হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
শিল্পখাতে তৈরি পোশাক শিল্প একটি ইতিহাস। দেশে আজও এই খাত বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনে শীর্ষ স্থান দখল করে রেখেছে। বাংলাদেশে পণ্য রপ্তানি আয়ের এখনও ৮০ শতাংশের অধিক আসে শুধু তৈরি পোশাক শিল্প খাত থেকে। তৈরি পোশাক শিল্পের এই সম্ভাবনাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। বিকল্প এখনও কোন নতুন খাত তৈরি হয়নি যা এই খাতের স্থলাভিষিক্ত হতে পারে। এক সময় পাট আমাদের রপ্তানির প্রধান পণ্য ছিল। তখন দ্বিতীয় রপ্তানি পণ্য ছিল চামড়া। বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে দ্বিতীয় স্থান দখল করেছে জনশক্তি রপ্তানি।
চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) রপ্তানি আয় দাঁড়িয়েছে ৬৬২ কোটি ৮৬ লাখ ডলার। এর আগের অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ৫৮২ কোটি ২৯ লাখ ডলার। অর্থাৎ রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৩ দশমিক ৮৪ শতাংশ। গত দুই মাসে রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬১৪ কোটি ডলার। এ সময়ে রপ্তানি আয় লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে ৭ দশমিক ৯৬ শতাংশ। এদিকে অর্থ বছরের দুই মাসে পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ। সা¤প্রতিক সময়ে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) প্রকাশিত হালনাগাদ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। যা আমাদের উদ্দীপ্ত করেছে।
ইপিবির প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রপ্তানি আয় হয়েছিল ৩ হাজার ৪৬৫ কোটি ৫৯ লাখ ডলার। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ হাজার ৭৫০ কোটি ডলার। এর মধ্যে অর্থ বছরের জুলাই-আগস্ট মাসে ৫৫২ কোটি ৪২ লাখ মার্কিন ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। তার আগের অর্থ বছরের একই সময়ে ৪৮৪ কোটি ৩৮ লাখ ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছিল। গত বছরের তুলনায় পোশাক রপ্তানিতে ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে।
বেশ কয়েক বছরে বিভিন্ন কারণে সক্ষমতা হারিয়ে প্রায় এক হাজার ২০০টি পোশাক প্রস্তুতকারী কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বিশেষ করে অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের পরিদর্শনের পর কিছু কারখানা আংশিক, সাময়িক ও পূর্ণাঙ্গভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যাংক ঋণ ও বাড়ি ভাড়াসহ অন্যান্য ব্যয় মিটিয়ে অনেকের পক্ষে এ ব্যবসা টিকিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। অবকাঠামোগত নানা সমস্যা মোকাবিলা করেও আমাদের পোশাক রপ্তানির আয়ে প্রবৃদ্ধি ও লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক দিক। এখনো পোশাক তৈরির উপকরণ বোঝাই জাহাজকে পণ্য খালাসের জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হচ্ছে, পণ্য খালাস করতে না পারায় কন্টেইনার ভাড়া বাবদ বন্দর ও জাহাজ কোম্পানিকে অতিরিক্ত জরিমানা প্রদান করতে হচ্ছে।
কম দামে পোশাক তৈরির জন্য বাংলাদেশের সুনাম বেশ পুরনো। সে জন্যই বিভিন্ন দেশের ক্রেতাদের কাছে আগামী পাঁচ বছর পোশাক সরবরাহে বাংলাদেশই পছন্দের শীর্ষে থাকছে। এর পরের অবস্থানে থাকবে ইথিওপিয়া, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম ও ভারত। বিশ্ববাজারে সর্বোচ্চ পোশাক রপ্তানিকারক দেশ চীনের পোশাক রপ্তানি ইতোমধ্যে কমতে শুরু করেছে। বিশ্বখ্যাত ব্যবস্থাপনা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ম্যাককেনজি অ্যান্ড কোম্পানির ‘দ্য অ্যাপারেল সোর্সিং ক্যারাভ্যানস নেক্সট স্টপ: ভিজিটাইজেশন’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এমন তথ্যই উঠে এসেছে। আগামী পাঁচ বছরে পোশাক সরবরাহের পছন্দের শীর্ষে কোন তিন দেশ থাকবে- এমন প্রশ্নের জবাবে এবার প্রায় অর্ধেক ব্র্যান্ড ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের প্রধান কর্মকর্তা (সিপিও) বাংলাদেশের নামই বলেছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নে সর্বোচ্চ ডেনিম বা জিন্স পণ্য সরবরাহকারী দেশ হিসেবে স্থান করে নিয়েছে বাংলাদেশ। ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ২৮ জাতির বøকই ইউর মোট ডেনিম পণ্য আমদানির ২১ দশমিক ১৮ শতাংশ বাংলাদেশ একাই রপ্তানি করেছে। শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা পাওয়ায় চীনের বাজারে ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি ১৪ দশমিক ৭৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৩৯১ দশমিক ৫৯ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
আন্তর্জাতিক পোশাক বাজারে ক্রেতাদের ধরে রাখতে কয়েকটি কাজ জরুরিভাবে করা দরকার। বাংলাদেশের পোশাক প্রস্তুতকারীরা প্রতিনিয়ত লিডটাইমে মার খাচ্ছেন। সে জন্য গভীর সমুদ্রবন্দর যত দ্রæত সম্ভব নির্মাণ করা দরকার। এ ছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি, গ্যাস বিদ্যুতের সংকটের সমাধান, রেলে পণ্য পরিবহন নিশ্চিত ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানজট দূর করতে হবে। একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, বিশ্ববাজারে ক্রেতাদের পছন্দের পোশাক সরবরাহকারী দেশের মধ্যে পরিবর্তন আসছে। তবে বাংলাদেশের ওপর ক্রেতাদের দৃষ্টি বেশ ভালোভাবেই আছে। এতে করে চীন থেকে সরে আসা ক্রয়াদেশ নেওয়ার সুযোগ পাবেন আমাদের উদ্যোক্তারা। প্রাপ্ত সুযোগ কাজে লাগাতে হলে পোশাকশিল্প উদ্যোক্তাদের উৎপাদনক্ষমতা বাড়াতে হবে। এ ছাড়া রপ্তানির তালিকায় নতুন নতুন পোশাক পণ্য যুক্ত করতে হবে।
বর্তমানে তৈরি পেশাক শিল্পে অনেকগুলো সমস্যা বিরাজমান এই সকল সমস্যা দ্রæত সমাধান করতে পারলে তৈরি পোশাক শিল্পের অগ্রযাত্রাকে ধরে রাখা সম্ভব হবে। এখানে ৫টি মৌলিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।
এক: গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ আমাদের রপ্তানি বৃদ্ধির স্বার্থে খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য ‘লিড টাইম’ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। গভীর সমুদ্র বন্দর না থাকার কারণে চট্টগ্রাম বন্দরে সব সময় জাহাজের জট লেগে থাকছে। তাতে তৈরি পোশাক শিল্পের আমদানি রপ্তানি ধারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সরকার গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। কিন্তু এই কাছের গতি খুবই ধীর। দেশের রপ্তানি বৃদ্ধির স্বার্থে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ খুবই জরুরি। অন্যান্য বড় প্রকল্পের মতো গভীর সমুদ্রে বন্দর নির্মাণ একটি বিশাল প্রকল্প। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ছাড়া কোনক্রমেই এটি সম্ভব নয়। তাই আন্তর্জাতিক সহযোগিতা নিয়ে দ্রæত সরকারকে চট্টগ্রামে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের কাজে এগিয়ে আসা প্রয়োজন।
দুই: চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়টি অনেক দিন ধরে নানা মহলে আলোচিত হচ্ছে। কিছু কিছু উদ্যোগ চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে নিয়েছে। কিন্তু প্রয়োজন অনুযায়ী এখনও চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়নি। দেশ উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হলে চট্টগ্রাম বন্দরসহ সকল স্থল, নৌবন্দর ও বিমান বন্দরের সক্ষমতা দ্বিগুণ করতে হবে। বিষয়টি নিয়ে সরকারকে দ্রæত কাজ করতে হবে। ইতোমধ্যে বেশ বিলম্ব হয়ে গিয়েছে।
তিন: গ্যাস-বিদ্যুতসহ জ্বালানি খাতের উৎপাদন ও সরবরাহ সমস্যার কারণে দেশের অর্থনীতিতে গতি আশানুরূপ করা যাচ্ছে না। আমাদের দেশে সকল বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান গ্যাসের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। গ্যাস থেকে সরাসরি বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে বড় শিল্প ইউনিট সার্বক্ষণিক উৎপাদন চালিয়ে আসছে। বিগত ১০ বছর ধরে গ্যাসের চাহিদা মোতাবেক সরবরাহ নেই বলে শিল্পবিকাশ থেমে গেছে। অন্যদিকে দেশে বিদ্যুতও চাহিদা মোতাবেক উৎপাদন করা যাচ্ছে না। তাই বিদ্যুৎভিত্তিক শিল্প স্থাপনের গতিও বেশ ধীর। এই দুই খাতের উৎপাদন দ্বিগুণ করতে হবে। সরকার নানাভাবে চেষ্টা করছে। বিদ্যুৎ আমদানি করেও সমস্যার সমাধান মিলছে না।
সরকারকে সমুদ্রে ও স্থলে গ্যাস কূপ খনন উদ্যোগ দ্রæত বাড়াতে হবে। আমদানি করে গ্যাস দিয়ে শিল্প স্থাপন করা যাবে না। আমাদের গ্যাসের মজুত কত সেটাও জানা নেই। তা জানা খুবই দরকার। গ্যাসক্ষেত্র বাড়াতে হবে। নতুন নতুন কূপ খনন করতে হবে। পেট্রোবাংলাকে গ্যাস উত্তোলনে ও বিতরণে বড় আকারে বাজেট নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষ করে স›দ্বীপসহ দেশের বিভিন্ন দ্বীপে গ্যাসের অনুসন্ধান চালানো খুবই প্রয়োজন। এতে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। যেমন ভোলায় গ্যাস পাওয়া গিয়েছে।
চার: রেলে পণ্য পরিবহন নিশ্চিত করার জন্য দ্রæত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আমাদের রেল ব্যবস্থা আধুনিক ও স¤প্রসারণ করতে হবে। রেল ভ্রমণ ও মালামাল পরিবহন খুবই আরামদায়ক, ঝুঁকিমুক্ত ও ব্যয় কম। কিন্তু রেল পথ অত্যন্ত কম। প্রয়োজনের তুলনায় আমরা রেলের স¤প্রসারণ করতে পারিনি। আগামীতে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে হলে শিল্পবিকাশ ছাড়া কোন উপায় নেই। রেলকে তাই আধুনিক ও স¤প্রসারণ করা শিল্প বিকাশের স্বার্থে খুবই জরুরি। সরকার এখন পর্যন্ত রেলের স¤প্রসারণ করার জন্য বড় বড় প্রকল্প হাতে নেয়নি। কিছু কিছু স¤প্রসারণ কাজ চলেছে। তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। সারাদেশকে আধুনিক রেলের আওতায় আনতে হবে।
পাঁচ: ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। একদিন কোনক্রমে ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়ক অচল হলে দেশের অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ে। এই মহাসড়কের উন্নতির উপর দেশের অর্থনীতির চাকা সচল কি অচল থাকবে তা নির্ভর করে। বর্তমানে মহাসড়কে যানজট সব সময় লেগে থাকে। তাতে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা আসতে রাস্তায় চার ঘণ্টার স্থলে বার ঘণ্টা সময় ব্যয় হচ্ছে। তাতে অতিরিক্ত ভাড়াও দিতে হয়। যার ফলে রপ্তানি খরচ বৃদ্ধি পায়।
এখনও তৈরি পোশাক শিল্প তথা আমাদের বস্ত্রখাত একান্তই সম্ভাবনাময় রপ্তানিমুখি খাত। এই খাতের উন্নতি আরও বেশি বেশি করা প্রয়োজন। বিকল্প একাধিক রপ্তানিমুখি খাত না থাকাতে আমাদের পুরো অর্থনীতি এখনও এই খাতের উপর নির্ভরশীল রয়েছে। এ ক্ষেত্রেও যত দ্রæত সম্ভব বিকল্প খাতের সন্ধান করতে হবে।
লেখক: সাবেক সহ সভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমএ, বিজেএমইএ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।