আমলেই। ঐ সরকারের আমলেই গণতন্ত্রের টুটি চেপে ধরে সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে একটি মাত্র সরকারী দলকে রেখে দিয়ে দেশে এক দলীয় বাকশালী শাসন ব্যবস্থা কায়েম করা হয়।
পরবর্তীকালে বেশ কিছু দু:খজনক ঘটনার মধ্য দিয়ে দেশে বহু দলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুন: প্রতিষ্ঠিত হলেও এক পর্যায়ে একটি নির্বাচিত সরকারকে সামরিক ক্যুর মাধ্যমে উৎখাত করে দেশে সামরিক শাসন কায়েম করে বসেন তদানীন্তন সেনাপ্রধান জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। সে সময় সারা দুনিয়াকে অবাক করে দিয়ে ঐ সামরিক ক্যুর প্রতি সমর্থন দিয়ে বসেন দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নেত্রী শেখ হাসিনা। এটা হয়তো সম্ভব হয়েছিল এই বিবেচনায় যে, সামরিক ক্যুর মাধ্যমে উৎখাত হওয়া ঐ নির্বাচিত সরকারের নেতৃত্বে ছিল আওয়ামী লীগের নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি। এতে প্রমাণিত হয় নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের তুলনায় সামরিক ক্যুর মাধ্যমে ক্ষমতা দখলকারী জেনারেলের শাসন তাঁর কাছে অধিক গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়েছিল।
এরপর শুরু হয় জেনারেল এরশাদের সুদীর্ঘ স্বৈরাচারী শাসনামল। পাশাপাশি চলতে থাকে বিএনপি এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের এরশাদ-বিরোধী আন্দোলন। আওয়ামী লীগ প্রথম প্রথম বহু দিন স্বৈরাচার-বিরোধী সে আন্দোলনে অংশগ্রহণ না করায় এবং রাজনীতিতে নবাগতা বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া একটানা সে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে আপোষহীন নেত্রী হিসাবে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করতে সমর্থ হন। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগও এক পর্যায়ে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন অংশগ্রহণের পর অনুষ্ঠিত হয় সাধারণ নির্বাচন। এ নির্বাচন যাতে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয় সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সুপ্রীম কোর্টের তদানীন্তন প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বাধীন নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে সে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে একমত হয়।
দেশের প্রাচীনতম দল আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়লাভ করবে দলটি এমন আশা করলেও ফলাফল প্রকাশিত হবার পর দেখা গেল বিএনপি নির্বাচনে জয়লাভ করেছে। নির্বাচনের ফলাফল অনুসারে বিএনপি নেত্রী বেগম-খালেদা জিয়া হন পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী এবং শেখ হাসিনা হন বিরোধী দলীয় নেত্রী। খালেদা জিয়ার শাসনামলের মেয়াদ শেষে যখন নতুন নির্বাচনের প্রশ্ন উঠল, তখন প্রধানত : তদানীন্তন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার দাবীর মুখেই নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে দেশের সকল জাতীয় নির্বাচনের বিধানসহ সংবিধান সংশোধনের ব্যবস্থা করা হয়। বাংলাদেশের বিশেষ পরিস্থিতিতে এটাই যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সচল রাখার সর্বোত্তম উপায় তা বাস্তবে প্রমাণিত হয়। নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে এভাবে নির্বাচনের ফলে দেশের প্রধান দুই দলই পরপর জয়লাভ করে দেশ পরিচালনার সুযোগ লাভ করে।
পরবর্তীকালে অতিরিক্ত ক্ষমতা-ক্ষুধার মাধ্যমে এক পর্যায়ে এই সুন্দর ব্যবস্থাটিকেও পচিয়ে ফেলা হয় এবং শেখ হাসিনার শাসনামলে সংবিধান সংশোধন করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের পরিবর্তে দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। এতে অতীতের সমঝোতা লংঘনের অভিযোগ এনে বিএনপি ৫ জানুয়ারীর সে নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দেয়। দেশের প্রধান দুই দলের অন্যতম বিএনপি নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলে বাস্তাবে সে নির্বাচন হয়ে পড়ে একটি নির্বাচনী প্রহসন। বিরোধী দল বিএনপি তো দূরের কথা, সরকারী দল আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীও ঐ নির্বাচনে ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার গরজ অনুভব করেননি। কারণ তারা জানতেন, বিরোধী দলের বর্জিত এ নির্বাচনে তাদের ভোট প্রদানের ব্যবস্থা দলের পক্ষ থেকেই করা হবে।
আসলে হয়ও সেটাই। ভোট কেন্দ্রে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের অনুপস্থিতির সুবাদে সরকারী দলের অল্পসংখ্যক নেতাকর্মীই সরকারী দলের প্রার্থীদের স্বপক্ষে বেশী বেশী সীলমেরে তাদের স্বপক্ষে প্রদত্ত ভোটের সংখ্যা মাত্রাতিরিক্তভাবে বাড়িয়ে দেখানোর সুযোগ গ্রহণ করেন। এভাবেই আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বিপুল জয়লাভের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়, যদিও ভোট গ্রহণের নির্ধারিত সময়ে অধিকাংশ ভোট কেন্দ্র ছিল প্রায় ফাঁকা ও জনশূণ্য। পরবর্তী দিন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ফাঁকা, জনশূণ্য ভোট কেন্দ্রের যেসব সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হলো, তাতে জনগণের ৫ জানুয়ারীর ঐ নির্বাচনের আসল রহস্য ধরা পড়ে যায়।
কিন্তু এটা তো ছিল নির্বাচনী প্রহসনের একটি ক্ষুদ্রাংশ মাত্র। জাতীয় সংসদের মোট ৩০০ আসনের অধিকাংশ ১৫৩ আসনে এ ধরনের নির্বাচনী প্রহসনেরও প্রয়োজন পড়েনি। এসব আসনে শুধু সরকারী দলের লোকেরা প্রার্থী হওয়ায় তারা বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় নির্বাচিত হওয়ার অকল্পনীয় সুযোগ লাভ করেন।
যে দেশের গণতন্ত্র-ভক্ত জনগণ সাধারণ নির্বাচনে এতটা আগ্রহী যে সাধারণত : নির্বাচনের দিন সকল কাজ ফেলে ভোরের দিকেই ভোট কেন্দ্রে যেয়ে লাইনে দাঁড়াতে অভ্যস্ত, সেখানে ভোটকেন্দ্রের এ ফাঁকা, জনশূণ্য চিত্র বিবেচনা করেই জনগণ এ নির্বাচনকে ভোটারবিহীন নির্বাচন আখ্যা দেয়।
বিগত ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনী প্রহসন নিয়ে এসব কথা স্মরণ করতে হচ্ছে এই জন্য যে, চলতি বছরটিও সাংবিধানিক আনুষ্ঠানিকতার নিরিখে আরেকটি জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা। সে নির্বাচন যেন আরেকটি নির্বাচনী প্রহসনে পরিণত না হয়, সেটা নিশ্চিত করার প্রধান দায়িত্ব সরকারের। আর নির্বাচনের সার্থকতা নির্ভর করে জনগণের সকল অংশের তাতে অংশগ্রহণের অবাধ সুযোগ সৃষ্টির উপর। আমাদের দেশের জনগণ যে গণতন্ত্রে আন্তরিক বিশ্বাসী, তার প্রমাণ ১৯৪৬, ১৯৫৪ ও ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক সাধারণ নির্বাচন। এর প্রথমটিতে স্বত:স্ফূর্ত অংশগ্রহণ করে জনগণ সাতচল্লিশের পাটিশনের পক্ষে রায় প্রদান করে, দ্বিতীয়টিতে অংশগ্রহণ করে তারা মুসলিম লীগের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে যুক্ত ফ্রণ্টের বিজয় নিশ্চিত করে, আর তৃতীয়টিতে অংশ গ্রহণ করে তারা ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে স্বাধীন বাংলাদেশের ভিত্তি ভূমি নির্মাণ করে।
দেশে গণতন্ত্র সচল থাকলে আমাদের উন্নতি অবশ্যসম্ভাবী। পক্ষান্তরে ক্ষুদ্র ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থে আমরা যদি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে কার্যকর ও জোরদার করার পরিবর্তে দুর্বল করে ফেলি, তবে আমরা স্বাধীনতাকেও নিজেদের অজান্তে দুর্বল করে ফেলবো এবং তা হবে এক ধরনের রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। মনে রাখতে হবে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। দেশে গণতন্ত্রকে দুর্বল করে স্বাধীন দেশকে শক্তিশালী করার চিন্তা অবাস্তব। এর অসংখ্য দৃষ্টান্ত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে পাওয়া যায়।
আর একটা বিষয়ে সংক্ষেপে কিছু বলেই আজকের আলোচনার ইতি টানতে চাই। গণতন্ত্রের মূল কথা নিজের চিন্তাধারার বিপরীত চিন্তাধারার প্রতি আস্থা পোষণ করা। মানুষ সাধারণত নিজেদের ভুল নিজেরা দেখতে ও বুঝতে পারে না। দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু থাকলে এবং বিভিন্ন বিষয়ে জনগণের মতামত প্রকাশের অবাধ ব্যবস্থা চালু থাকলে শাসকদের পক্ষে নিজেদের ভুল বুঝবার সুযোগ সৃষ্টি হয়। এর ফলে যারা সরকারের বিভিন্ন কাজের সমালোচনা করে তাদের দ্বারা সরকার নিজেদের ভুল সম্পর্কে অবহিত হওয়া ও তার সংশোধনের সুযোগ পেয়ে উপকৃতই হয়। সেক্ষেত্রে সরকারের সমালোচকরাও এক হিসাবে সরকারের সহায়ক ভূমিকাই পালন করে। সে নিরিখে নিজেদের সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে বিরোধী দলের লোকদেরকে শত্রু মনে না করে তাদের সমালোচনা থেকে নিজেদের ভুল বুঝতে চেষ্টা করার এবং দেশের জনগণের বৃহত্তর স্বার্থের কাজ করার সুযোগ গ্রহণই সবার জন্য অধিক কল্যাণকর।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।