শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
সেঁ জু তি শু ভ আ হ্ মে দ
ভালো দিকের পাশাপাশি প্রায় প্রত্যেক প্রযুক্তির কম বেশি মন্দ দিক দেখা গেছে। তথ্য প্রযুক্তিরও ইতিবাচক ও নেতিবাচক ভূমিকা নিয়ে নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। এ কথা বলা বাহুল্য তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণে শিল্প-সাহিত্য, সাংবাদিকতা, গবেষণা, মুদ্রণ শিল্প থেকে নিয়ে শিক্ষাদীক্ষার ব্যাপ্তি ও সাংস্কৃতিক বিকাশে বৈপ্লবিক উন্নয়ন ঘটে গেছে। কিন্তু অপরপক্ষে প্রদীপের নিচে অন্ধকারের মতো তথ্যের অবাধ প্রবাহ ও সহজলভ্যতাÑঅন্য কোন দেশে কি মাত্রায় জানি নাÑবাংলাদেশের লেখালেখির জগতে অনেকভাবে নেতিবাচক উপায়ে স্পর্শ করছে। কুম্ভিলকবৃত্তি প্রসারের কথা না হয় থাক। আজকাল কি কবিতা, কি গল্প-উপন্যাস, কি কলাম আর নিবন্ধÑসব কিছুতে তথ্য ব্যবহারের একটা খাপছাড়া বাড়াবাড়ি পরিলক্ষিত হচ্ছে। শব্দভারে, তথ্যভারে আর অতিভাষায় ভারাক্রান্ত লেখা পাঠক মনকে প্রায়শই বিষিয়ে দিচ্ছে। সহজপ্রাপ্য তথ্য ও শব্দের এই উচ্ছৃঙ্খল যথেচ্ছ ব্যবহার পাঠককে একটা অনাকাঙ্খিত দীর্ঘশ্বাসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে ঠিক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অসম্পাদিত যাচ্ছেতাই লেখার অবাধ প্রবাহ মুদ্রণ মাধ্যমকেও যে ভিজিয়ে চুপসে দিচ্ছে, সে সম্পর্কে হয়তো অনেকে একমত হবেন।
সাম্প্রতিক লেখালেখিতে অপ্রয়োজনীয় তথ্যভার যতটা উঠে আসছে, গভীর চিন্তা, কল্পনাশক্তি ও তথ্যের সুষ্ঠু বিশ্লেষণ সেভাবে উঠে আসছে না। ফলে এই সুবিধাবাদী লেখালেখির চর্চা জ্ঞানচর্চা কিংবা জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে এক বিপদসঙ্কুল অন্তরায়।
এখন কবিতায় অযাচিত শব্দ ও বিশেষণের অতিশয়ণ কবিতাকে একেকটি অর্থহীন ক্ষুদে শব্দভান্ডার বানিয়ে ফেলছে যেন। আর বর্তমান সময়ের অনেক গল্প-উপন্যাসের সাথে নাটকের পান্ডুলিপির পার্থক্য থাকছে যৎসামান্য। দুই বা ততোধিক চরিত্রের মধ্যে সংলাপ বলার মধ্য দিয়েই এসব গল্প-উপন্যাসের শুরু এবং সংলাপ বলাবলির মধ্য দিয়েই যেন তার হাঁফ ছেড়ে বাঁচা সমাপ্তি! এসবকে গল্প-উপন্যাস না বলে ‘কথোপকথন’ সমগ্র বলাটাই বোধ হয় শ্রেয় হবে। সংলাপ অতিশয্যেও অনেক সিরিয়াস বক্তব্য গল্প উপন্যাসে উঠে আসতে পারেÑতা অবশ্যই পাঠক সাদরে গ্রহণ করবেন। তবে অন্তঃসারশূণ্য স্থূল সংলাপে যখন গল্প উপন্যাসের অদ্যোপান্ত ক্লিশে হয়ে ওঠে, তখনই তার গ্রহণযোগ্যতা নি¤œগামী হতে শুরু করে। একটি উপন্যাস পড়ে পাঠক যদি দুয়েকদিন অনুভাবে ভাবিত না হন, সময়ে সময়ে আলোড়িত না হন, তবে সে উপন্যাসিকের শ্রম স্বার্থকতা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, ভেবে দেখার বিষয়। এসময়ের অনেক গল্প-উপন্যাসকে যদি সাহিত্যরস নয়, জ্ঞান নয় কেবল সস্তা বিনোদনের মাধ্যম হিসেবেও ধরা হয়, তবুও তা উদ্দেশ্য পূরণে কতটা সফল হবেÑবলা মুশকিল। একুশে বই মেলায় কি আর এমনি এমনি প্রতিবছর অগুনতি কবিতা-উপন্যাস অকাল গর্ভপাতের ফলে পরিণত হচ্ছে? কথায় বলে জঙ্গলের ঠেলায় গাছ দেখা যায় না। আর বই মেলায় আগাছা বইয়ের গাদাগাদিতে ফসলি বইটি খুঁজে পেতে পাঠককে তো আর কম বেগ পেতে হচ্ছে না। এই পথে পরিভ্রমণ থেকে বাংলা ভাষার লেখালেখিকে নিষ্কৃতি দিতে পারেন; এমন লোকও তো তেমন দেখি না।
হ্যাঁ, এটা ঠিক যে লেখক সারাটাদিন লেখালেখি নিয়ে পড়ে থাকলে তার রুজি-রোজগারে, সংসার জীবনে চড়াই উৎড়াই শুরু হয়ে যাবে। কিন্তু একটি ভালো লেখা, তা যে কোন বিষয়ের উপরেই হোক, লেখকের কাছে নূন্যতম যতœআত্মি তথা পরিচর্যা দাবি করে। একটি গ্রহণযোগ্য লেখা লেখকের কাছে দাবি করে একটু কল্পনা, কখনো একটু একাকীত্ব কিংবা একটু পঠন পাঠন। লেখক যদি সেই নূন্যতম দাবিটুকু মেটাতে না পারেন, তবে লেখার সাথে তার তো একটা আড়ি তৈরী হবেই। অনেক কবিই এখন ‘খোলস’ সাধনায় ব্যাপৃত। তাঁরা একচেটিয়া ফর্ম বা আঙ্গিক চর্চা করেন এবং অনান্য অনুষঙ্গের চেয়ে ফর্মের গুণ কীর্তন-মাহাত্ম্য প্রচারে অসীম তৃপ্তি লাভ করেন। কবিতাকে যদি ব্যক্তির সাথে তুলনা করা যায়, তাহলে ফর্ম হলো ওই ব্যক্তির পোশাক পরিচ্ছদ। রুচিসম্মত ভালো পোশাক পরিচ্ছদ সুন্দর ব্যক্তিত্বের পরিচায়ক। সুতরাং পোশাকের গুরুত্বকে অবহেলা করবার জো নেই। কিন্তু কেউ যদি ব্যক্তিকে ফেলে কেবল তার পোশাক-আশাক নিয়ে টানাটানিতে ব্যস্ত থাকেন, তবে দৃশ্যপটটি সুখকর হয় না। এ ধরনের রীতিবাদী আগ্রাসন কবিতায় ক্ষণিক স্ফূর্তির যোগান দিতে পারে, গভীর রস ও অকৃত্রিম সৌন্দর্যের সন্ধান দিতে পারে না।
ডিম আগে না মুরগি আগের মতো বিতর্ক লেখাপড়ার দুনিয়ায় লেখক-প্রকাশক ও পাঠকের সমন্বিত ভূমিকার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কোন জাতিতে ভালো লেখকের জন্ম হতে হলে, সে জাতিতে জ্ঞানী প্রকাশক ও বোদ্ধা পাঠকেরও জন্ম হওয়া চাই। একই যুক্তিতে একজন ভালো লেখক ভালো প্রকাশক ও ভালো পাঠকের জন্ম দিতে পারেন। ধরা যাক, কোন লেখক খুবই উঁচু দরের সাহিত্য রচনা করলেন কিন্তু যদি তার মর্মোদ্ধারের মতো বুদ্ধিজাত যোগ্যতা প্রকাশকের না থাকে, তবে তা কিভাবে পাঠকের কাছে পৌঁছবে এবং কিভাবেই বা তার মূল্যায়ন হবে; সে নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়।
লেখক-প্রকাশক-পাঠকের আন্তসম্পর্ক অনেকটা অর্থনীতির চাহিদা ও যোগান নীতিকে অনুসরণ করে বললে ভুল হবে না। লেখক হলেন জ্ঞানের উৎপাদনকারী আর পাঠক হলেন জ্ঞানের আহরণকারী। প্রকাশক হলেন লেখক ও পাঠকের মধ্যে যোগাযোগের সেতুবন্ধন তৈরীর দূত। আহরণকারী যেভাবে যতটুকু আহরণ করতে চাইবেন, উৎপাদনকারী তো সেভাবে ততটুকুই উৎপাদন করতে প্রয়াসী হবেন। উল্টোভাবে বলা যায়, উৎপাদনকারী যা-ই উৎপাদন করুন না কেন আহরণকারীর সামনে বিকল্প না থাকলে তিনি তা-ই ভোগ করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়বেন। অন্যথায় অযোগ্য পাঠক যোগ্য লেখকের লেখা ধারণ করতে পারবেন না অথবা যোগ্য পাঠকের উন্নত রুচি অনুযায়ী অযোগ্য লেখক লিখতে সক্ষম হবেন না। প্রকাশককে উভয় পক্ষের চাহিদা ও যোগানের সমন্বয় সাধনে যথেষ্ট জ্ঞানবুদ্ধির পরিচয় দিতে হয়। সুতরাং লেখালেখির জগতে এই তিন পক্ষই একটি ভারসাম্যপূর্ণ মানদন্ডের মধ্য দিয়ে বিচরিত। এই ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেলে কোন পক্ষের একক প্রচেষ্টায় না হবে সৃজনশীল লেখকের আবির্ভাব, না হবে গুণী প্রকাশকের উদ্ভব আর না হবে বিদগ্ধ পাঠকের জন্ম।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।