Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সড়ক-মহাসড়কের বেহাল দশা

সম্পাদকীয়

| প্রকাশের সময় : ১৯ নভেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

সড়ক-মহাসড়কের দৈন্যদশা নতুন কিছু নয়। বছর জুড়েই বেহাল অবস্থায় থাকে। কেবল ঈদ এলেই এই দুরবস্থার চিত্রটি জোরোসোরে উঠে আসে। তখন মেরামতের তোড়জোড় শুরু হয়। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীও বহর নিয়ে বিভিন্ন সংস্কার কাজ পরিদর্শনে ব্যস্ত হয়ে উঠেন এবং বলেন, ঈদ যাত্রা নির্বাধ হবে। নির্বিঘে মানুষ ঘরে ফিরতে পারবে। ঈদ চলে যাওয়ার পর, সড়কগুলোর কী হাল হয়, তা নিয়ে আর কোনো মাথাব্যথা থাকে না। বিষয়টি এমন, সারা বছর সড়কের অবস্থা যেমনই থাকুক, ঈদে কোনোরকমে মানুষকে স্বাচ্ছন্দে ঘরে পৌঁছে দিতে পারলেই বিরাট দায়িত্ব পালন হয়ে গেল। এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সড়কের ভাঙাচোরা জায়গাগুলোতে ইট-বালু ফেলে এক ধরনের অস্থায়ী ব্যবস্থা করা হয়। তারপর এগুলো ভেঙ্গে গেল, না খানা-খন্দে রূপ লাভ করলো, তাতে কিছু যায় আসে না। সংস্কার কাজ যে থেমে থাকে তা নয়, সারাবছরই এ কাজ চলে। হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয়। অথচ সড়ক আর মেরামত হয় না। টাকা সড়কের গর্তেই পড়ে থাকে। সড়ক-মহাসড়ক সংস্কার নিয়ে সারা বছরই এক ধরনের আর্থিক লুটপাট চলে। সড়ক-মহাসড়কের কী দুর্দশা, তা এখন রাজধানী থেকে দেশের যে প্রান্তেই যাওয়া হোক না কেন, তার করুণচিত্র দেখতে পাওয়া যায়। পরিবহন ব্যবসায়ীদের মতে, স্বাধীনতার পর দেশের সড়ক-মহাসড়কের এমন বেহাল দশা কখনো দেখা যায়নি।

মহাসড়ক ব্যবস্থাপনা বিভাগ (এইচডিএম)-এর জরিপ মতে, সারাদেশে বিভিন্ন শ্রেণীর সড়কের দৈর্ঘ্য ২১ হাজার ৩০২ কিলোমিটার। এর মধ্যে জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কের দৈর্ঘ্য ৩ হাজার ৮১৩ কিলোমিটার এবং ৪ হাজার ২৪৭ কিলোমিটার। জেলা সড়কের দৈর্ঘ্য ১৩ হাজার ২৪২ কিলোমিটার। জরিপ মতে, জাতীয় সড়কের শতকরা ২০ ভাগ, আঞ্চলিক সড়কের ৩১ ভাগ এবং জেলা শহরের ৪৭ ভাগ সড়কই ভাঙাচোরা। উন্নয়নের জোয়ারের এ যুগে সড়ক-মহাসড়কের এই চিত্র যুগপৎভাবে বিস্ময়কর ও অনভিপ্রেত। উন্নয়নের অন্যতম শর্ত সড়ক-মহাসড়কের মসৃণতা এবং যাতায়াতের দ্রুততা। যদি সড়ক-মহাসড়কগুলো মসৃণ ও নির্বিঘœ হতো, তবে উন্নয়নের গ্রাফটি যে আরও উর্ধ্বমুখী হতো, তাতে সন্দেহ নেই। দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হচ্ছে, মেরামত ও সংস্কারে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হলেও সড়ক-মহাসড়কের কোনো উন্নতি নেই। সড়ক-মহাসড়কগুলো ভাঙাচোরা, বড় বড় গর্ত ও খানা-খন্দ ভরে উঠার কারণে প্রতিদিনই কিলোমিটার জুড়ে যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। ঘন্টার পর ঘন্টা আটকা পড়ে শ্রম, অর্থ ও জ্বালানির ক্ষতি হচ্ছে। নির্দিষ্ট সময়ে গন্তব্যে পৌঁছার বিষয়টি স্বপ্নের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের মতো নিম্ন মধ্য আয় থেকে মধ্য আয়ের দিকে ধাবিত হওয়া দেশের সড়ক-মহাসড়কের চিত্র যদি এই হয়, তবে কাক্সিক্ষত গন্তব্যে পৌঁছা যে সুদূরপরাহত তা বোধকরি ব্যাখ্যা করে বলার অবকাশ নেই। সড়ক-মহাসড়কের চিরায়ত বেহাল দশার উপর প্রায় প্রতিবছরই কোনো না কোনো অঞ্চলে বন্যা আরও ক্ষত সৃষ্টি করে যায়। উত্তরবঙ্গ ও দেশের মধ্যাঞ্চলে যে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়, তাতে সড়ক-মহাসড়কের যে ক্ষতি হয়, তা পুরোপুরি নিরূপণ করা সম্ভব না হলেও কয়েক হাজার কিলোমিটার যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। বন্যার ক্ষতি তো আছেই, তাছাড়া নিম্নমানের উপকরণ দিয়ে সড়ক নির্মাণও দুরবস্থার জন্য দায়ী। এর সাথে দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা একটি কঠিন রোগ হয়ে আছে। মহাসড়ক ব্যবস্থাপনার তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা সড়ক-মহাসড়ক বরাদ্দ করা হয়। সড়ক পরিবহন, মহাসড়ক বিভাগ এবং সওজ মিলে গত অর্থ বছরে ব্যয় করে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। চাহিদার কাছাকাছি অর্থ ব্যয় হয়ে গেলেও পুরোপুরি সংস্কার কাজ হয়নি। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, সংস্কার কাজে গাফিলতি, দুর্নীতি ও অনিয়ম ব্যাপক হারে হয়েছে। তা নাহলে পুরোপুরি সংস্কার হবে না কেন? দেশের জনগণের দুর্ভাগ্য, সংস্কারের নামে তাদের পয়সা নিয়ে একশ্রেণীর দুর্নীতিবাজ লুটেপুটে খাচ্ছে। নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করছে। অর্থের অপচয় ও দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে জনসাধারণকে। অর্থনীতির অন্যতম লাইফ লাইন হিসেবে পরিচিত যে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীত এবং ঘটা করে তা উদ্বোধন করা হলো, বছর না ঘুরতেই তার বিভিন্ন জায়গায় ক্ষত দেখা দিয়েছে। কোনো কোনো জায়গা বেহাল হয়ে পড়েছে। তাহলে এত অর্থ ব্যয় করে কী লাভ হলো! শুধু এই মহাসড়কই নয়, ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-টাঙ্গাইল, ঢাকা-সিলেটসহ দেশের প্রধান প্রধান মহাসড়কগুলোও একই দুরবস্থার মধ্যে নিপতিত হয়েছে। এ নিয়ে বিভিন্ন এলাকার সংসদ সদস্যরা পর্যন্ত অভিযোগ উত্থাপন করেছেন।
এ কথা অনস্বীকার্য, দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে মসৃন যোগাযোগ ব্যবস্থার বিকল্প নেই। যোগাযোগ ব্যবস্থা যত দ্রুত হবে, উন্নতিও তত বেগবান হবে। দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার সাথে যেসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগ রয়েছে, সড়ক-মহাসড়ক নির্বিঘœ ও সচল রাখার ক্ষেত্রে তাদের যথেষ্ট গাফিলতি রয়েছে। সংস্কারের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হলেও, তা টেকসই হচ্ছে না। সড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে আমাদের দেশে প্রতি কিলোমিটারে যত ব্যয় হয়, উন্নত দেশগুলোতেও এত ব্যয় হয় না। বলা হয়, উন্নত দেশগুলোর চেয়ে প্রতি কিলোমিটার সড়কে প্রায় দ্বিগুণ অর্থ আমাদের দেশে ব্যয় হয়। এর পেছনে যে দুর্নীতি ও অনিয়ম মূল নিয়ামক হয়ে রয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অর্থের এমন অপচয় ও লুটপাট আর কোথাও আছে কিনা, জানা নেই। সাধারণত সড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে এর উপকরণের টেকসইয়ের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। রোদ, বৃষ্টি ও বন্যার বিষয়টি মাথায় রেখে উপকরণের মান নির্ধারণ করা হয়। আমাদের দেশে যে মান নিয়ন্ত্রণের কোনো বালাই নেই, তা সড়ক-মহাসড়কের বেহাল অবস্থা দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না। এ অবস্থা বছরের পর বছর ধরে চলছে। সড়ক-মহাসড়কের সত্যিকারের উন্নয়ন ও টেকসই করতে হলে সবার আগে দুর্নীতি ও অনিয়ম রোধ করতে হবে। এলাকাভিত্তিকভাবে সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ ও সংস্কার কাজের সাথে যারা জড়িত, তাদের কাজের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। নির্মাণ ও সংস্কারের গ্যারান্টি থাকতে হবে। অর্থনীতিকে গতিশীল ও উন্নয়নের দিকে নিয়ে যেতে হলে সড়ক-মহাসড়কের চলাচল স্বাভাবিক ও সহজ করতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সড়ক-মহাসড়ক

২৮ এপ্রিল, ২০২২
৯ জানুয়ারি, ২০২২
২৪ নভেম্বর, ২০২০
১৯ নভেম্বর, ২০১৭
১৮ নভেম্বর, ২০১৭
২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

আরও
আরও পড়ুন