প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর প্রশ্নপত্রও ফাঁস! তাহলে আর বাকী থাকলো কী! বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পরীক্ষাসহ বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। বিসিএস থেকে নানা চাকরির পরীক্ষায়ও প্রশ্নপত্র ফাঁস কোনো নতুন ঘটনা নয়। এইচএসসি, এসএসসি, জেএসসি ও পিইসি পরীক্ষায় প্রতি বছরই প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে। বাকী ছিল প্রাথমিক পর্যায়ের বার্ষিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা। সেটাও সম্প্রতি ঘটেছে। বরগুনা ও বেতাগী উপজেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বার্ষিক পরীক্ষার প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। চতুর্থ শ্রেণীর প্রশ্নপত্রও ফাঁস হয়েছে। এ কারণে ৩৯৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। আর রাজশাহীর বাঘায় চতুর্থ শ্রেণীর প্রশ্নপত্র সকালেই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে যায়। পরে বিকেলে পরীক্ষা শুরুর পর দেখা যায়, সকালে ফাঁস হওয়া প্রশ্নের সঙ্গে হুবহু মিলে গেছে মূল প্রশ্নপত্র। এই সব সাক্ষ্য-প্রমাণ এবং নজির ও দৃষ্টান্ত থেকে একথা এখন নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, যেখানে পরীক্ষা সেখানেই প্রশ্নপত্র ফাঁস। যেন পরীক্ষার অপরিহার্য বান্ধব হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রশ্নপত্র ফাঁস। প্রশ্নপত্র ফাঁসের এই অপ্রতিরোধ্য সয়লাবে পরীক্ষা অকেজো খুড়কুটোর মতো ভেসে যেতে বসেছে। পরীক্ষা মেধা যাচাইয়ের মাধ্যম। প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারণে সেই মেধা যাচাইয়ের মাধ্যম অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এক সময় পরীক্ষায় বেপরোয়াভাবে নকল হতো। পরীক্ষা ব্যবস্থার প্রতি সেটা ছিল বিরাট হুমকি। এখন নকল ব্যতিক্রম ছাড়া খুব একটা হতে দেখা যায় না। নকলের স্থান দখল করেছে প্রশ্নপত্র ফাঁস। বলা বাহুল্য, প্রশ্নপত্র যখন পরীক্ষার আগেই ফাঁস হয়ে যায় এবং পরীক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে যায়, তখন নকলের আর কোনো প্রয়োজন থাকে না। প্রশ্নপত্র ফাঁসের 

‘সংস্কৃতির’ যদি অবসান না ঘটে, তবে পরীক্ষা কেবল অপ্রয়োজনীয় বলেই সাব্যস্ত হবে না, শিক্ষা ব্যবস্থা ও শিক্ষার্থীদেরও সর্বনাশ হয়ে যাবে।
শুরুতেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হলে বর্তমান পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারতো না। দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ও বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় যখনই প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ উঠেছে, তখনই কর্তৃপক্ষীয় পর্যায় থেকে প্রথমেই তা অস্বীকার করা হয়েছে। ঢাকা দেয়ার চেষ্টা হয়েছে। অভিযোগ যখন হাতেনাতে প্রমাণিত হয়েছে তখন গঠন করা হয়েছে তদন্ত কমিটি। কিন্তুু তদন্ত কমিটির রির্পোট আর প্রকাশিত হয়নি। এক সময় সব তামাদি হয়ে গেছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও কর্তৃপক্ষ যদি এহেন আচরণ না করতো, উপযুক্ত তদন্তের মাধ্যমে দোষী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতো তাহলে পরিস্থিতি এতটা নাজুক হয়ে পড়তো না, সর্বব্যাপী বিস্তার ঘটার ফলে এর বরং সংকোচন ঘটতো। বিষয়টি এখন এমন এক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যে, ড্রাস্টিক এ্যাকশন ছাড়া উপায় নেই। কারা প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত, এটা খুবই প্রাসঙ্গিক ও যৌক্তিক প্রশ্ন। এর জবাবে বলা যায়, পরীক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, যার মধ্যে শিক্ষক, ছাত্র, পরীক্ষা গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষের শোকজন, প্রশ্নপত্র তৈরির সঙ্গে যুক্ত ও তা ছাপার সঙ্গে সংযুক্ত ব্যক্তিরা এর জন্য দায়ী। সবাই নয়, অসৎ ও দুর্নীতিবাজ অংশটিই দায়ী। শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ এ জন্য একশ্রেণীর শিক্ষকের প্রতিই অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন। বলেছেন, শিক্ষকরাই কোচিংয়ের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে। আর দুদকের তরফে বলা হয়েছে, শুধু শিক্ষক নয়, অবৈধ অর্থের বিনিময়ে কিছু দুর্নীতিপরায়ণ সরকারী কর্মকর্তাও এ অপরাধে জড়িত। কিছুদিন আগে প্রকাশিত এক খবরে জানা গেছে, বিজি প্রেসের কর্মীদের কেউ কেউ এ কাজে জড়িত। অন্যদিকে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে আইন-শৃংখলাবাহিনী সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩জনকে আটক করেছে। অনেকের অভিযোগ, বিভিন্ন সংঘবদ্ধ চক্র প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত।
সন্দেহে নেই, প্রশ্নপত্র ফাঁস গোটা শিক্ষা ব্যবস্থার জন্যই ফাঁস হয়ে দেখা দিয়েছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে শিক্ষা ব্যবস্থাই রসাতলে যাবে না, লেখাপড়া ও মেধা যাচাইও শিকেই উঠবে। জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত ও অযোগ্য ব্যক্তিদের সংখ্যা বাড়বে। এহেন আশঙ্কার প্রেক্ষিতে যে কোনো মূল্যে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সংস্কৃতিকে রুখতে হবে। দুদক প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ শিক্ষাক্ষেত্রে অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রতিরোধে ৩৯ দফা সুপারিশ পেশ করেছে। শিক্ষামন্ত্রী এই সুপারিশ সম্বলিত প্রতিবেদন সম্পর্কে বলেছেন, দুর্নীতি দমন কমিশনের এই প্রতিবেদন সময়োপযোগী। আমরা খুশি, কারণ এর অধিকাংশ সুপারিশই আমাদের নজরে রয়েছে। এই সমস্যাগুলো আমরা দুর্নীতি দমন কমিশনকে সাথে নিয়ে যৌথভাবে দূর করবো। আমরা সঙ্গতকারণেই আশা করি, সমস্যাদি দূর করার জন্য দুদক যে সব সুপারিশ করছে তা যতদ্রæত সম্ভব বাস্তবায়ন করা হবে।