হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ কী বার্তা দিয়ে গেলেন, এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা হচ্ছে। এ ব্যাপারে নানমুনির নানা মত। যার যার অবস্থান ও দৃষ্টিকোন থেকে সবাই এ সফরের বিষয়ে পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করছেন। তাতে এ বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্ট যে, দু’দিনের ঝটিকা সফর হলেও তা ছিল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। একটি বিশেষ পরিস্থিতির পটভূমিতে সুষমা স্বরাজ বাংলাদেশ সফরে আসেন। সুনির্দিষ্ট কয়েকটি ইস্যুতে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গী ও অবস্থান জানার প্রতীক্ষায় ছিল বাংলাদেশের মানুষ। দু’দেশের পারস্পরিক সম্পর্ককে আরো উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার রয়েছে দু’ সরকারের। চলতি সম্পর্কও অত্যন্ত মধুর বলে তাদের দাবি। তা সত্তে¡ও সাম্প্রতিককালে এ সম্পর্কের মধ্যে এক ধরনের টানাপোড়েন পর্যবেক্ষকদের নজর এড়ায়নি। তিস্তার পানিবন্টন চুক্তিসহ অন্যান্য দ্বিপাক্ষিক সমস্যার সমাধানে দৃষ্টিগ্রাহ্য কোনো অগ্রগতি নেই। এ নিয়ে খেদ ও ক্ষোভের অবধি নেই জনগণ পর্যায়ে। যত কমই হোক, এর প্রভাব সরকারের মধ্যে পড়ার কথা। রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের প্রতি ভারতের সমর্থন সম্ভবত সরকারী মহলকেও বিস্মিত ও হতভম্ভ করেছে। এতে সম্পর্কের মিথ বড় রকমে আহত হয়েছে। অনেকটা ‘করজোড়ে’ অনুরোধ জানানো হয়েছে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। তারপরও তার মন গলানো যায়নি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের প্রভাব বিস্তারের ধারা অনেকদিন ধরেই বহমান। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভারতের ভূমিকা ও অবস্থান কি হতে পারে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন হয়ে আছে। এসব ইস্যুতে ভারতের স্পষ্ট অভিমত ও বক্তব্য জানা থাকাই স্বাভাবিক। সুষমা স্বরাজ এই বিশেষ ইস্যুগুলোতে ভারতের নীতি-অবস্থান খোলাসা করবেন, এমন প্রত্যাশা তাই অমূলক কিছু নয়।
সুষমা তার সফরকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলীর সঙ্গে অনুষ্ঠানিক বৈঠক ছাড়াও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও আলোচনা করেছেন। আরও কিছু কর্মসূচীতে তিনি অংশ নিয়েছেন, বক্তব্য রেখেছেন। এতে বাংলাদেশের সকল পক্ষের মধ্যেই এক ধরনের সন্তোষ পরিলক্ষিত হয়েছে। দু’দেশের সরকারী মহলের দাবি, সুষমার সফর খুব সফল ও ফলপ্রসু হয়েছে। কতটুকু সফল ও ফলপ্রসু হয়েছে, তা গভীর পর্যালোচনার অবকাশ রাখে।
সুষমা স্বরাজ ভারতের রাজনীতিতে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। ক্ষমতাসীন বিজেপির তিনি শীর্ষস্থানীয় নেতা এবং অন্যতম নীতিনির্ধারক। রাজনীতিতেই শুধু নয়, কূটনীতেও যে তিনি খুবই দক্ষ ও পারঙ্গম, তার ঢাকা সফরে এর প্রমাণ রয়েছে। এদেশের সরকারী ও বিরোধীমহলকে একই সঙ্গে সন্তুষ্ট করা বা খুশী করা চাট্টিখানি কথা নয়। বিস্ময়করভাবে তিনি এতে সফল্য লাভ করেছেন। তিনি সকলের প্রত্যাশা অনুযায়ী কথা বলে সকলেরই সন্তোষ আদায় করে নিয়েছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী, বিএনপির চেয়ারপারসন ও সংসদে বিরোধী দলীয় নেতার সঙ্গে তার যে কথাবার্তা ও আলোচনা হয়েছে সেখানে অনিবার্যভাবেই তিনি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নয়ন ও পারস্পারিক সহযোগিতার বিষয় এনেছেন। রোহিঙ্গা ইস্যুতে কথা বলেছেন। কথা বলেছেন বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচন প্রসঙ্গে এবং এক্ষেত্রে ভারতের অভিমত ও অবস্থান জানিয়েছেন। ভারতীয় হাইকমিশনের চ্যান্সারী কমপ্লেক্সে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সুষমা ভারতের ‘প্রতিবেশী আগে’ নীতির কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ‘পরসি পেহেলে লেকিন বাংলাদেশ সবচে পেহেলে’। খবরে প্রকাশ, যখন তিনি এই মন্তব্য করেন তখন উপস্থিত সকলে হাততালি দিয়ে তাকে অভিনন্দন জানান। তিনি শুধু এখানেই থেমে যাননি, আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেছেন। বলেছেন, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে তিনি দাদা বলেন এবং তিনিও তাকে দিদি বলেন। তার ভাষায় ‘আমরা দু’জন দাদা আর দিদির সম্পর্ক পাতিয়ে ফেলেছি।’
প্রতিবেশী হিসাবে বাংলাদেশ সবার আগে, সুষমার এই উচ্চারণ কতদূর সত্য ও বাস্তব সেটা খতিয়ে দেখার দাবি রাখে। বাংলাদেশের মানুষ মনে করে, এই মন্তব্য আসলে একটি কথার কথা মাত্র। এর সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। সে আলোচনায় আমরা পরে আসবো। ‘দাদা-দিদি’ সম্পর্কের বিষয়ে বলতে হয়, দুই দেশের কূটনৈতিক বা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই দাদা-দিদি সম্পর্কের আসলে কোনো মূল্য নেই। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে পারস্পারিক স্বার্থে। একে লেনদেনের সম্পর্কও বলা যায়। কোনো দেশই তার স্বার্থ বিকিয়ে দেয় না। দেশের সম্পর্ক দেশের স্বার্থে, ব্যক্তির সম্পর্ক ব্যক্তির স্বার্থে। ব্যক্তির সম্পর্ক যতই মধুর ও হৃদ্যতাপূর্ণ হোক না কেন, তা আন্ত:রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে তেমন কোনো প্রভাব রাখতে পারে না। এসব জানা কথা হলেও সুষমা এ ধরনের কথার অবতারণা করে বাংলাদেশের সরকারসহ বিভিন্ন মহল ও জনগণকে সন্তুষ্ট করতে চেয়েছেন। এতে তিনি কতটা সফল হয়েছেন সেটা অবশ্য পরের কথা।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সুষমার আলোচনায় স্বভাবতই রোহিঙ্গা ইস্যু বিশেষ গুরুত্ব পায়। এই ইস্যুতে, সবাই জানেন, ভারত মিয়ানমারের অবস্থানের প্রতি অনেক আগেই সমর্থন জানিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি স্বয়ং মিয়ানমারে গিয়ে এই সমর্থন জানিয়ে এসেছেন। এও সকলের জানা, এত খোলাখুলি সমর্থন বিশ্বের আর কোনো দেশ জানায়নি। শুধু তাই নয়, ভারতে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের বের করে দেয়ার পদক্ষেপ নিয়েছে মোদি সরকার। ভারতের কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকদের অনেকেই মিয়ানমারকে সমর্থন করার জন্য সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন। তারা পরিষ্কারই বলছেন, মিয়ানমার আগে, পরে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের এ ব্যাপারে বলার কিছু নেই। এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করা, বেশি কিছু চাওয়া তার উচিৎ নয়। এই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে কিছুটা নড়াচড়া লক্ষ্য করা যায়। অনেকেই সরকারকে এই মর্মে পরামর্শ দেয়, সরকারের উচিৎ ভারতের সঙ্গে এ নিয়ে কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক পর্যায়ে যোগাযোগ ও কথাবার্তা বলা। সে মোতাবেক কিছু তৎপরতাও লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশ সঙ্গতকারণেই আশা করেছিল, সুষমা এ বিষয়ে স্পষ্ট বক্তব্য রাখবেন। যতদূর জানা, এ প্রসঙ্গের আলোচনায় সুষমা রোহিঙ্গা শব্দ উচ্চরণ না করে রাখাইন রাজ্যের ‘বাস্তচ্যুত’দের স্বদেশে ফিরে যাওয়ার মধ্যেই উদ্ভূত সমস্যার সমাধান নিহিত রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি কফি আনান কমিশনের সুপারিশমালার প্রতি ভারতের সমর্থন আছে বলেও উল্লেখ করেছেন। এতেই নাকি বাংলাদেশের প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে বলে সরকারী মহল মনে করছে।
সরকারের বাইরে সুষমার সবচেয়ে গুরুত্ববহ বৈঠকটি হয়েছে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে। এই বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক, রোহিঙ্গা ইস্যু এবং আগামী নির্বাচন প্রসঙ্গে যথারীতি আলোচনা হয়েছে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ও রোহিঙ্গা ইস্যুতে নতুন কোনো বক্তব্য সুষমার নেই। রাজনীতি ও নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি যা বলেছেন, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ভাষায় তা এই ‘বিএনপি চেয়ারপারসন বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং আগামী নির্বাচনের বিষয়টি তুলে ধরেছেন। সুষমা স্বরাজ সব শুনেছেন। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মনে করেন, ভারত একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসাবে প্রতিবেশী দেশগুলোতেও যাতে গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় থাকে, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়, নির্বাচন কমিশনও যাতে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে সেটি তারা প্রত্যাশা করেন। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আগামীতে সবার অংশগ্রহণে যাতে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয় সেই অবস্থানের কথাটি তুলে ধরেছেন।’ বিএনপি’র অনেকেই মনে করছেন, সুষমার এই বক্তব্য ইতিবাচক।
তিস্তার পানিবন্টন চুক্তিসহ দ্বিপাক্ষিক সমস্যার সমাধানে উল্লেখ করার মতো কোনো কথাই সুষমা বলেননি। সরকারী মহল থেকে বলা হয়েছে, দ্বিপাক্ষিক সকল সমস্যা নিয়েই আলোচনা হয়েছে। কিন্তু এই আলোচনায় বাংলাদেশের জন্য কোনো সুখবর নেই। সেই পুরানো ভাঙা রেকর্ডই নতুন করে বাজানো হয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক ‘অসাধারণ’ বলে উল্লেখ করে সুষমা বলেছেন, দুই দেশের মধ্যে অমীমাংসিত যে বিষয়গুলো রয়েছে, সেগুলোর সমাধান হবে। দুই পক্ষই বন্ধুত্বের মেজাজে সঠিক পথে কাজ করছে। আমি নিশ্চিয়তা দিচ্ছি, দুই দেশ মিলে সব বিষয় ঈমানদারির সঙ্গে মিটিয়ে ফেলবো। স্থলসীমানা বিরোধ ও সমুদ্রসীমা বিরোধের নিষ্পত্তির রেফারেন্স টেনে তিনি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও শেখ হাসিনা আমাদের দুই দেশের সম্পর্কের শক্ত ভিত্তি দিয়েছেন, যা দিনে দিনে সহযোগিতার হাত ধরে সম্প্রসারিত হচ্ছে। আগামীতে এই সম্পর্ক বৃহত্তর উচ্চতায় গিয়ে পৌঁছাবে, আমি নিশ্চিত।
বাংলাদেশ সবার আগে, সুষমার এ কথার প্রমাণ কখনোই পাওয়া যায়নি। এমন কি তার সফরের মধ্যেও খুঁজে পাওয়া যায়নি। দ্বিপক্ষীয় সমস্যাদির সমাধানে ভারতের অবস্থান পূর্বাপর একই রকম। অথচ বর্তমান সরকার ভারতকে কী না দিয়েছে! উত্তর-পূর্ব ভারতের ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’দের দমনে সহযোগিতা করেছে। ট্রানজিটের নামে করিডোর দিতে সম্মত হয়েছে। সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের সুযোগ নিশ্চিত করেছে। ভারতীয় পণ্যের জন্য বাজার উন্মুক্ত করে দিয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য ভারতীয় ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে। শুধু খাতিরের কারণে উচ্চসুদ ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী শর্তে ঋণ নিয়েছে। বাংলাদেশ এসবের বিনিময়ে কিছুই পায়নি। তিস্তার পানিবন্টন চুক্তি হিমাগারে গেছে। অন্যান্য নদীর পানিবন্টনের বিষয়ও ঝুলে আছে। বাণিজ্যঅসমতা কমা তো দূরের কথা, প্রতিবছরই বাড়ছে। সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা বন্ধ হয়নি। মাদক-অস্ত্র চোরাচালান অব্যাহত আছে। এরপরও কি বিশ্বাস করতে হবে বাংলাদেশ সবার আগে? কিছুদিন আগে ভারতের অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। তার ওই সফরের সময় সাড়ে চার বিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি হয়েছে। দেখা গেছে, সেইসব প্রকল্পে ঋণ দেয়া হয়েছে যেসব প্রকল্পে ভারতের ট্রানজিট বা করিডোর সুবিধা তরান্বিত হবে। সুষমার সফরের সময়ও কানেক্টভিটির অনুকূলে ও পেট্রোলিয়াম ক্রয়ের মতো কিছু চুক্তি হয়েছে। ‘নেবো, শুধু নেবো, দেবো না কিছুই’, ভারতের এই নীতির ব্যত্যয় নেই।
বাংলাদেশ যদি সবার আগে হয়, তাহলে রোহিঙ্গা ইস্যুতে সবার আগে ভারতের বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়ানোর কথা। কিন্তু দাঁড়ায়নি। বাংলাদেশকে ফেলে রেখে ছুটে গেছে মিয়ানমারের পাশে। রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে মিয়ানমার সরকারের যে মনোভাব, অনুরূপ মনোভাব ভারতের। তা না হলে গণহত্যা, গণনির্যাতন ও গণবিতাড়নের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পক্ষে ভারত টু শব্দটি করবে না কেন? উল্টো ভারতে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের সে বাংলাদেশ পুশইন করছে। মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালী’ বলে অভিহিত করে বাংলাদেশ ঠেলে দিচ্ছে। একই কাজ করছে ভারত। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক। ভারতে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের যদি ঠেলে দিতেই হয় তাহলে মিয়ানমারেই দিতে হবে, বাংলাদেশে কেন? সুষমা স্বরাজ রোহিঙ্গা ইস্যুতে যা বলেছেন তা অনেকটা বইয়ের কথা। তথাকথিত বাস্তচ্যুতদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার মধ্যেই রয়েছে সমস্যার সমাধান, এ কথা কে না জানে! কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের কথা গোটা বিশ্বই বলছে। এ আর নতুন কথা কি! লক্ষ্য করার বিষয়, সুষমা কিন্তু মিয়ানমার সরকার ও সেনাবাহিনীর গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য কোনো নিন্দা করেননি। এমন কি হত্যা, নির্যাতন ও বিতাড়ন বন্ধে মিয়ানমারের ওপর ভারত চাপ সৃষ্টি করবে, এমন কোনো প্রতিশ্রæতিও দেননি। তাহলে ভারতের মিয়ানমার-নীতির পরিবর্তন হলো কোথায়? এ ব্যাপারে বাংলাদেশের আত্মপ্রসাদে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের প্রভাব বিস্তারের সূত্রপাত স্বাধীনতার পর থেকেই। সেটা কথিত ‘হস্তক্ষেপে’র পর্যায়ে পৌঁছাতে অবশ্য অনেক সময় লেগেছে। বিগত সংসদ নির্বাচনের সময় ভারত প্রকাশ্যে বাংলাদেশের একটি রাজনৈতিক পক্ষকে সমর্থন জানায়। ভোটবিহীন, ভোটারবিহীন ওই নির্বাচন অনুষ্ঠানে ভারত রীতিমত সহযোগিতা করে। নির্বাচনটি দেশে-বিদেশে অগ্রহণযোগ্য বলে সাব্যস্ত হলেও ভারত তার পূর্বাস্থানে এখনো দৃঢ় আছে। আরেকটি নির্বাচন সামনে। সেই নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু নিরপেক্ষ অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য হোক, এটা এদেশবাসীর প্রত্যাশাই শুধু নয়, গণতান্ত্রকামী বিশ্বেরও কামনা। আগামী নির্বাচনে ভারত কী ভূমিকা বা অবস্থান নেবে সেটা এক বড় বিবেচ্য বিষয়। এ প্রসঙ্গে বিএনপির চেয়ারপারসনের সঙ্গে যে বৈঠক সুষমা করেছেন, সেখানে তিনি অবাধ, ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পক্ষে কথা বলেছেন এবং এও জানিয়েছেন, ভারত অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায়। কিন্তুু ওই ধরনের একটি নির্বাচন করার ব্যাপারে ভারত প্রয়োজনীয় সহযোগিতা, নিদেনপক্ষে নিরপেক্ষ থাকবে কিনা সে বিষয়ে কোনো কথা বলেননি। বরং ভারতের নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে জানিয়ে দিয়েছেন বর্তমান সরকারের অবস্থানের পক্ষেই ভারত রয়েছে। তিনি এ প্রসঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, নির্বাচন কোন প্রক্রিয়ায় হবে বা ঠিক করবে এদেশের জনগণ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দায়িত্ব সরকারের। তিনি নাকি এও বলেছেন, কোনো অনির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে সেটা হবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বিচ্যুতি। দিল্লীর কূটনৈতিক সূত্রের বরাত দিয়ে পত্রিকান্তরে এক খবরে জানানো হয়েছে, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ায় সঙ্গে আলোচনায় নিরপেক্ষ সহায়ক সরকারের বিষয়টি আসে। সুষমা এ প্রসঙ্গে ভারতের রাজনীতি ও নির্বাচনের বিষয়টি তুলে ধরেন। বলেন, এমন কোনো কনসেপ্ট ভারতের রাজনীতিতে নেই। ভারতে নির্বাচন পরিচলনা করে নির্বাচনে কমিশন। সে সময়ও সরকার থাকে, সেই সরকার রুটিন কাজ করে। উল্লেখ্য, এ ধরনের কথা আমাদের সরকারী মহল থেকে অনেকেই ইতোমধ্যে বলেছেন। বস্তুত, সুষমা সে কথারই পুনরাবৃত্তি করেছেন। সকলেরই জানা, ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নয়, নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত সরকারের অধীনেই নির্বাচন হতে হবে, বিরোধীদলের এমন দাবীর মুখেই সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সংকট। এই সংকট উত্তরণে ‘সবার আগে বাংলাদেশ’ এর প্রবক্তা ভারতের উচিৎ প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা। এক্ষেত্রে কোনো পক্ষাবলম্বন না করলেও একটা বড় রকমের সহযোগিতা হয়। সুষমা স্বরাজের এ বিষয়ক অভিমত ও বক্তব্য থেকে বুঝা যায়, নির্বাচন প্রশ্নে ভারতের অবস্থান পূর্ববৎ বহাল আছে।
বিশ্লেষকদের একটি অংশ অবশ্য মনে করেন, সুষমা সকল পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেছেন, যার মধ্যে একটা ইতিবাচক ইঙ্গিত আছে। ভারতের রাজনীতির প্রসঙ্গ টেনে তারা বলতে চান, ভারতে এখন ক্ষমতায় বিজেপি, কংগ্রেস নয়। কংগ্রেস সরকার বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচনে যেভাবে সরাসরি নাক গলায়, বিজেপি সরকার সেরকম কিছু করতে চায় না। কারণ, ওই নাক গলানোর ঘটনায় বাংলাদেশের মানুষ ব্যাপকভাবে ক্ষুব্ধ হয় যা এখনো তাদের মনে জমা হয়ে আছে। বিজেপি সরকার এদেশের রাজনীতির স্টেক হোল্ডারদের সকলের সঙ্গেই সুসম্পর্ক রাখতে চায়, জনগণের ক্ষোভ কমাতে চায় এবং দু’দেশের জনগণ পর্যায়ে সম্পর্ক উন্নত করতে চায়। বলা বাহুল্য, এ ধরনের মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ প্রকৃত সত্যের কতটা কাছাকাছি তা নিয়ে বিস্তর প্রশ্নের অবকাশ রয়েছে। যদি এমনটিই হতো তাহলে সুষমার বক্তব্যে তার বোধগম্য প্রতিফলন পরিলক্ষিত হতো।
অত:পর সুষমা কী বার্তা দিয়ে গেলেন, সেই প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, বাংলাদেশের উল্লাসিত ও উজ্জীবিত হওয়ার মতো বার্তা তিনি দিতে পারেননি বা দিয়ে যাননি। শুরুতে যে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোর কথা আমরা উল্লেখ করেছি, সে সব ইস্যুতে ভারতের নীতি-অবস্থান আগের মতোই অটুট আছে। বাংলাদেশ সবার আগে, সুষমার এই মন্তব্যকে যদি বার্তা বলে চিহ্নিত করা যায়, তাহলেও দেখা যাবে, ওই বার্তার কোনো বাস্তবভিত্তি বা সারবত্তা নেই। তবে ভারতের নীতি-অবস্থান অক্ষুণœ থাকাকে বার্তা হিসাবে গণ্য করা হলে বলতেই হবে, সেই বার্তা কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ পেয়ে গেছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।