হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
তৈমূর আলম খন্দকার
১৮৩৮ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ পার্লামেন্টে গৃহীত ৯২টি আইন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ঞযব ইধহমষধফবংয খধংি (জবারংরড়হ ধহফ উবপষধৎধঃরড়হ) অপঃ’ ১৯৭৩ প্রণয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশে চলমান আইন হিসেবে বৈধতা দিয়েছে। অনুরূপভাবে পাকিস্তান পার্লামেন্টে অনুমোদিত ২৫৪টি আইন উক্ত আইনে (১৯৭৩ ইং) বাংলাদেশের আইন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
প্রশাসনিক অবকাঠামো, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণসহ ব্রিটিশ ও পাকিস্তান যে কায়দায় এ দেশের অধিবাসীদের নিয়ন্ত্রণ করতো সে পদ্ধতির কোন প্রকার পরিবর্তন বা সংশোধন স্বাধীন দেশের সরকার করেনি। স্বদেশী আন্দোলনকে প্রতিরোধ করার জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ঞযব ঊীঢ়ষড়ংরাব ঝঁনঃধহপবং অপঃ- ১৯০৮ পাস হয়। কিন্তু ব্রিটিশের সে আইন এখন ব্যবহৃত হচ্ছে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে প্রতিহত করার জন্য। ওই আইনের তিন ধারায় বলা হয়েছে যে, অহু চবৎংড়হ অর্থাৎ সুনির্দিষ্টভাবে বলতে হবে যে, ‘কোন ব্যক্তি’ অর্থাৎ যিনি বিস্ফোরণ ঘটাবেন তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগে মামলা করতে হবে এবং হাতে নাতে ধরা পড়লে (আইনের ধারা ৬ক মোতাবেক) ৭ দিনের মধ্যে এবং ধরা না পড়লে ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। কিন্তু বাস্তবে এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়াই যতজন খুশী তত জনকে আসামী এবং ফৌজধারী কার্যবিধির ১৭৩ ধারা মোতাবেক চার্জশিট বা তদন্ত প্রতিবেদনের জন্য মাসের পর মাস, বছরের পর বছর বিচার প্রার্থীকে কারাগারে অপেক্ষা করতে হয়। আইনের যত ত্রæটি-বিচ্যুতি থাকুক না কেন ম্যাজিস্ট্রেট ও শেসন কোর্ট (জেলা জজ পর্যন্ত) রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের জামিন দিতে অনীহা প্রকাশ করে। পূর্বে রাজনৈতিক মামলা ছিল জামিনের কারণ (এজঙটঘউ), কিন্তু বর্তমানে তা-ই জামিন না দেয়াসহ সইমোহর নকল সরবরাহে বিলম্বিত করার মূল কারণ। এ সকল কারণেই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে। বিচার বিভাগে কর্মরত উচ্চপর্যায়ের বিচারকগণ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নেই বলে মন্তব্য করেছেন। বিচারকদের বিবেক, চেতনা ও মানসিকতা যখন পর্যন্ত বিকশিত না হবে ততদিন পর্যন্ত মাজদার হোসেন মামলার মত শত নির্দেশনামূলক রায় দিয়েও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা যাবে না।
‘বাংলাদেশ উন্নয়নের মডেল’, এ বক্তব্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সরকার জনগণের মনে আস্থা ফিরিয়ে আনতে মরিয়া হয়ে উঠে পড়ে লেগেছে। সরকার জানে যে, তারা অনির্বাচিত। এক ব্যক্তির শাসন ও রাজতন্ত্রের মধ্যে প্রয়োগগত কোন তফাৎ নেই এটাই প্রমাণিত হচ্ছে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে। যারা সরকারি ঘরনার তাদের সুখ-শান্তির কোনো অভাব নেই, অন্যদিকে যারা বিরোধী তারা নির্যাতিত হচ্ছে চতুর্দিক থেকে। মাইর (আঘাত) এবং মামলা দু’টাই তাদের কপালে। মফস্বল পর্যায়ে সকল প্রশাসনিক কাজ, থানা-পুলিশ নিয়ন্ত্রণ সবই এমপিদের হাতে। ন্যায়-বিচার পাওয়ার নিশ্চয়তা জেলা পর্যায়ে কোথাও নেই। হাইকোর্ট ও অ্যাপিলেট ডিভিশনে নিঃশ্বাস নেয়ার আবস্থান থাকলেও সেখানে পর্যন্ত পৌঁছতে পারে কতজন?
রাজধানী, বিভাগ, জেলা, শহর, থানা, ইউনিয়ন পর্যায়ে কোথাও বিরোধীদলের লোকদের সমবেত হওয়ার সুযোগ নেই। একদিকে পুলিশী হামলা, অন্যদিকে দলীয় সন্ত্রাসীদের হামলা সরকার বিরোধীদের তটস্থ করে রেখেছে। সম্প্রতি রূপগঞ্জ উপজেলার তারাবো পৌরসভাস্থ যাত্রামূড়া গ্রামে নারায়ণগঞ্জ জেলা ওলেমা দলের আয়োজনে তারেক রহমানের জন্মদিন উপলক্ষে দোয়া অনুষ্ঠানে যুবলীগ/ছাত্রলীগ দলীয় শ্লোগান সমেত হামলা চালিয়ে ব্যানার ফেস্টুনসহ সভামঞ্চ তছনছ করে দিয়ে যায়। আয়োজকরা থানায় মামলা দেয়নি এ কারণে যে, হামলা যেমন স্থানীয় দলীয় নেতাদের নির্দেশে হয়েছে, অন্যদিকে থানাও তাদের নির্দেশে চলে। ফলে নির্দেশদাতার নিকট বিচার চাওয়ার আস্থা জনগণ হারিয়ে ফেলেছে। এ অবস্থা শুধু রূপগঞ্জের নয় দেশের সর্বত্র। চট্টগ্রাম লালদিঘী ময়দানে প্রধানমন্ত্রী এক সময় বলেছিলেন যে, একটা লাশ পড়লে ১০টা লাশ পড়বে। এখন তিনি বলছেন যে, ইতিহাস বিকৃতকারীদের (!) ক্ষমতায় আসতে দেয়া হবে না। যদি তাই হয় তবে কোটি কোটি টাকা অপচয়ের প্রয়োজন কেন? অনির্বাচিত হয়েই তো দেশ শাসন করা যায়। একদিকে সরকার বলছে, নির্বাচন করবে নির্বাচন কমিশন, অন্যদিকে বলছে কাউকে কাউকে ক্ষমতায় আসতে দেবে না। এটাই যদি হয় সরকারের কামনা ও বাসনা তবে জাতিকে আরেকটি একতরফা নির্বাচনের সাক্ষ্য দেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে, প্রেক্ষাপট এটাই বলে।
আমরা যদি সার্বিক বিষয় নিখুঁত পর্যালোচনা করি তবে এটাই প্রমাণিত হয় যে, আইনের খর্গহস্ত আদালতের মাধ্যমে ব্রিটিশ আমাদের উপর যে পদ্ধতিতে প্রয়োগ করেছে, পাকিস্তান যা করেছে, বাংলাদেশ সরকার তার ব্যতিক্রম কিছু করছে না। তফাৎ এটুকু যে, ব্রিটিশের পর পাঞ্জাবীরা যা করতো তা এখন বাঙ্গালী শাসকরা বাঙ্গালীদের উপর করছে শুধুমাত্র ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য। স্বাধীনতার অর্থ যদি অধিকার আদায় বা অধিকার ভোগ করার নিশ্চয়তার প্রতিধ্বনি হয়ে থাকে তবে স্বাধীনতার মর্মার্থ আজ প্রশ্নবিদ্ধ। অন্যদিকে সর্বসাধারণের অধিকার আদায়সহ সমঅধিকার ভোগ করা যদি এর মর্মার্থ হয়ে থাকে তবে সে অধিকার থেকে জাতি কি আজ বঞ্চিত নয়?
বাংলাদেশ সংবিধানের তৃতীয় ভাগে অনুচ্ছেদ ২৬ থেকে ৪৪ পর্যন্ত জনগণের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে। বাস্তব অর্থে জনগণ সে অধিকার থেকে বঞ্চিত। সংবিধানে চলাফেরা, সমাবেশ, সংগঠন, চিন্তা, বিবেক ও বাক-স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করা হলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। এ সকল স্বাধীনতা চলে গেছে এখন পুলিশের ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর, ব্যতিক্রম এটুকু যে, ব্রিটিশ আমলে আমাদের সংবিধান ছিল না, বর্তমানে আছে। কাগজ-কলমে সংবিধান যাই হোক না কেন বাস্তবে তা সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রিত। জনগণের অধিকার হিসেবে নয়, সরকার দয়া করে সাংবিধানিক অধিকার জনগণকে যতটুকু ভোগ করতে দিচ্ছে তারা ততটুকুই ভোগ করছে।
চর্ম চোখে স্বাধীনতার অবয়ব প্রদর্শিত হলেও স্বাধীনতার স্বার্থকতা তখনই হবে যখন দেশের সাধারণ জনগণ [যারা সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭ক (১) মোতাবেক এই রাষ্ট্রের মালিক] বুঝতে পারবে যে, অধিকার ভোগের প্রশ্নে তারা স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক। ওই অনুচ্ছেদে [৭ক (১)] বলা হয়েছে যে, ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং জনগণের পক্ষে ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে’ অথচ এ মহান সংবিধানই আজ নিয়ন্ত্রিত। সংবিধানকে নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে সাংবিধানিক অধিকার ভোগ থেকে জনগণকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। স্বাধীনতার স্বাদ মানুষ ভোগ করতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না স্বাধীনতার চেতনার সার্বিক বিকাশ ঘটবে। এখনো সরকার দ্বারা মানুষ শোষিত, বঞ্চিত, নির্যাতিত ও নিপীড়িত যার অবসানের জন্য দেশবাসী একটি সার্বভৌম স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য সংগ্রাম ও যুদ্ধ করেছিল। গণতন্ত্র যেভাবে ‘নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রে’ পরিণত হয়েছে তা কি দেশবাসীর কাম্য ছিলো?
লেখক: কলামিস্ট ও বিএনপি’র চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।