চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
মূল : বিচারপতি আল্লামা তাকী উসমানী দা. বা.
কৈশোর পেরিয়ে যৌবনের ঘরে পা দিতেই মানুষের মাঝে খেলে যায় এক ভিন্ন রকম অনুভূতি। এ অনুভূতি খেলা করে তার হৃদয় জুড়ে। নিজের অজান্তেই তার হৃদয় জগতে আকাক্সক্ষার জন্ম নেয় বিপরীত লিঙ্গের সাহচর্যের। প্রতি মুহূর্তে তার হৃদয় চঞ্চল হয়ে ওঠে প্রেয়সীর সন্ধানে। অন্য যৌবনকে ভালোবাসার অর্ঘ্য দিতে হয়ে পড়ে তার মন ব্যাকুল। ব্যাগ্র ব্যাকুল আকাক্সক্ষায় সে দুর্বার হয়ে পড়ে। এক সময় হয়ত সন্ধান মিলেও যায়। গড়ে ওঠে ভালোবাসা। জীবনে ভালোবাসার প্রথম অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়।
জীবনের প্রথম যেদিন নির্জন পার্কে বা সমুদ্র সৈকতে অথবা টেলিফোনে কথা হয় মনের মানুষের সাথে সেদিনের স্মৃতি হৃদয়ে এতটাই দাগ কাটে যে, আমরণ তা বয়ে বেড়ায়। অজানা এক ঘোরে সে বিভোর হয়ে পড়ে তখন। পড়ায় মন বসে না, খেতে ইচ্ছে করে না, বিছানায় গেলে ঘুম আসে না। তার মাঝে এমনই মিশ্র অনুভূতির জন্ম হয় যে, বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় সত্যিই কি আমি তার সাথে কথা বলেছি। আর কবে দেখা হবে বা আলাপ হবে।
প্রেম বিশেষজ্ঞদের মতে, জীবনের প্রথম ভালোবাসার গুরুত্ব অপরিসীম। এরপর যতই প্রেম-ভালোবাসা গড়ে ওঠুক প্রথম প্রেমের মতো হৃদয়কে এতটা আর নাড়া দেয় না। কারণ, প্রেমিক-প্রেমিকা দু’জনই প্রেমজগতের নতুন অতিথি। দু’জনে মিলে যা করে তার সব কিছুতেই থাকে নতুনত্ব। একে অন্যের সাথে হৃদয়-মন দেয়া নেয়া হয়।
আগেকার যুগে প্রেম ছিল সত্যনিষ্ঠ ও সভ্য-ভব্যতায় পূর্ণ। কিন্তু বর্তমানের প্রেম-ভালোবাসা যতটা না হৃদয় স্পর্শ করে হয় তার থেকে বেশি হয় মেকি অভিনয়। ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রেমে ব্যর্থ হওয়ার পরও প্রেমিক প্রেমিকার হৃদয়ে দাগ কাটে কম। বর্তমানকালে প্রেম-ভালোবাসা হচ্ছে সিনেমার হলে বসে, পার্কে বা সমুদ্র সৈকতে বসে চুমু খাওয়া, দীর্ঘ মনভোলানো চিঠি লেখা, ই-মেইল বা টেলিফোনে ছায়াছবির ঢঙে প্রেমালাপ করা, ইন্টারনেটের ‘ইমো’তে একজন আরেকজনের প্রতি তাকিয়ে কথা বলা, হাত ধরাধরি করে ঘুরে বেড়ানো ইত্যাদি।
অনেক প্রেমিকযুগল আবার আবেগের কাছে পরাজিত হয়ে অবৈধ মিলনেও জড়িয়ে যায়। পাশ্চাত্য বিশ্বের কাছে এ মিলন কোনো অপরাধ হিসেবে গণ্য না হলেও আমাদের সমাজে তা গ্রহণযোগ্য নয়; বরং তা একটি ক্ষমাহীন অপরাধ। পাশ্চাত্য দুনিয়ায় প্রেমিক-প্রেমিকার অবৈধ মিলনকে বৈধতা দেওয়ায় আজ অনেকেরই পিতার সন্ধান পাওয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইংল্যান্ডের এক হিসাবে দেখা গেছে, সেখানে বিগত কয়েক বছরে বেশির ভাগ সন্তান জন্ম নিয়েছে স্কুল পড়–য়া যুবতিদের গর্ভে। অবশ্য পাশ্চাত্য সমাজের বিশেষ সুবিধা হলো, সেখানে পিতৃপরিচয়ের দরকার হয় না।
গত কিছুদিন আগে খ্রিস্টধর্মগ্রন্থ বাইবেলে ফ্রিডম অব সেক্স এবং লিভ টুগেদার নিষিদ্ধ থাকলেও বিশেষ কারণে তা তুলে দেয়া হয়েছে। কোনো নারীর সাথে যদি কোনো পুরুষ অবৈধ মিলনে লিপ্ত হয় এবং এ অবস্থায়ও পুলিশ তাদেরকে গ্রেফতার করে আদালতে হাজির করে তাহলে উক্ত নারী যদি তার সঙ্গীকে বয়ফ্রেন্ড হিসেবে স্বীকার করে নেয় এবং এ কুকর্মের জন্য উভয়ের সম্মতির বিষয়টি জানিয়ে দেয় তাহলে আদালত তাদেরকে মুক্তি দিতে বাধ্য। অথচ সে পুরুষ যদি তার স্বামীও হয় এবং নারী তার সঙ্গীর উপর বল প্রয়োগের অভিযোগ আনে তাহলে পুরুষ বেচারাকে ধর্ষণের দায়ে আদালত শাস্তি প্রদান করবে। এর নামই হলো পাশ্চাত্যের নারী-স্বাধীনতা এবং এটা হলো তাদের সভ্যতা (?)।
গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সবচাইতে খারাপ দিক হচ্ছে বেশির ভাগের মতামতে পতিতাবৃত্তিকেও বৈধ করা যায়। বৃটেনসহ বিশ্বের বহু গণতান্ত্রিক দেশে এর বাস্তব উদাহরণ রয়েছে। গণতান্ত্রিক অনেক দেশেই মেয়েদেরকে পতিতাবৃত্তির লাইসেন্স দেওয়া হয়। পাশ্চাত্য প্রগতিবাদ ও নারী-স্বাধীনতার ফসল হিসেবে অসংখ্য নারীকে পতিতাবৃত্তির লাইসেন্স দিলেও পুরুষদের ক্ষেত্রে রয়েছে নানা বাধা-নিষেধ।
পাশ্চাত্য বিশ্ব অত্যন্ত কৌশলে নারীদেরকে পুরুষের ভোগ্যপণ্যে পরিণত করছে। অথচ জাতিসংঘ নামক বিশ্বসংস্থার মানবাধিকার গ্রæপ ও নারী অধিকার সংস্থা এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ নীরব দর্শক। মূলত ঘটনা অন্য জায়গায়। তাহলো, যেহেতু জাতিসংঘ ও অন্যান্য প্রগতিবাদী পাশ্চাত্য নারী অধিকার এবং মানবাধিকার সংস্থার হর্তাকর্তাগণ নারীলোভী পুরুষ, তাই তাদের নীরবতায় আশ্চর্য হওয়ারও কিছু নেই। তারা যে শুধু নীরব তা কিন্তু নয়; বরং অনেক ক্ষেত্রে এ ব্যাপারে তাদের হাতও রয়েছে সুনিপুণভাবে।
যৌবনের শুরুতে মানুষমাত্রই হয়ে ওঠে আবেগী। তাই সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত মানুষ সুন্দরের আকর্ষণে হয়ে ওঠে উন্মাদ। এ উন্মাদনা থেকে সৃষ্টি হয় হৃদয়ে ভালোবাসার উত্তাল তরঙ্গ। চুম্বক যেমন লোহাকে আকর্ষণ করে, আগুন যেমন পেট্রোলের স্পর্শে দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে তেমনি যৌবনে মানুষের ভেতর কামনা জেগে ওঠে। আর এ কামনাকে বৈধ পথে পূর্ণ করার অঙ্গীকার নিয়েই বিশ্বের আদি থেকে আজ পর্যন্ত প্রতিটি সভ্য জাতির মধ্যে বিবাহ প্রথা চলে আসছে।
বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বৈধভাবে নারী-পুরুষের মিলনে যে সন্তানের জন্ম হয় তাকেই বৈধ সন্তান বলে। অন্যথায় সন্তান হবে অবৈধ ও জারজ। বৈধ স্বামী-স্ত্রী ও সন্তানের একত্রে বসবাসকেই পারিবারিক পদ্ধতি বলা হয়। পাশ্চাত্য সমাজে পারিবারিক প্রথা অনেকদিন থেকেই বিলুপ্ত-প্রায়। শুধু তাই নয়, সে সমাজের মানুষ এখন পারিবারিক পদ্ধতি কী, তা ভুলতে বসেছে। নতুন প্রজন্ম নিজেদের সামাজিক অজ্ঞতার কারণে এখন আর পারিবারিক পদ্ধতিতে বিশ্বাস করে না।
যৌবনে মানুষের সাথি ও বন্ধুর তেমন অভাব হয় না। রাতের পর রাত দিনের পর দিন আড্ডা দিয়ে কাটিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু ছোটবেলা এবং বৃদ্ধ বয়সে প্রয়োজন হয় কারো সহযোগিতার। অবশ্য পাশ্চাত্য সমাজে আঠারো বছর পর্যন্ত সন্তানকে পিতামাতা সঙ্গ দেয়। তবে অনেক সন্তানের পিতারই কোনো সন্ধান থাকে না। আবার অনেক সন্তানের পিতামাতার সম্পর্ক শুধু বয়ফ্রেন্ড এবং গার্লফ্রেন্ডের মধ্যে সীমিত। ফলে ষোলো বা আঠারো বছরের পর সন্তানরাও বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ডের জীবন শুরু করে দেয়। এক সময় তারা যখন যৌবন বিদায়ী ট্রেনের যাত্রী হয়ে যায় তখন তারা হয়ে পড়ে অসহায়।
আমাদের সমাজে এই অসহায় মানুষগুলো নিজের অসহায়ত্বকে ভুলে থাকতে পারে ছেলেমেয়ে, ছেলের বৌ, মেয়ের জামাই, নাতি-নাতনিদের স্নেহ-মমতায়। পাশ্চাত্য প্রগতিবাদী পরিবারহীন সমাজে সে সুযোগ নেই। ফলে পাশ্চাত্য সমাজের বৃদ্ধদের শেষ সম্বল ও আপনজন বলতে অবশিষ্ট থাকে একমাত্র পোষা কুকুর। ফলে দেখা যায়, পাশ্চাত্য দুনিয়ায় অনেক বৃদ্ধ মৃত্যুর পূর্বে নিজের সকল সম্পত্তি কুকুরের নামে উইল করে দিয়ে যায়। অনেক বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ঘরের ভেতর মরে সপ্তাহ কিংবা দশ দিন পড়ে থাকে অথচ কেউ তার খবর রাখে না। যখন সরকারি নার্স রুটিন ওয়ার্কে আসে তখন মৃত্যুর সংবাদ প্রকাশিত হয়। এর নামই আধুনিকতা! এর নামই প্রগতি! আর এর নামই পাশ্চাত্য সভ্যতা!
পাশ্চাত্য সমাজে বৃদ্ধ মানুষগুলোকে মনে করা হয় সামাজিক অভিশাপ ও সমাজের জঞ্জাল। অথচ তারাও একদিন এই সমাজের যুবক ছিল এবং আজকের যুবক একদিন ওদের মতোই বৃদ্ধ হবে। অথচ ওরা যেন এসব ভাবতেই জানে না। অন্যদিকে আমাদের সমাজে বৃদ্ধ মানুষগুলোকে কতই না শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়।
আমি আশ্চর্য হই এ কারণে যে, এত কিছু দেখেও আমাদের সমাজের কিছু সংখ্যক মানুষ কোন স্বার্থে প্রগতির ¯েøাগান দেয়? কিভাবে আধুনিকতার কথা বলে তারা নারীদের উলঙ্গ করতে চায়? মূলত তারা নারী-পুরুষের সমান অধিকারের নামে নারীদেরকে পাশ্চাত্যমুখী করছে। নারীদেরকে পতিতাবৃত্তির লাইসেন্স, নগ্ন পোশাক, অফিস-আদালতে পুরুষের সহকারী হিসেবে কাজ, ফ্যাশন শোতে নারী অঙ্গ প্রদর্শনী, সুন্দরী প্রতিযোগিতার নামে সুন্দরী পতিতা বাছাই ইত্যাদির নাম কি নারী-স্বাধীনতা? এটাই কি নারীদের ন্যায্য অধিকার? কথা হলো- স্বল্প মূল্যের চাকরি, জমিতে মাটি কাটানো, রাস্তায় ইট-পাথর ভাঙানোর নাম কি নারী মুক্তি আন্দোলন? পারিবারিক সমাজ ভেঙে লিভ-টুগেদার বা ফ্রিডম অব সেক্সের নাম কি নারীদের সমান অধিকার?
অন্ধযুগের মূর্খ মানুষগুলোর বর্বরতার ইতিহাসে এসবের অনেক অধ্যায় আছে। তাহলে কি ইসলামপূর্ব জাহেলি যুগের সমাজকেও আধুনিক, প্রগতিশীল সমাজ বলে স্বীকার করে নেব? বিজ্ঞানের এত উন্নতি ও আবিষ্কারের পরও যদি কেউ ফিরে যেতে চায় জাহেলিয়াতে তবে তাকে অন্ধ পাগল ছাড়া আর কি-ই-বা বলা যাবে?
অনুবাদক : মাওলানা এসএম আনওয়ারুল করীম
মুহাদ্দিস, ওলামানগর দারুল উলুম মাদরাসা, ডেমরা, ঢাকা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।