ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
আজ ১০ নভেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (এম এন লারমা)’র মৃত্যু বার্ষিকী। ১৯৮৩ সালের এই দিনে তিনি নিজ দলের বিদ্রোহী সশস্ত্র শাখার গুলিতে নিহত হয়েছিলেন। এই দিনটিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি সশস্ত্র সংগঠনের একটি অংশ জুম্মজাতির শোক দিবস হিসেবে পালন করে। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সকল নাগরিকদের কাছে জাতির পিতা ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব’ হলেও, উপজাতি সশস্ত্র সংগঠনের ঐ গ্রæপ দাবি করে এম এন লারমা তাদের জাতির পিতা। কিন্তু, তারা যাকে তাদের জাতির পিতা বলে মান্য করে ৩৪ বছর পার হয়ে গেলেও তারা তাদের সেই জাতির পিতার হত্যাকারীদের বিচার চায়নি কখনও। অথচ পার্বত্য চট্টগ্রামে যে কোন উপজাতি ব্যক্তি খুন হলে অথবা ছোটখাট অনেক বিষয় নিয়ে তারা দেশে-বিদেশে সরকার, সেনাবাহিনী এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাঙালিদের ঘাড়ে মিথ্যা দোষ চাপিয়ে নানান ধরনের প্রচার-প্রচারণা চালালেও নিজ জাতির পিতা বলে খ্যাত এত বড় একজন নেতার হত্যাকারী কারা, তিনি কেন মারা গিয়েছিলেন, হত্যাকারীরা এখন কোথায় কী অবস্থায় আছে এ বিষয়গুলো নিয়ে তারা কখনই দাবি বা আন্দোলন করেনি। উপজাতিদের এই নীরবতা জনমনে প্রশ্ন এবং সন্দেহের উদ্রেক সৃষ্টি করে।
ইতিহাসের ঘটনাবলী থেকে জানা যায় যে, এম এন লারমা পাহাড়ি ছাত্র সমিতির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের শিক্ষিত তরুণদের সংগঠিত করেন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। সাবেক সংসদ সদস্য মি. রোয়াজা ছিলেন উক্ত সংগঠনের সভাপতি এবং এম এন লারমা ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। ১৯৭০ সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক নির্বাচনে এম এন লারমা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনেও এম এন লারমা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি একটি খসড়া সংবিধান উপস্থাপন করেছিলেন। এম এন লারমা সংসদ সদস্য হিসেবে নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিচালনাকালে পাহাড়ি ছাত্র সমিতিসহ কতিপয় তরুণের সাথে তার ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। ১৯৭৩ সালে এম এন লারমা জনসংহতি সমিতির একটি সশস্ত্র গ্রæপ গঠন করেন, পরে তা শান্তিবাহিনী নামে পরিচিতি লাভ করে। ১৯৭৬ সালে ক্ষমতার লোভ, স্বার্থপরতা, দলীয় মতাদর্শসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে শান্তিবাহিনীর মধ্যে বিভক্তি দেখা দেয়। এ সময় এম এন লারমা চীনাপন্থী ও প্রীতি কুমার চাকমা ভারতপন্থী নীতি গ্রহণ করেন। ১৯৮১ সালে শান্তিবাহিনী সম্পূর্ণ রূপে দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই সময় দলীয় কোন্দল চরম আকার ধারণ করে যার ফলে নিজেদের মধ্যে মারামারি আর হানাহানিতে শান্তিবাহিনীর শতাধিক সদস্য নিহত হয়।
এই ঘটনার জের ধরেই ১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর আন্তঃদলীয় কোন্দল আর ক্ষমতার লোভের শিকার হিসেবে প্রতিপক্ষ প্রীতি গ্রæপের সশস্ত্র হামলায় নিহত হন এম এন লারমা। এ প্রসংগে ১৮ নভেম্বর ১৯৮৩ সালে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয় যে, ‘তথাকথিত শান্তিবাহিনীর প্রধান এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির চেয়ারম্যান মি. মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা নিহত হইয়াছেন। নির্ভরযোগ্য সূত্রের বরাত দিয়া গতকাল (বৃহস্পতিবার) রাত্রে আমাদের রাংগামাটি সংবাদদাতা জানান, মি. লারমা গত ১০ই নভেম্বর সীমান্তের অপর পারে ভারতে ইমারা গ্রামে বাগমারা নামক স্থানে শান্তিবাহিনীর কল্যাণপুর ক্যাম্পে প্রতিদ্ব›দ্বী শান্তিবাহিনীর প্রীতি গ্রæপের সদস্যদের হামলায় তিনি নিহত হইয়াছেন।’
বিভিন্ন তথ্য বিবরণী এবং ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, শান্তিবাহিনীর ক্যাপ্টেন এলিনের নেতৃত্বে প্রীতিগ্রæপের আট-দশজনের একটি সুইসাইডাল স্কোয়াড এম এন লারমা গ্রæপের শিবিরে সশস্ত্র অভিযান চালায়। উক্ত হামলায় মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সাথে তার বড় ভাইয়ের শ্যালক মনি চাকমা, খাগড়াছড়ি হাই স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক অপর্ণা চরম চাকমা, কল্যাণময় চাকমা ও স্বঘোষিত লেফটেনেন্ট রিপনসহ শান্তিবাহিনীর মোট আটজন সদস্য ঘটনাস্থলে প্রাণ হারান। ঘটনার পরপর প্রীতি কুমার চাকমা তার দলবল নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় এম এন লারমা গ্রæপের অন্যান্য সদস্যদেরকেও হত্যা করার জন্য খুঁজে বেড়াতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় ১০ নভেম্বর ১৯৮৩ সালে একই দিনে প্রীতি গ্রæপের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা খাগড়াছড়ির তৎকালীন লতিবান পুলিশ ক্যাম্পের এক মাইল পূর্বে এম এন লারমার মামার বাড়িতে অবস্থানরত শান্তিবাহিনীর সদস্যদের উপরও আক্রমণ চালায়। কিন্তু উক্ত আক্রমণে অবশ্য কেউ হতাহত হয়নি।
এম এন লারমার মৃত্যুর পর জনসংহতি সমিতির পূর্ণ নেতৃত্ব চলে যায় তার আপন ভাই সন্তু লারমার হাতে। যিনি বর্তমানে জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান। সন্তু লারমার পাশাপাশি বর্তমানে উল্লেখযোগ্য উপজাতি নেতার মধ্যে আছেন সাবেক শান্তিবাহিনী কমান্ডার ঊষাতন তালুকদার যিনি বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে একজন নির্বাচিত সাংসদ এবং জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য। এম এন লারমার মৃত্যুর ৩৪ বছর হয়ে গেলেও এ সকল নেতা কখনই তাদের অবিসংবাদিত নেতা এম এন লারমার হত্যার বিচার চায়নি।
১০ নভেম্বর উপলক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর একাংশ বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করে থাকে। কিন্তু তারা তাদের নতুন প্রজন্মের কাছে এই মৃত্যুর ইতিহাস চাপা রেখে শুধুমাত্র দিবসটিকে জুম্ম জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন করে। কারণ এই ঘটনার মধ্যে তাদের জাতিগত হিং¯্রতা আর বিভেদের চিত্র প্রকাশ পায়। তাই এই ঘটনা নতুন প্রজন্মের কাছে তারা কৌশলে গোপন করে রাখে। প্রতি বছর এই দিবসকে সামনে রেখে পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সশস্ত্র সংগঠণগুলোর চাঁদাবাজির তৎপরতা বেপরোয়াভাবে বৃদ্ধি পায়। এতে করে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত সকল শ্রেণী-পেশার সাধারণ উপজাতি ও বাঙালিরা ঐসব সশস্ত্র সংগঠনের হুমকির মুখে চাঁদা দিতে বাধ্য হয়। প্রাণভয়ে এ বিষয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না। চলতি বছরও ১০ নভেম্বরকে সামনে রেখে পাহাড়ে ব্যাপক চাঁদাবাজি হয়েছে। বিভিন্ন ব্যক্তি, ব্যবসায়ী, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান, কাঠ ব্যবসায়ী সমিতি, যানবাহন মালিক সমিতি, ব্রিকফিল্ড সমিতি, জেলা পরিষদ, উন্নয়ন বোর্ড, ব্যাংক, এনজিও, সরকারি/বেসরকারি অফিস ইত্যাদি থেকে চিঠি দিয়ে রশিদের মাধ্যমে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের চাঁদা আদায়ের এরকম একটি রশিদ এই নিবন্ধ লেখকের হাতে রয়েছে। মূলতঃ ১০ নভেম্বরকে পুঁজি করে উপজাতি সংগঠনগুলো ব্যাপক চাঁদাবাজি করে নিজেদের আর্থিকভাবে হৃষ্টপুষ্ট করছে। ১০ নভেম্বর এখন আর জুম্ম জাতির শোক দিবস নয় বরং অবৈধ চাঁদা আদায়ের বাণিজ্য হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে পাহাড়ের স্থানীয় লোকেরা মনে করে থাকেন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।