Inqilab Logo

শুক্রবার ০১ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪৩১, ২৮ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

চট্টগ্রামে কিশোর-তরুণ অপরাধীদের দাপট

রফিকুল ইসলাম সেলিম : | প্রকাশের সময় : ৩ নভেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

টিপু (১৬), বাদশা (১৫) ও পিয়াস (১২)-এই তিনজন মিলে মোঃ আরিফ হোসেন (১৯) নামে এক যুবককে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। চট্টগ্রাম নগরীর পাহাড়তলী রেললাইনে হেঁটে যাওয়ার সময় ওই তিন ছিনতাইকারী তাকে ছুরিকাঘাত করে তার পকেটে থাকা ৬০০ টাকা দামের মোবাইল সেটটি নিয়ে নেয়। খুনের ঘটনার ৪ দিনের মাথায় গত ৩১ আগস্ট পুলিশ তাদের আটক করে। থানায় নেওয়ার পর তিনজনেই ওই খুনের দায় স্বীকার করে। শুধু তাই নয়, এর আগে আরও একাধিক খুনসহ ছিনতাই করেছে বলেও জানায় তারা।
টিপু, বাদশা, পিয়াসের মতো কিশোর-তরুণ অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে চট্টগ্রামের অপরাধ জগত। চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলার পাড়ায় পাড়ায় চলছে কিশোর-তরুণ অপরাধীদের দাপট। খুন, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ডাকাতি, দাঙ্গা-হাঙ্গামাসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে এসব উঠতি সন্ত্রাসীরা। তাদের নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে পুলিশ। এসব অপরাধীদের অনেকে আবার মাদকাসক্ত। অস্ত্র, মাদক ব্যবসাতেও এসব তরুণেরা জড়িয়ে পড়ছে। স¤প্রতি নগরীতে সংঘটিত বেশ কয়েকটি খুন, ডাকাতি, ছিনতাই, অপহরণ ও দস্যুতার ঘটনায় যারা আটক হয়েছে তদের বেশিরভাগ উঠতি বয়সী। অস্ত্র, ইয়াবাসহ ধরা পড়ছে কিশোর, যুবকেরা।
র‌্যাব-পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের হয়ে এরা অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ করছে। শীর্ষ অপরাধীরা এখন গডফাদারের ভূমিকায়। নেপথ্যে থেকেই তারা নতুন সন্ত্রাসীদের মাঠে নামিয়েছে। আবার কোন কোন এলাকায় উঠতি সন্ত্রাসীরা নিজেদের মধ্যে গ্রুপ তৈরি করে অপরাধ করছে। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে, কিংবা নেশার টাকা জোগাড় করতে বাবা, মায়ের অজান্তে তারা ছিনতাই, ডাকাতিতে নেমে পড়েছে। এদিকে উঠতি সন্ত্রাসীদের দাপটে অসহায় সাধারণ মানুষ। এসব অপরাধীদের সর্ম্পকে পুলিশেরও কোন ধারণা নেই। থানা পুলিশের খাতায় তাদের নামও নেই। ফলে কোথাও কোন অপরাধ হলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে পুলিশকে অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়তে হয়।
পুলিশ ও র‌্যাব কর্মকর্তারা জানান, চট্টগ্রাম মহানগরী ও জেলায় একসময় বাহিনী কেন্দ্রিক সন্ত্রাসীদের দাপট ছিল। এক একটি এলাকা ছিলো এক এক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। র‌্যাবের অভিযানে ভয়ঙ্কর এসব সন্ত্রাসীদের অনেকে বিদেশে পালিয়ে গেছে। অনেকে ক্রসফায়ার আর এনকাউন্টারে মারা পড়েছে। অনেকে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছে। আবার অনেকে রঙ বদল করে জনপ্রতিনিধি কিংবা রাজনৈতিক দলের নেতা হয়ে গেছেন। তবে এরা নিজেরা এখন সরাসরি মাঠে না নেমে তাদের অনুসারীদের দিয়ে অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণ করছেন। গত ৬ অক্টোবর নগরীর দক্ষিণ নালাপাড়ার সুদীপ্ত বিশ্বাস খুনের ঘটনায় ৪ জনকে পাকড়াও করে পুলিশ। তাদের মধ্যে দুইজন উঠতি যুবক। আদালতে দেওয়া দুই আসামীর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এই খুনের ঘটনায় সরাসরি জড়িত ১৮ জনের নাম এসেছে। মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা (আইও) সদরঘাট থানার পরিদর্শক (তদন্ত) রুহুল আমীন জানান, এদের বেশিরভাগ কিশোর-তরুণ। তদন্তে পুলিশ নিশ্চিত হয় গডফাদারের নির্দেশে তারা সুদীপ্তকে খুন করে। ওই গডফাদারের লালখান বাজার এলাকায় বিশাল বাহিনী আছে। এই বাহিনীর সদস্যদের বেশিরভাগ বয়সে কিশোর-তরুণ। তার নিদের্শে এরা যেকোন অঘটন ঘটায়।
নগরীর নন্দনকানন কেন্দ্রীক এক শীর্ষ সন্ত্রাসীও এখন গডফাদারের ভূমিকায়। তার অনুসারীরা এখন অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের একজন অমিত মুহুরী, বেশ কয়েকটি খুনের পর সে এখন জেলে। সর্বশেষ তার নির্মমতার শিকার হন যুবলীগ কর্মী ইমরানুল হক ইমন। অমিত মুহুরী নিজ বাসায় তাকে হত্যার পর লাশ ড্রামে ভরে তাতে এসিড ও চুন ঢেলে ঢালাই করা হয়। পরে লাশভর্তি ড্রাম ফেলে দেওয়া হয় নগরীর এনায়েত বাজারের রাণীর দীঘিতে। পুলিশ জানায়, ইমন খুনের ঘটনায় অমিত মুহুরীর সাথে যারা ছিল তারা বয়সে কিশোর-তরুণ। উঠতি সন্ত্রাসী অমিত কয়েক বছরের মধ্যে উঠতি যুবক ও কিশোরদের নিয়ে ভয়ঙ্কর বাহিনী গড়ে তোলে। রাজনৈতিক সন্ত্রাসীদের নামে নগরীর অনেক এলাকায় সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে উঠেছে। এসব বাহিনীর বেশিরভাগ সদস্য কিশোর-তরুণ। তারা চাঁদাবাজি, খুন, প্রতিপক্ষের উপর হামলা, দাঙ্গা-হাঙ্গামাসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। পাড়ায়-মহল্লায় ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে উঠতি সন্ত্রাসীরা। গত ২৩ অক্টোবর নগরীর হালিশহরে রাসেল (২০) নামে এক যুবককে খুনের ঘটনায় গ্রেফতার হয় গোলাম মাওলা সোহাগ (১৯) ও সাখাওয়াত হোসেন সাগর (২০)। পুলিশ বলছে, এই দুইজন উঠতি সন্ত্রাসী।
৭ অক্টোবর নগরীর চান্দগাঁও এলাকা থেকে অপহৃত মাদরাসা ছাত্র ইব্রাহিম হেলালকে উদ্ধার করে পুলিশ। এসময় অপহরণের সাথে জড়িত থাকায় মফিজুর রহমান রিপন, মোঃ ফাহিম হোসেন, ইমরান হোসেন ও রাব্বি নামে তিন উঠতি তরুণকে গ্রেফতার করে পুলিশ। নগরীর কর্ণফুলী থানা এলাকার বাসা থেকে অটোরিকশাযোগে মাদরাসায় যাওয়ার পথে ওই শিক্ষার্থীকে অপহরণের পর ১৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে তারা। পণের টাকা না দিলে তাকে গলা কেটে হত্যার হুমকি দেয় তারা। তাদের সবার বাড়ি নগরীর চান্দগাঁও এলাকায়। পুলিশ জানায়, তারা এর আগে আরও কয়েকটি অপহরণের ঘটনায় মোটা অংকের মুক্তিপণ আদায় করে। গত ১০ মে নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী থানার কুঞ্জছায়া আবাসিক এলাকায় ১১ বখাটে মিলে রাতভর দুই পোশাক কর্মীকে ধর্ষণ করে। বখাটেদের সবাই বয়সে তরুণ। গত ৯ মে রাতে বাকলিয়া থানার তুলাতলি জামাইবাজারে ২৫-৩০ জন কিশোর-তরুণ মিলে স্কুলছাত্র ও কিশোর ক্রিকেটার ইসমাইল গণিকে (১৪) পিটিয়ে গুরুতর আহত করে। পরে সে হাসপাতালে মারা যায়।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় নগরীর বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন গ্রুপ গড়ে উঠছে। এরা নানা অপরাধ কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে। তবে নানামুখি চাপের কারণে অনেক সময় এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে না থানা পুলিশ। তবে খুন ছিনতাইয়ের মতো বড় কোন ঘটনা ঘটলে পুলিশ ব্যবস্থা নিচ্ছে। অনেকে গ্রেফতারও হচ্ছে। নগরীর ১৬টি থানার ওসিকে এসব উঠতি সন্ত্রাসীদের তালিকা তৈরী করতেও বলা হয়েছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা। এই প্রসঙ্গে নগরীর ডবলমুরিং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ কে এম মহিউদ্দিন সেলিম বলেন, নগরীর বিভিন্ন এলাকায় নতুন নতুন বাহিনী গড়ে উঠছে। এসব বাহিনীতে কিশোর-তরুণদের নেওয়া হচ্ছে। তারা নানা অঘটন ঘটাচ্ছে। অনেক কিশোর-তরুণ আবার খুন, ছিনতাইসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এদের বেশিরভাগই মাদকাসক্ত। বস্তি এলাকা এবং পাড়া-মহল্লাতেই এদের বসবাস। বায়েজিদ বোস্তামি থানার ওসি আবুল কালাম জানান, বস্তি এলাকার কিশোর-তরুণরা অপরাধী হয়ে উঠছে। তাদের পড়া লেখা নেই, কাজ কর্মও নেই। এই কারণে অপরাধীরা তাদের সহজে নিজেদের দলে ভিড়িয়ে নিচ্ছে। এদের সম্পর্কে থানা পুলিশের কাছেও কোন তথ্য নেই স্বীকার করে তিনি বলেন, কোন ঘটনায় ধরা পড়ার পরই তাদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। কারণ তাদের বেশিরভাগই নগরীতে ভাসমান।
পুলিশ ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, নগরীর বায়েজিদ থানা এলাকায় উঠতি সন্ত্রাসীদের দাপট বেশী। জমিদখল থেকে শুরু করে চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ডাকাতির মতো অপরাধেও উঠতি বয়সের সন্ত্রাসীরা অগ্রগামী থাকছে। নগরীর খুলশী, আকবর শাহ, সদরঘাট, চান্দগাঁও থানা এলাকায়ও উঠতি বয়সীদের বেপরোয়া তান্ডব চলছে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজিসহ এমন কোন অপরাধ নেই যাতে কিশোর যুবকেরা জড়িয়ে পড়ছে না। পুলিশ জানায় নগরীর স্টেশন থেকে শুরু করে পাহাড়তলী পর্যন্ত রেললাইন এলাকার বস্তিগুলোতে উঠতি সন্ত্রাসীদের বসবাস। তাদের অপরাধের ধরন-রাজনৈতিক দলের নাম ভাঙ্গিয়ে দোকান থেকে চাঁদাবাজি, রিকশা যাত্রী মহিলাদের ব্যাগ টান দেয়া, ইয়াবা সেবন-বিক্রি, বিভিন্ন বয়সী মেয়েদের উত্যক্ত করা, ঝগড়া-মারামারি, অস্ত্রের মহড়াসহ আরও বিভিন্ন ধরনের কর্মকান্ড। সন্ধ্যার পর অনেক এলাকায় এরা জড়ো হয়। তুচ্ছ ঘটনায় নিজেদের মধ্যে মারামারিতে লিপ্ত হয় তারা। নগরীর চেরাগী পাহাড়, সেবক কলোনী, স্টেডিয়াম এলাকাসহ অনেক এলাকায় সন্ধ্যার পর এমন দৃশ্য দেখা যায়।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চট্টগ্রাম


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ