পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
১১ রবিউস সানি গাওসুল আজম, বড়পীর হজরত আবদুল কাদের জীলানী (রহ.)-এর ওফাত দিবস। দিনটি ফাতেহায়ে ইয়াজ দহম এবং গিয়ারভী শরীফ নামেও খ্যাত। তাঁর জন্ম হিজরী ৪৭০, মতান্তরে ৪৭১ সালে। তাঁর জীবনের ৩৩ বছর শিক্ষকতা ও ফতোয়া এবং ৪০ বছর ওয়াজ নসিহতে অতিবাহিত হয় এবং ৯০ বছর বয়সে হিজরী ৫৬১ সালে ইন্তেকাল করেন।
রূহানী জগতের পেশোয়া, কাদেরিয়া তরিকার প্রবর্তক গাউসুল আজম (রহ.) ছিলেন বহু কারামতপূর্ণ সূফী সাধক এবং সমগ্র দুনিয়ায় তাঁর ভক্ত অনুসারীদের সংখ্যা বিপুল। তাঁর জ্ঞানের বিশালতা ও কারামত অলৌকিক ঘটনাবলি লিখে শেষ করা যাবে না। তাঁর জীবনের গুরত্বপূর্ণ বহুদিক রয়েছে। এখানে আমরা তাঁর কারামতপূর্ণ জীবনের কয়েকটি মাত্র ঘটনার কথা উল্লেখ করতে চাই, যাতে রয়েছে আধ্যাত্মিক শক্তিবলে তিনি অভিশপ্ত ইবলিশ শয়তানকে কীভাবে পরাজিত করেছিলেন তার বিবরণ ও আরো দু’একটি অলৌকিক ঘটনা।
১. হজরত গাওসুল আজম (রহ.) এর ওয়াজ মজলিসে চারশ’ লোক দোওয়াত কলম নিয়ে উপস্থিত থাকতো এবং তার জবানী যা শ্রবণ করতো, সঙ্গে সঙ্গে তা লিপিবদ্ধ করে নিতো।
২. গাওসুল আজম (রহ.)-এর মজলিসে কখনো কখনো ইহুদী ও খ্রিস্টানরা উপস্থিত হতো এবং তারা গাওসুল আজমের হাতে বায়আত হতো।
৩. প্রথমদিকে তিনি রাসূলুল্লাহ (স.) এবং হজরত আলী মোর্তাজা (রা.)কে স্বপ্নে দেখেন এবং তাঁরা বলার নির্দেশ দেন এবং তাঁর মুখে লোআব (থুথু) টপকে দেন। এভাবে তার মধ্যে বলার দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যায়।
৪. দুনিয়া ত্যাগের উদ্দেশ্যে হজরত গাওসুল আজম (রহ.) খোদ বলেন, আমি ইরাকের বন জঙ্গলে এবং বীরান ভূমিতে পঁচিশ বছর উ™£ান্তের ন্যায় চষে বেড়িয়েছি। অবস্থা ছিল এই যে, কেউ আমাকে চিনত না, কারো সাথে আমার ও পরিচয় ছিল না। গাইব (অদৃশ্যের) লোকজন এবং জ্বিন সম্প্রদায়ের লোকেরা আমার কাছে আসতো এবং তাদেরকে আমি তরিকত শিক্ষা দিতাম।
৫. তিনি আরো বলেন, চল্লিশ বছর পর্যন্ত ফজরের নামাজ, এশার অজু দ্বারা পড়তে থাকি। পনেরো বছর পর্যন্ত এশার নামাজ আদায় করার পর কোরআন মজীদ তেলাওয়াত করতে থাকি এইভাবে যে, এক পায়ের ওপর দাঁড়াতাম এবং এক হস্ত দ্বারা দেয়ালের খুঁটি ধরে কোরআন তেলাওয়াত শুরু করতাম এবং সকাল পর্যন্ত খতম করতাম। তিন থেকে চল্লিশ দিন অতিবাহিত হয়ে যেতো, পানাহার বিশ্রাম এবং ঘুম হতে বঞ্চিত থাকতাম। এগারো বছর পর্যন্ত বুর্জে বাগদাদ আমার অবস্থান কেন্দ্র হওয়ায় তাকে বুর্জে আজমী বলা হতো। সেখানে আমি আল্লাহর স্মরণে আত্মনিয়োগ করি। এ সময়, আল্লাহর সাথে অঙ্গীকার করেছিলাম যে, যতক্ষণ পর্যন্ত গাইব হতে খাবার আসবে না, আমি কিছুতেই কোনো বস্তু আহার করবো না। এ অবস্থায় অনেক দিন অতিবাহিত হয়ে যেতো এবং আমি অঙ্গীকার রক্ষায় স্থির থাকতাম। আমার দাবি, আমি আজ পর্যন্ত আল্লাহর সাথে কৃত ওয়াদা ভঙ্গ করিনি।
৬. গাওসুল আজম (রহ.) বলতেন, আমার কথাবার্তা হয় গাইবী লোকদের সাথে যারা কূহে কাফের পাদদেশ হতে এসে থাকে, তাদের পদ হয় বাতাসে এবং তাদের অন্তর পরওয়ারদিগারের আগ্রহের আগুনে এবং ইশকের হুলকায় প্রজ্জ্বলিত।
৭. একদা লোকেরা জিজ্ঞাসা করে, আপনি কীভাবে অবগত হলেন যে, আপনি আল্লাহর অলী? জবাবে গাওসুল আজম (রহ.) বলেন, আমার বয়স যখন দশ বছর, তখন আমি গৃহ হতে মকতবে আসা যাওয়া করতাম, চলার পথে দেখতাম যে, ফেরেশতাগণ আমার আশে পাশে চলাচল করছেন। আর যখন মকতবে পৌঁছাতাম তখন তারা বাচ্চাদের বলতেন, অলী আল্লাহর জন্য স্থান করে দাও।
এ সময় একদিন আমি এমন এক ব্যক্তিকে দেখলাম যাকে ইতিপূর্বে কখনো দেখিনি। তিনি একজন ফেরেশতাকে জিজ্ঞাসা করলেন, এই ছেলে কে যার প্রতি এতো সম্মান প্রদর্শন করা হচ্ছে? ফেরেশতা বললেন, আল্লাহর অলী গণের একজন। যিনি এক মহা মর্যাদার অধিকারী, তরিকতে তিনি এমন এক ব্যক্তিত্ব, যাকে বিনা প্রতির প্রতিবন্ধকতার নেয়ামত প্রদান করা হয়, যাকে খোলাখুলি রূহানী মর্যাদা প্রদান করা হয় এবং যিনি বিনা বাক্যে নৈকট্য অর্জনকারী। চল্লিশ বছর পর আমি জানতে পারি যে, ঐ প্রশ্নকারী ছিলেন সে যুগের আব্দাল দলের একজন।
৮. একবার কোনো কারী গাওসুল আজম (রহ.)-এর মজলিসে কোরআন মজীদের একটি আয়াত তেলাওয়াত করেন। হজরত আয়াতটির তফসীরে প্রথমে একটি অর্থ বয়ান করেন। অতঃপর দ্বিতীয় ব্যাখ্যা, ফের তৃতীয় ব্যাখ্যা করেন, এমনকি উপস্থিত লোকদের জ্ঞান অনুযায়ী তিনি আয়াতটির এগারো রকমের ব্যাখ্যা পেশ করেন। অতঃপর সূ² বিষয়গুলো বর্ণনা করেন এবং সমর্থনে দলিল প্রমাণ উপস্থাপন করেন, যাতে উপস্থিত শ্রোতারা অবাক ও বিস্মিত হয়ে পড়েন। অতঃপর তিনি আয়াতের জাহেরী ব্যাখ্যা বাদ দিয়ে বাতিনী ব্যাখ্যা আরম্ভ করেন এবং বলেন ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’, এটি উচ্চারণ করা মাত্র উপস্থিত লোকদের মধ্যে শোরগোল শুরু হয়ে যায় এবং জামা ছিড়ে অনেকে মরুভূমি বিয়াবানের দিকে ছুটতে থাকে।
৯. একবার জামে মসজিদে গাওসুল আজম (রহ.)-এর হাঁচি আসে। এতে উপস্থিত লোকদের ইয়ার হামুকাল্লাহ ও ইয়ারহামু রাব্বুকা- ধ্বনি এত জোরে হতে থাকে যে, সে সময় মসজিদে উপস্থিত খলিফা মোস্তানজেদ বিল্লাহ বিচলিত হয়ে জিজ্ঞাসা করেন, এ শোরগোল কিসের? বলা হলো, শায়খ আবদুল কাদের জীলানী (রহ.)-এর হাঁচি এসেছিল এবং লোকেরা তাকে দোয়া দিয়েছিল।
১০. পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, হজরত গাওসুল আজম (রহ.)-এর মজলিস কখনো ইহুদী, খ্রিস্টান ইত্যাদি থেকে খালি থাকতো না, যারা আসতো তারা সবাই তাঁর হাতে বায়আত হতো, ইসলাম গ্রহণ করতো। তিনি ডাকাত, বেদাতি এবং ধর্মীয় ফেতনাবাজদের সত্যের ওপর তওবা করাতেন। এরূপ লোকদের দ্বারা মজলিস পরিপূর্ণ থাকতো। তাঁর হাতে পাঁচ শতাধিক ইহুদী-খ্রিস্টান এবং লক্ষাধিক অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোক তওবা করে এবং পাপাচারির জীবন হতে ফিরে আসে। এ ছাড়া সাধারণ লোক, যারা তাঁরই বদৌলতে সৎ পথে আসার সৌভাগ্য লাভ করে, তাদের সংখ্যা বিপুল-বেশুমার।
১১. এক রাতে আব্বাসীয় খলিফা আবুল মোজাফ্ফর মোস্তানজেদ বিল্লাহ গাওসুল আজম (রহ.)-এর মজলিসে উপস্থিত হন এবং সালাম করে আদবের সাথে বসে পড়েন। তার সঙ্গে দশজন গোলাম আশরাফী (মুদ্রার) ব্যাগ বহন করেছিল। খলিফা মুদ্রা ভর্তি ব্যাগগুলো হজরতের খেদমতে পেশ করেন। তিনি এগুলো গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান। পরিশেষে তিনি আশরাফির একটি থলে ডান হাতে রাখেন এবং আরেকটি বাম হাতে ধরেন। অতঃপর দুটি থলেই দাবাতে থাকেন। দেখা গেলো, থলেগুলোর সব মুদ্রাই (আশরাফি) রক্ত হয়ে গেছে এবং থলে থেকে রক্ত পড়তে থাকে। অতঃপর গাউসুল আজম (রহ.) বললেন: হে আবুল মোজাফ্ফর! তুমি খোদাকে ভয় করো না বলে লোকদের রক্ত চুষে আমার কাছে নিয়ে এসেছ। এ কথা শুনে খলিফা এমনভাবে ভীত সন্ত্রস্ত হন যে, অজ্ঞান হয়ে পড়েন। এবার গাওসুল আজম (রহ.) অত্যন্ত ক্ষুব্দ ও উত্তেজিত হয়ে বললেন, যদি বংশ মর্যাদার দিক দিয়ে খলিফা রাসূলুল্লাহ (স.)-এর সাথে সম্পৃক্ত না হতেন, তাহলে আল্লাহর কসম, আমি এ রক্ত তার প্রাসাদ পর্যন্ত প্রবাহিত করে দিতাম।
শয়তান মিথ্যাবাদী, ধোকাবাজ, কীভাবে বড়পীর গাওসুল আজম হজরত আবদুল কাদের জীলানী (রহ.)-এর ধমক খেয়ে পালিয়ে যায়, এ ঘটনাটিও ইতিহাসে বর্ণিত হয়েছে। গাওসুল আজম (রহ.)-এর নিকট মেঘের আকার ধারণ করে আসার পূর্ব পর্যন্ত অভিশপ্ত শয়তান সত্তর জন অলীকে গুমরাহ করেছিল বলে সে স্বীকার করেছে; কিন্তু গাওসুল আজম (রহ.) তাকে মিথ্যাবাদী বলে তাড়িয়ে দেন। ঘটনাটি এরকম, হজরত আবদুল কাদের জীলানী (রহ.)-এর বর্ণনা অনুযায়ী, একবার তিনি সফরে ছিলেন, তীব্র গরমের কারণে তার পিপাসা বেড়ে যায়। এ সময় আসমানে কালো মেঘ ছড়িয়ে পড়ে তীব্র ঠাÐা পড়তে থাকে। তখন একটি আওয়াজ শুনতে পান। ইয়া আবদাল কাদের, আনা রাব্বুকা হে আবদুল কাদের, আমি তোমার প্রভু। জবাবে তিনি বললেন, আনতা হুআল্লা হুল্লাজি লা ইলাহা ইল্লাহু, অর্থাৎ- তুমি সেই প্রভু, সে ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। অতঃপর আওয়াজ আসে; ‘ইয়া আবদাল কাদের আনা রাব্বুকা, অ-কাদ আহলাল তুলাকা মা র্হারামতু আলাইকা;’ অর্থাৎ হে আবদুল কাদের! আমি তোমার প্রভু এবং তোমার ওপর আমি যা হালাল করেছিলাম, তোমার ওপর তা হারাম করলাম। বড় পীর জবাবে বললেন, কাজবতবাল আনতা শাহাতানুন অর্থাৎ মিথ্যা বলেছিস বরং তুই শয়তান। একথা শুনামাত্র ঐ কালো মেঘ সরে গেলো।
তিনি বলেন, আমার পেছন হতে আওয়াজ আসে আবদুল কাদের তুমি আজ তোমার খোদা প্রদত্ত সমঝ দ্বারা মুক্তি পেয়ে গেলে। তোমার পূর্বে আমি সত্তর ব্যক্তিকে এভাবে গুমরাহ করেছি।
মহাশক্তিশালী আল্লাহর শক্তির কাছে শয়তানী শক্তি কিছুই না। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে তার থেকে শয়তান যে ক্ষমতা লাভ করেছে। তার সেই ক্ষমতাবলে আল্লাহর খাঁটি বান্দাদের সে কোনই ক্ষতিসাধন করতে পারবে না। দুনিয়ায় আদম থেকে সকল নবীর নিকট শয়তান এসেছিল, কিন্তু তাতে সে সফল হয়নি, ব্যর্থ হয়ে সরে যেতে হয়েছে। আল্লাহর অলিগণের কাছেও শয়তান এসেছে কিন্তু তার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। তবে শয়তান স্বীকার করেছে যে, গাওসুল আজমের কাছে আসার আগ পর্যন্ত সত্তর জন অলীকে সে গুমরাহ করেছে। মিথ্যাবাদী শয়তানের এ দাবী আদৌ সত্য কিনা সেটিও বড় প্রশ্ন। তবে শয়তানের খপ্পরে পড়ে অহরহ মানুষ গুমরাহ-পথভ্রষ্ট হয়ে চলেছে। মিথ্যাবাদী শয়তান আল্লাহর দুশমন, মানুষের দুশমন।
শয়তানের প্রতারণা হতে আত্মরক্ষার জন্য পবিত্র কোরআনের অসংখ্য স্থানে সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে। অসংখ্য হাদীসেও অনুরূপ বলা হয়েছে। বোখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হজরত আবু হোরায়রা (রা.)-এর বরাতে বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ বলেছেন, শয়তান তোমাদের নিকট এসে জিজ্ঞাসা করে, এটি কে সৃষ্টি করেছে, এই বস্তুকে কে সৃষ্টি করেছে? এমনকি সে একথাও জিজ্ঞাসা করে, তোমার খোদাকে কে সৃষ্টি করেছে? যদি তুমি এরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হও তাহলে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করো। অপর বর্ণনা অনুযায়ী, সূরা এখলাছ পাঠ করে তিনবার বাম দিকে থুথু নিক্ষেপ করবে এবং আউজুবিল্লাহি মিনাশ শায়তানির রাজিম পাঠ করবে। শয়তানের প্ররোচনায় বিভ্রান্ত না হয়ে তাকে চেনার চেষ্টা করতে হবে, যেমন পীরানে পীর গাওসুল আজম হজরত আব্দুল কাদের জীলানী (রহ.) শয়তানের প্ররোচনা যথার্থভাবে আঁচ করতে পেরেছিলেন এবং তাকে মিথ্যাবাদী বলে বিতাড়িত করেছিলেন। তার জীবনের অলৌকিক ঘটনাবলীর মধ্যে শয়তান বিতাড়নের ঘটনা উল্লেখযোগ্য। আল্লাহ সকলকে অভিশপ্ত ইবলিশ শয়তানের সকল প্রকারের কুমন্ত্রণা ও প্ররোচনা হতে রক্ষা করুন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।