চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
ভারতবর্ষে ইসলামি শাসনের উত্থান-পতনের মাঝেও রয়েছে আমাদের জন্য এক বিরাট শিক্ষা। কেবল বারো হাজার সৈন্য নিয়ে বাদশা বাবর ভারত আক্রমণ করলেন। আর তা দিয়েই জয় করে নিলেন বিশ কোটি মানুষের বিশাল জনপদ। এরপর মুত্তাকি-পরহেজগার, আল্লাহভীরু শাসক একের পর এক ভারত শাসন করে আসছিলেন। এভাবেই ক্রমাগত ভারতবর্ষে ইসলাম ও মুসলমানদের উত্থান হচ্ছিলো। বছরের পর বছর ধরে মুসলমানরাই এসব অঞ্চল শাসন করেছিলেন। এরপর যখন মুসলিম শাসকদের অবস্থায় পরিবর্তন এলো, ধর্মীয় অধঃপতন আরম্ভ হলো, নিজেদের দায়িত্ব-কর্তব্যে অবহেলা দেখা দিলো, তখন তাদেরকে তাদের কর্তব্যের ডাক দিয়ে জাগানো হলো। কিন্তু তাদের সে গভীর ঘুম ভাঙলো না। এরই মাঝে বাদশাহ আকবর তার মনগড়া দীন-ই-এলাহি প্রতিষ্ঠা করলো। তখনও পর্যন্ত আল্লাহর কোনো শাস্তি তাদের ওপর আসেনি। এভাবে দিনদিন যখন তাদের অবস্থায় অবনতি ঘটলো, আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগিতে উদাসীন হতে লাগলো, আরাম-আয়েশ ও বিলাসিতায় তারা মত্ত হলো, মদ্যপানসহ নানাধরনের গর্হিত কাজ শাহিমহলে সদর্পে আঞ্জাম দিতে লাগলো, সৃষ্টির সেবার পরিবর্তে খাহেশাতে নাফসানি (মনচাহিদা পূরণ) মনোভাব তাদের মাঝে জন্মালো, দীন হেফাজতের দায়িত্বশীল হয়ে নিজেরাই দীন বর্বাদ করলো, তাদের কারণে জনসাধারণের মাঝেও দীনি অধঃপতন পরিলক্ষিত হলো, তখন হজরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবি (রহ.) ঘরে ঘরে গিয়ে সবাইকে ডেকে বললেনÑ‘হে আল্লাহর বান্দারা, এখনও সময় আছে, আল্লাহর নাফরমানি থেকে ফিরে এসো। আমি দিল্লির অলিগলিতে শুধু মানুষের রক্ত দেখছি।’ কিন্তু কোথায়! মানুষ তাঁর কথায় বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করলো না। উপরন্তু এ বলে তাচ্ছিল্য করলোÑ‘আরে মোল্লাদের খেয়েদেয়ে কাজ নেই, শুধু এ কাজই করে বেড়ায়। তাদের মাথা ঠিক নেই।’ পরিশেষে যা হবার তা-ই হলো। আল্লাহ তাদেরকে লাঞ্ছিত করে শত শত বছর ইংরেজ বেনিয়াদের গোলাম বানিয়ে রাখলেন। দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে তাদেরকে ভয়ানক জুলুম-নির্যাতনের মাধ্যমে শায়েস্তা করলেন। আহমদ শাহ আবদাল এলো, নাদের শাহ এলো। বাদশাহকে বলা হলোÑ‘জাহাপনা! শত্রæ আক্রমণ করতে আসছে। প্রায় দ্বারপ্রান্তে। নেশার ঘোরে উন্মাদ বাদশাহ উত্তরে বললোÑ‘আরে রাখো, এক পেয়ালা শরাব আওর দে দো।’ এরপর হাতের কাগজখÐটি শরাবের পেয়ালায় ডুবিয়ে রেখে আবার বললোÑ‘আরও এক গøাস দাও।’ পরিশেষে মন্ত্রীবর্গ নিজেরাই আগে বেড়ে নাদের শাহকে অভ্যর্থনা জানালেন। অনেক আদর-আপ্যায়নে তাকে রাজকীয় মেহমানের মর্যাদা দিলেন। যেহেতু শত্রæপক্ষের সঙ্গে মোকাবেলার শক্তি ও সাহস কোনোটাই ছিলো না তাদের, তাই নিরূপায় হয়ে তারা এ পথটিই বেছে নিলেন। নাদের শাহ বুঝতে পারলো, এ এক ষড়যন্ত্র। সঙ্গে সঙ্গে খাপ থেকে তরবারি বের করে দিল্লির স্বর্ণমসজিদের ফটকের ওপর বসে পড়লো। যাকে যেখানে পেতো, হত্যা করতে আরম্ভ করলো। শুরু হলো এক ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ। নির্বিচারে হত্যার ফলে যমুনা সেতুর ওপর লাশের স্তুপ দেখা গেলো। মৃতদেহের সংখ্যা বাড়ায় জলপ্রবাহ বন্ধ হয়ে গেলো প্রায়। নদীর জল লাশে লাশে একাকার হয়ে গেলো। দিল্লির অনেক জায়গায়ই মৃতদেহে ভরপুর। তখন বাকায়ি বংশের কিছু লোক গোপনে বাদশাহের দরবারে উপস্থিত হয়ে আরজ করলোÑ‘জাহাপনা! বাদশাহের সঙ্গে বাদশাহের লড়াই, নিরীহ প্রজাদের অপরাধ কোথায়? কেনো তাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে?’ এ কথা শুনে বাদশাহ এবার তাঁর তরবারি কোষবদ্ধ করলেন। অবসান ঘটালেন হত্যাযজ্ঞের এক ভয়ানক ট্রাজেডির। এরপর বাদশাহ তাঁর রাজসিংহাসনে আসন গ্রহণ করলেন। তখন থেকে পুরোনো শাসন ব্যবস্থায় এলো আমূল পরিবর্তন। শেষ হয়ে গেলো আগের সব রাজব্যবস্থা ও শাসননীতি। মহান রাব্বুল আলামিন দেখালেন, ইজ্জতঅলা কিভাবে বেইজ্জত হয়; হীন-দুর্বল ব্যক্তিরা কিভাবে শক্তিশালী ও সসম্মানী হয়। আর তাই তো মানুষ বহু যুবরাজ-শাহজাদাকে মানুষের কাছে হাত পাততে এবং দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ষে চাইতে দেখেছে। আহকামুল হাকিমিনের এ এক রহস্যময় করুণ লীলা। মানুষের জন্য এতে রয়েছে অনেক বড় শিক্ষা। হায় আফসোস, মানুষ যদি আজ তা অনুধাবন করতো। মহান রাব্বুল আলামিন ভারতের মুসলমানদেরকে তাদের অন্যায়-অসত্যের বিভোর নিদ্রা থেকে বহুবার জাগ্রত করেছেন। তাদের অশুভ পরিণতির সতর্ক-সঙ্কেত দিয়েছেন। এতোসবের পরও তারা তাদের নাফরমানি ও অপকীর্তির ঘুম থেকে এতোটুকুও সজাগ হয়নি। তবুও মহান রাব্বুল আলামিন তাদেরকে আবার সুযোগ দিয়েছেন। তাদের সে জমিদারি ও নবাবি বহাল রেখেছেন। কিন্তু পরিশেষে যখন তারা ক্ষমতা ও রাজত্বের নেশায় উন্মাদ হলো, আল্লাহর নেয়ামতের শোকর আদায়ের পরিবর্তে না শোকর করলো, পরজগতের জন্য পাথেয় সংগ্রহের পরিবর্তে দুনিয়া উপার্জনে আত্মহারা হলো, সৃষ্টিসেবার পরিবর্তে নিজের অন্যায় স্বার্থচরিতার্থ করতে ব্যাকুল হলো, আল্লাহর হুকুম পালনের পরিবর্তে তাঁর মর্জিবিরুদ্ধ এমন সব কার্যকলাপে মত্ত হলো, যা দেখে কাফের-মুশরিক এমনকি শয়তানও লজ্জায় হার মানতোÑতখন আল্লাহ তায়ালা তাদের থেকে তাঁর দেয়া নেয়ামত ছিনিয়ে নিলেন, তাদের জমিদারি শেষ করলেন, নবাবি খতম করলেন। শেষপর্যন্ত মানুষ বহু নবাব-জমিদারকে দেখেছে জীবিকার তাগিদে পথে পথে ঘুরতে, মানুষের কাছে ভিক্ষে চাইতে। আর অভিজ্ঞতায়ও প্রমাণ, এককালের বড় বড় জমিদার, বিরাট বিরাট নবাব রাস্তার ফকির হয়ে কোনোদিন হয়তো একমুঠো ভাত কিংবা একটুকরো পরনের কাপড়ও জোটাতে পারেনি। আফসোস, এতোকিছুর পরও আজ মুসলিমজাতি সামান্যতম শিক্ষা গ্রহণ করে না। তারা কখনও চিন্তা করে না, আজকের শতো বিপর্যয়, বালা-মসিবত, বিপদাপদ কেনো হচ্ছে? কী কর্তব্য আমাদের? কী করা উচিৎ আমাদের? জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যই বা কি? কেনো আল্লাহতায়ালা নেয়ামত দিয়েও ছিনিয়ে নিচ্ছেন। এ সবকিছু অনুধাবন করে আমাদের জীবনের গতিধারার কোনোই পরিবর্তন নেই। আমাদের রাজত্ব ও নবাবি শেষ হয়েছে ঠিক, কিন্তু মন-মানসিকতা, চিন্তাধারা ও কাজে-কর্মে এখনও তার প্রভাব-প্রতিফলন রয়ে গেছে। ফলে সেই উদাসীনতা, আরামপ্রিয়তা, প্রতারণা-প্রবঞ্চনা, দম্ভ-অহঙ্কার, অন্যায়-নাফরমানি, জুলুম-অবিচার, কাজে-কর্মে অজ্ঞতা ও অক্ষমতা, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতি অনীহা, বাণিজ্যনীতিতে অনভিজ্ঞতা, পরস্পরে হিংসা-বিদ্বেষ, মামলা-মুকাদ্দমা, সুদ-ঘুষ, যশ-খ্যাতির লালসা, অন্যায় স্বার্থ চরিতার্থ করা, কামপ্রবৃত্তি, আমানতের খোয়নত, অন্যের মাল আত্মসাৎ, বড়ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই, শক্তির প্রতিযোগিতা, শিরক-বিদাত, শরিয়তগর্হিত রুসুম-রেওয়াজ, ইত্যাদি হাজারো প্রকারের আত্মিক ব্যাধিতে আজ আমরা আক্রান্ত।
অবাক লাগে, এসব অপকর্ম সাধনে কারও যদি প্রচুর অর্থসম্পদ না থাকে, তাহলে সে সুদ দিয়ে হলেও ঋণ নেয়; নতুবা ঘরবাড়ি, জায়গা-জমি কিংবা স্ত্রীর অলঙ্কার অবধি বন্ধক রাখে, তবুও সে তার এ অন্যায় কাজের মিশন চালু রাখে। পরিশেষে সব খুইয়ে যখন একেবারে নিঃস্ব হয়ে যায়, তখন নিরূপায় হয়ে জীবিকার সন্ধানে বেরোয়। কিন্তু আয়-রোজগার করার মতো তেমন কোনো কাজও জানা থাকে না। কর্মপন্থায় অনভিজ্ঞ। ফলে আয়-রোজগারের কোনো সম্মানজনক কর্মব্যবস্থা তার ভাগ্যে জোটে না। শেষতক জীবন বাঁচানোর তাগিদে নেহাৎ তুচ্ছ এক অপমানজনক খাটুনি খেটে কিংবা ভিক্ষেবৃত্তি করে জীবন নির্বাহ করে। এ হলো আল্লাহর নাফরমানির করুণ পরিণতি। এককালের নেহাৎ তুচ্ছ, অসহায়-দরিদ্র মানুষের দ্বারে আজ ভিক্ষে চাইছে তৎকালের সম্ভ্রান্ত ও ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গ। খুব আক্ষেপের বিষয়, এতোকিছুর পরও মুসলিমজাতির চোখ খোলেনি আজও পর্যন্ত। জানি নাÑএ চোখ খুলবে কবে? তবে কি মুসলিমজাতি সময়ে-অসময়ে ঘটা আপদবিপদের চেয়েও বড় কোনো মহাপ্রলয়ের অপেক্ষায়! বিবেকবানের ভেবে দেখা দরকার। প্রয়োজন আবার জেগে ওঠার। একটু চোখ মেলে দেখা চাই কি হচ্ছে এই পৃথিবীতে? কেনো হচ্ছে? কি-ই-বা তার প্রতিকার? এর থেকে মুক্তির উপায় কি? মাথা খাটানো দরকার খুব খুব করে। অন্যথায় এক ভয়ানক পরিণতি কিংবা এক মহাপ্রলয়ের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে রাখতে হবে। সেটা অবশ্যি বেশি দূরে নয়, অনেকাংশেই আসন্ন প্রায়। তখন সমাজের এই বিবেকবান ও জ্ঞানী ব্যক্তিরাই হবে কিন্তু তার জন্য সর্বাধিক দায়ী।
লেখক : শিক্ষক, ফতোয়া ও আরবি সাহিত্য
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।