Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রুশ বিপ্লব ও কাজী নজরুল

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ২৪ নভেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

১৯১৭ সাল। নভেম্বর মাস। রাশিয়ায় বিপ্লবের মধ্য দিয়ে পতন ঘটে রাজতন্ত্রের। প্রতিষ্ঠিত হয় কৃষক-শ্রমিকের রাষ্ট্র। জনগণের হাতে আসে ক্ষমতা। সেই হিসাবে এ বছরের অক্টোবর মাসে পূর্ণ হলো রুশ বিপ্লবের শতবর্ষ। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই বিপ্লবের সফলতা সে-সময় বিশ্বের সব স্বাধীনতাকামী জনগণের ওপর অভাবনীয় প্রভাব বিস্তার করেছিল। এমনকি, আলোচ্য বিপ্লব তৎকালীন পরাধীন ভারতবাসীর কাছেও দেখা দিয়েছিল আশার আলো হিসাবে। রুশ বিপ্লব প্রভাবিত করেছিল কাজি নজরুল ইসলামকেও। কবির পরবর্তী জীবন-পরিক্রমা ও সাহিত্যকর্মের দিকে নজর দিলে বিষয়টি বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
তবে প্রশ্ন হল, ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় যখন উড়ল সমাজতন্ত্রের লাল পতাকা, নজরুল সেটিকে কীভাবে গ্রহণ করেছিলেন? বইপত্র ও নজরুলের ঘনিষ্ঠজনদের স্মৃতিকথা মিলিয়ে দেখলে প্রশ্নটির একটা সুরাহা মিলতে পারে। ১৯১৭ সালের শেষার্ধে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে করাচি চলে যান কাজি নজরুল ইসলাম। সে-সময় তিনি আঠারো-উনিশ বছরের এক টগবগে তরুণ। কবি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠার আগ অব্দি, অর্থাৎ ১৯২০-২১ সাল পর্যন্ত নজরুলের জীবনের অনেক বিষয় সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ তথা খুব নির্দিষ্ট ভনরতথ্য পাওয়া যায় না- একেকজন একেক রকম বলেন।
বস্তুত, বিপ্লবের সংবাদে আপ্লুতই হয়ে উঠেছিলেন সেদিনের তরুণ নজরুল। তিনি কতটা আপ্লুত হয়েছিলেন, সেটি কবির পল্টন জীবনের সহযোদ্ধা জমাদার শম্ভু রায়ের বর্ণনায় উজ্জ্বল হয়ে আছে, ‘একদিন সন্ধ্যায় ১৯১৭ সালের শেষের দিকেই হবে, এখন ঠিক স্মরণে আনতে পারছি না, হয়তো সেটা শীতের শেষের দিকে। নজরুল তাঁর বন্ধুদের মধ্যে যাঁদের বিশ্বাস করতেন, তাঁদের এক সন্ধ্যায় খাবার জন্য নিমন্ত্রণ করেন। ঐ দিন যখন সন্ধ্যার পর তাঁর ঘরে আমি ও নজরুলেরর অন্যতম বন্ধু তাঁর অর্গান মাস্টার হাবিলদার নিত্যানন্দ দে প্রবেশ করলাম, তখন দেখলাম, অন্যান্য দিনের চেয়ে নজরুলের চোখে মুখে একটা অন্যরকম জ্যোতি খেলে বেড়াচ্ছিল...তিনি (নিত্যানন্দ) অর্গানে একটা মার্চিং গৎ বাজানোর পর নজরুল সেই দিন যে গান গাইলেন ও প্রবন্ধ পড়লেন, তা থেকেই আমরা জানতে পালাম যে রাশিয়ার জনগণ জারের কবল থেকে মুক্তি পেয়েছে। গানবাজনা-প্রবন্ধ পাঠের পর রুশ বিপ্লব সম্বন্ধে আলোচনা হয় এবং লালফৌজের দেশপ্রেম নিয়ে নজরুল খুব উচ্ছ¡সিত হয়ে ওঠেন।
রুশ বিপ্লবের বিরুদ্ধে সা¤্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক শক্তির বহুমুখী আক্রমণ প্রতিহতের জন্য জনগণ ও কৃষক-শ্রমিকদের নিয়ে রাশিয়া গঠন করেছিল একটি সৈন্যদল, যাকে বলা হত লালফৌজ। বিভিন্ন দেশের মুক্তিকামী মেহনতি মানুষ এবং বুদ্ধিজীবীরাও যোগ দিয়েছিলেন এই লালফৌজে। ভারতের প্রগতিবাদী রাজনীতিবিদ এম এন রায়ের লেখা ও রাশিয়ায় সংরক্ষিত নথিপত্র থেকে জানা যায়, এ সময় ভারত থেকেও অনেকে যোগ দিয়েছিলেন ওই লালফৌজে। কেবল তাই নয়, রাশিয়ায় বিপ্লব দমনের জন্য নিয়োগকৃত ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ভারতীয় সেনাদল থেকে পালিয়েও অনেক ভারতীয় সৈনিক তখন যোগ দিয়েছিলেন এই বাহিনীতে। নজরুল এসব তথ্য জানতেন। তাঁর পল্টন থেকেও কয়েকজন সৈন্য পালিয়ে লালফৌজে যোগ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন বলে জানা যায়। তবে পলাতকদের অনেকেই লালফৌজ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেননি, পেশোয়ারের বিভিন্ন জায়গায় ধরা পড়েছিলেন তাঁরা। এ রকম এক সৈনিককে পল্টনে ফেরত নেওয়ার জন্য একবার পেশোয়ারে গিয়েছিলেন নজরুল। এ নিয়ে সৈনিক-পরবর্তী জীবনে কবির অন্যতম সুহৃদ ও ভারতের কমিউনিস্ট নেতা মুজাফ্ফর আহমদ লিখেছেন, ‘নজরুলের মুখে শুনেছি যে কোনো পলাতক সৈনিককে ধরার জন্যে তাকে (হয়তো সঙ্গে অন্য সৈনিকও ছিল) একবার বেলুচিস্তানের গুলিস্তান, বুস্তান ও চমন প্রভৃতি এলাকায় যেতে হয়েছিল।’
সেনাবাহিনীর কড়া বাধানিষেধ তথা সেন্সরশিপের ভেতরেও পল্টনে থাকাকালে নজরুল কীভাবে রুশ বিপ্লব ও লালফৌজের সংবাদ সংগ্রহ করতেন, তা বিস্ময়কর। শম্ভু রায়ও এ বিষয়ে কোনো আলোকপাত করতে পারেননি। তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘আমাদের ব্যারাকের কর্তৃপক্ষের শ্যেনদৃষ্টি ছিল, যাতে আমরা বাইরে থেকে কোনো রকম রাজনৈতিক খবর না পাই। সেজন্য পত্রপত্রিকা যা আসত তা পরীক্ষা করে আমাদের দেওয়া হত। তা সত্তে¡ও ‘বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরোর মতো হওয়ার দরুন ওসব খবরাখবর কী করে জোগাড় করত তা সেই (নজরুল) জানে।’
রাশিয়ার বিপ্লব ও লালফৌজের লড়াই নজরুলকে এতটাই নাড়া দিয়েছিল যে ঝুঁকি থাকা সত্তে¡ও পল্টনের সহযোদ্ধাদের সঙ্গে এই সংবাদগুলো নিয়ে আলোচনা করতেন তিনি। শম্ভু রায় আরও লিখেছেন, ‘নজরুলের আড্ডা থেকে বাছাই করা কয়েকজনকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সংবাদ দিতেন, যেমন আইরিশ বিদ্রোহ ও রুশদের কথা। আমরা কয়েক বন্ধু এসব বিষয় যেমন সাবধানতার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতাম, নজরুল তার ভাবকে তেমন করে চেপে রাখতে পারতেন না। অবশ্য তার একটা পথ ছিল, গান ও কবিতার সাহায্য, তিনি গান গেয়ে ও কবিতা পড়ে তার ভাবকে ব্যক্ত করতেন। (চলবে)



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন