Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উত্তপ্ত ছিল বিচার বিভাগ

ফিরে দেখা ২০১৭

| প্রকাশের সময় : ১ জানুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণের প্রধান ফটকের মূতির অপসারণ : গেজেট মামলা শুনানিতে আপিল বিভাগ ও রাষ্ট্রপক্ষের তীব্র বাকবিতন্ডা : ষোড়শ সংশোধনীর আপিলে রায় বহাল : প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নজিরবিহীন পদত্যাগ
মালেক মল্লিক : গেল বছরজুড়ে সরগরম ছিল বিচার বিভাগ। সর্বত্রই আলোচনায় স্থান পায় বিচার বিভাগ সম্পর্কিত নানা ইস্যু। বছরের শুরু থেকেই সবার দৃষ্টি ছিল দেশের সর্বোচ্চ আদালতের (সুপ্রিম কোর্ট) দিকে। সবচেয়ে বেশি আলোড়ন সৃষ্টি করে প্রধান বিচারপতির এস কে সিনহার বিদেশ থেকে পত্রযোগে পদত্যাগের ঘটনা। যেটি ছিল দেশের ইতিহাসের প্রথম কোন প্রধান বিচারপতির নজির বিহীন পদত্যাগের ঘটনা। আর ষোড়শ সংশোধনী রায়, নিন্ম আদালতের গেজেট নিয়ে আপিল বিভাগ ও রাষ্ট্রপক্ষের তীব্র বাকবিতন্ডা, বিডিআর হত্যা মামলার, সাত খুন মামলা, বিশ্বজিৎ হত্যার রায় নিয়েও সরব ছিল সুপ্রিম কোর্ট। সুপ্রিম কোর্ট প্রধান ফটকের সামনে গ্রিক দেবীর মূতি (ভাস্কর্য) স্থাপন করা নিয়ে সাধারণ জনগণ থেকে দেশের সর্বোচ্চ মহল পর্যন্ত আলোচনা চলে। বছরের একেবারে শেষ এসেও ষোড়শ সংশোধনী রিভিউ আবেদন শুনানি নিয়ে আদালতে অঙ্গণে চলে নানামুখী আলোচনা। আইনজ্ঞনাদের মতে, ২০১৭সালের অধিকাংশ সময় বিচার অঙ্গণে এক ধরনের অস্তিরতার ছোঁয়া বিরাজ করে। যেটি স্বাধীন বিচার বিভাগের জন্য শুভ নয়।
২০১৫ সালের প্রথমদিক প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন অবসের পর আপিল ব্ভিাগের বিচাপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দেশের ২১তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে তিনি একই বছরের ১৭ জানুয়ারি শপথ গ্রহণ করেন। দায়িত্ব গ্রহণের বর্ষপূর্তিতে প্রধান বিচারপতির এক বাণীতে সরগরম হয়ে ওঠে বিচারাঙ্গন। চলতে থাকে আদালতে অঙ্গণের ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়ন। সারা দেশে জেলা জজ আদালতে সফর করেন। এছাড়াও প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিচার বিভাগ নিয়ে সরকারে কাছে দাবি দাওয়া তুলে ধরেন। যেটিকে সরকারের আইনমন্ত্রী ভাল মনে করেন নাই। এমনিক কি আইনমন্ত্রী বলেন বর্তমান প্রধান বিচারপতি বেশি কথা বলেন। অতীতে এমনভাবে কোন প্রধান বিচারপতি কথা বলেন নাই। এমতাবস্থায় নি¤œ আদালতের গেজেট মামলা শুনানি শুরু হলে এস কে সিনহার নেতৃত্বধীন আপিল বিভাগ ও সরকারের প্রধান কৌশলীর মধ্যে চলতে তীব্র বাকবিতন্ড। এই গেজেট জারি না হওয়ায় নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে বিচার বিভাগের দূরত্ব ক্রমেই বাড়তে থাকে। গেজেট জারি নিয়ে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার সঙ্গে আইন মন্ত্রণালয়ের টানাপড়েন প্রকাশ্যে রূপ নেয়। অবশেষে গত ১১ ডিসেম্বর গেজেট জারি করে সরকার। তবে বিচারকদের শৃঙ্খলা বিধানের বিষয়টি পুরোপুরি নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে।
এরপর আপিলে শুনানির জন্য ষোড়শ সংশোধনী। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করলে গত ৩ জুলাই তা খারিজ করেন আপিল বিভাগ। ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া রায় বহাল রাখা হয়। এর পর এ রায় নিয়ে জাতীয় সংসদে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। সমালোচনা চলে রাজনৈতিক অঙ্গনেও। আর রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের পর রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে তীব্র অসন্তোষ দেখা যায় সরকার সমর্থকদের মধ্যে।
প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ : ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে দেয়া বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ ও মতামত নিয়ে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে রাজনৈতিক অঙ্গনেও। ওই রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারপতি এসকে সিনহা দেশ মানবাধিকার ঝুঁকিতে, দুর্নীতি অনিয়ন্ত্রিত, সংসদ ও নির্বাচন কমিশন অকার্যকর বলে উল্লেখ করেন। রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেন ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী, এমপি দলীয় নেতা ও সরকারপন্থি আইনজীবীরা। তারা প্রধান বিচারপতির পদত্যাগের আলটিমেটাম দেন।
সমালোচনার মধ্যেই গত ১ অক্টোবর অসুস্থতার কথা বলে প্রেসিডেন্ট কাছে প্রধান বিচারপতি সিনহা হঠাৎ করেই এক মাসের ছুটির কথা জানিয়ে চিঠি দেন বলে জানান আইন মন্ত্রনালয়। এর পর আইনমন্ত্রী জানান, প্রধান বিচারপতি ক্যানসারে আক্রান্ত। পরে তার ছুটি ১০ নভেম্বর পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। গত ১৩ অক্টোবর রাতে অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন বিচারপতি এসকে সিনহা। দেশ ছাড়ার আগে প্রধান বিচারপতি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আমি অসুস্থ নই। বিচার বিভাগের স্বার্থে আবার ফিরে আসব। পরের দিন ১৪ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন থেকে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বলা হয়, প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে ১১টি দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পর তার কাছে ব্যাখ্যা চেয়ে কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। এ কারণে প্রান বিচারপতির সঙ্গে বসতে চাননি আপিল বিভাগের বিচারপতিরা। এর পর নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা অস্ট্রেলিয়া থেকে সিঙ্গাপুরে আসেন। সেখানে উদ্ভূত পরিস্থিতির সমাধানের জন্য সমঝোতা বৈঠক করেন। একপর্যায়ে গত ১০ নভেম্বর বিচারপতি এসকে সিনহা সিঙ্গাপুরে বসেই পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে কানাডায় চলে যান।
বিডিআর হত্যা মামলায়: ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রæয়ারি রাজধানীতে তৎকালীন বিডিআর সদর দপ্তর পিলখানায় বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে। হত্যা মামলায় মোট আসামি ছিল ৮৫০। ইতিহাসে এটাই সবচেয়ে বড় ফৌজদারি মামলা। ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর নিম্ন আদালত এ হত্যা মামলায় রায় ঘোষণা করেন। আর গত ২৭ নভেম্বর হাইকোর্ট রায় ঘোষণা করেন। হাইকোর্টের রায়ে নিম্ন আদালতে মৃত্যুদন্ড-প্রাপ্ত ১৫২ জনের মধ্যে ১৩৯ জনের মৃত্যুদন্ড বহাল রাখা হয়।
সাত খুন মামলার রায় : গত ২২ আগস্ট হাইকোর্ট আলোচিত সাত খুন মামলার রায়ে কাউন্সিলর নুর হোসেন এবং সাবেক র‌্যাব অধিনায়ক তারেক সাঈদসহ ১৫ জনের মৃত্যুদন্ডের আদেশ বহাল রাখেন। এর আগে এই সাত খুন মামলা ২৬ জনের মৃত্যুদন্ড দিয়েছিলেন একটি আদালত। এদের মধ্যে ১৫ জনের মৃত্যুদন্ড-বহাল রেখে বাকি ১১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেন হাইকোর্ট। তাদের ২০ হাজার টাকা করে জরিমানাও করা হয়। না দিলে আরও দুবছরের সাজা ভোগ করতে হবে। এ ছাড়া ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ডের রায় হাইকোর্টও বহাল রাখেন।
বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার রায়: পুরান ঢাকার বিশ্বজিৎ দাস হত্যা মামলায় হাইকোর্টের রায় ঘোষণাটিও ছিল আলোচিত ঘটনা। ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর ১৮ দলের অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ ক্যাডাররা নির্মমভাবে খুন করেন বিশ্বজিৎ দাসকে। ২০১৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর এ মামলায় আটজনকে মৃত্যুদন্ড ও ১৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেন আদালত। এ মামলায় বিচারিক আদালতে মৃত্যুদন্ড পাওয়া আট আসামির মধ্যে দুজনের মৃত্যুদন্ড বহাল রেখে ৬ আগস্ট রায় দেন হাইকোর্ট। বাকি ছয়জনের মধ্যে চারজনের মৃত্যুদন্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন এবং অপর দুজনকে খালাস দেয়া হয়। এ ছাড়া যাবজ্জীবন কারাদন্ড পাওয়া ১৩ আসামির মধ্যে যে দুজন আপিল করেছিলেন, তারা খালাস পায়। এছাড়াও সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ চেয়ে চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদের স্ত্রীর করা এক মামলা নিষ্পত্তি করে হাইকোর্ট। সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে মূর্তি (লেডি ভাস্কর্য) স্থাপন’ ও সমালোচনার মুখে তা রাতের আঁধারে সরিয়ে ফেলা, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল দুর্নীতি মামলায় আদালতে হাজির হওয়া, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলার শুনানি, জয় বাংলা সেøাগান ও ৭ মার্চ নিয়ে হাইকোর্টের রুল জারি, মুফতি হান্নানসহ তিন জঙ্গির ফাঁসি ছিল আদালত অঙ্গনের বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বছরজুড়েই আলোচনায় ছিল।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বিচার বিভাগ

১ জানুয়ারি, ২০১৮

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ