হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
আমাদের ধর্ম পবিত্র ইসলাম শিক্ষা দেয় যে মৃত মানুষ সমস্ত সমালোচনার ঊর্ধ্বে। তাই একজন মানুষ মারা যাওয়ার পর তার কুলখানি, চেহলাম বা দোয়া মাহফিল যাই অনুষ্ঠিত হোক না কেন, সেখানে তার চরিত্রের শুধুমাত্র গুণবাচক দিকগুলিই হাইলাইট করা হয়। দোষগুণ মিলেই একজন মানুষ। মৃত মানুষের দোষ কখনো উল্লেখ করা হয় না। বরং সমস্ত মানুষকে অনুরোধ করা হয় যে ঐ মরহুম মানুষটি সম্পর্কে কারো যদি কোনো ক্ষোভ থেকে থাকে, যদি মরহুম ব্যক্তিটি কাউক আঘাত দিয়ে থাকেন তাহলে সকলে তাকে যেন মাফ করে দেন। সেই মৃত মানুষটির দোষগুণ যাই থাক না কেন, সকলেই তার রুহের মাগফিরাত কামনা করে মোনাজাত করেন।
দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশের এক শ্রেণির বামপন্থী তথাকথিত বুদ্ধিজীবী ইসলামের এই মহান ও উদার শিক্ষা থেকে কোনো শিক্ষাই গ্রহণ করেননি। এরা মৃত মানুষেরও নির্বিচার ও নির্মম সমালোচনা করেন। তাই দেখা যায়, মৃত্যুর প্রায় ২০ বছর পর খান আতার গীবত গাওয়া শুরু হয়েছে। এবং শুরু করেছেন বামপন্থী মহলের একজন মুখপাত্র।
৪৩ বছর পর আবার রাজাকার-দালাল ইস্যু উঠানো হয়েছে। আর এই ইস্যুটি তুলেছেন এমন এক ব্যক্তি, ৯ বছর আগে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কট্টর বামপন্থী ছাড়া কারো কাছে যার কোনো পরিচিতি ছিল না। এই লোকটির নাম নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু। বাচ্চুর মত যারা বামপন্থী আঁতেল, তারা নেহায়েত অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য আওয়ামী লীগের ঘাড়ে চড়েছেন। এদের কেউ কেউ সমাজে প্রভাব বিস্তারের জন্য হাতুড়ি-কাস্তে বিসর্জন দিয়ে নৌকায় চড়ে এমপি হয়েছেন, আর কেউ কেউ নাম ফুটানোর জন্য আওয়ামী লীগের প্লাটফর্মে সংস্কৃতির সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়েছেন। যে দালাল-রাজাকার ইস্যুটি ৪৩ বছর আগে নিষ্পত্তি হয়েছে এবং যে নিষ্পত্তি করেছেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং শহীদ জিয়াউর রহমান সেই ইস্যুটিই এরা ৪৩ বছর পর কবর খুঁড়ে টেনে বের করার চেষ্টা করছেন। দালাল-রাজাকার ইস্যুটি এই কারণে এখন প্রযোজ্য নয় যে, দালাল-রাজাকার এবং যুদ্ধাপরাধী এক বিষয় নয়। দালাল-রাজাকার ইস্যুটি চিরতরে নিষ্পত্তি করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং শহীদ জিয়াউর রহমান। এখন এই ইস্যুটি জিন্দা করার প্লাটফর্ম হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে আমেরিকার নিউইয়কর্কে। কিছুদিন আগে নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু নিউইয়র্ক গিয়েছিলেন। সেখানে এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন যে, বাংলাদেশের প্রখ্যাত সিনেমা প্রযোজক, পরিচালক, সুরকার, গায়ক এবং গীতিকার মরহুম খান আতাউর রহমান নাকি দালাল এবং রাজাকার ছিলেন। তাৎক্ষণিকভাবে অকুস্থলেই তার এই বক্তব্যের প্রতিবাদ ওঠে। তখন তিনি তার ফেসবুকে এ সম্পর্কে একটি স্ট্যাটাস দেন। ঐ স্ট্যাটাসে তিনি বলেন, তৎকালীন যে ৫৫ জন বুদ্ধিজীবী ও শিল্পী ১৯৭১-এর ১৭ মে মুক্তিযুদ্ধকে ‘আওয়ামীলীগের চরমপন্থীদের কাজ’ বলে নিন্দাসূচক বিবৃতি দিয়েছিলেন, দুঃখজনকভাবে খান আতাউর রহমান তার ৯ নম্বর সাক্ষরদাতা ছিলেন। (যে পুস্তক থেকে ঐ ৫৫ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে সেই পুস্তকটির নাম ‘একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়’। বইটি আমার সংগ্রহে রয়েছে। প্রকাশ করেছে ‘মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেন্দ্র’। ঐ ৫৫ জনের নাম নিয়ে আমি ঘাঁটাঘাঁটি করতে চাচ্ছিলাম না। কারণ তাতে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসবে।)
যাই হোক, এই স্ট্যাটাসের মাধ্যমে বাচ্চু ভিমরুলের চাকে ঢিল দিয়েছেন। খান আতার পক্ষে বাঘা বাঘা সব মুক্তিযোদ্ধা এগিয়ে এসেছেন। এদের মধ্যে আছেন প্রখ্যাত চিত্রনায়ক এবং মুক্তিযোদ্ধা ফারুক, প্রখ্যাত চিত্রনায়ক, পরিচালক, প্রযোজক ও মুক্তিযোদ্ধা সোহেল রানা, ছড়াকার ও মুক্তিযোদ্ধা আবু সালেহসহ আরো অনেকে। মুুক্তিযুদ্ধের এই সব বিশাল ব্যক্তিদের কাছে বাচ্চু সাহেবের মত শাসক দলের কাঁধে ভর করা ব্যক্তিরা ¤øান হয়ে গেছেন।
এ সম্পর্কে চলচ্চিত্র পরিবারের আহŸায়ক চিত্রনায়ক ফারুক বলেন, নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু কে বা কী বলেন তাতে আমার কোনো যায় আসে না। খান আতার মতো একটি গুণী মানুষকে তার গুণ প্রকাশ করতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। তার সাথে আমি অনেক কাজ করেছি। তাকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। তার মধ্যে যে দেশপ্রেম দেখেছি তা সত্যিই অভাবনীয়। তার কাজই তার প্রমাণ। তার মতো একটি মানুষকে আক্রমণ করে কথা বলা অনেক দুঃখজনক। তিনি আরো বলেন, ‘আবার তোরা মানুষ হ’ ছবিটি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কথা বলেছে। এখানে দেখা গেছে ‘বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া একটি ছেলে দেশ স্বাধীন করে বাসায় গিয়ে দেখে, তার বাবা অসুস্থ। চারিদিকে হাহাকার। অথচ বাহিরে এসে দেখে এক শ্রেণির মানুষ চোরা কারবার করে গাড়ি, বাড়ি বানিয়ে ফেলেছে। এখন তার প্রশ্ন, এরা কারা। আমরা অনেক কষ্ট করে দেশ স্বাধীন করেছি। অথচ আমাদের কেন এই দুরাবস্থা। তখন তারা অস্ত্র জমা দেয় না।
অভিনেতা ফারুক আরো বলেন, বাচ্চু সাহেব এমন অবস্থা কখনও দেখেছেন কিনা আমার জানা নাই। তিনি তো সুখে ছিলেন, সুখেই আছেন। খান আতার মতো একটি মানুষকে কে না চিনেন। সব শ্রেণির মানুষরা তাকে ভালোবাসেন। আমার প্রশ্ন হলো, বাচ্চু সাহেব আপনি যে খান আতাকে বললেন, ‘আগে তুই মানুষ হ’। আপনার মধ্যে কি এতটুকু আদব কায়দা নেই- একজন মৃত, সিনিয়র, গুণী মানুষকে কি বলে সম্বোধন করতে হয়?
\দুই\
সোহেল রানা বলেন, স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে যারা গান, নাটক, সাহিত্য, আর্ট-কালচার থেকে শুরু করে সব জায়গায় বিপ্লবী চেতনা নিয়ে এসেছে তারাই হচ্ছে সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধে অংশ নিতে পেরেছে কি পারেনি সেটা পরের কথা। ২৫ মার্চের আগে বাংলাদেশের রেডিও ও টেলিভিশনে প্রচারিত গানের ৩০ ভাগের লেখক ও সুরকার ছিলেন খান আতাউর রহমান। প্রবীণ এই অভিনেতা বলেন, আমি নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চুকে অনুরোধ করবো এই গানগুলো যেন তিনি শোনেন। গানগুলোতে কী ছিল? গানগুলোতে কি পাকিস্তানের গুণগান ছিল, না আমাদের দেশের কথা ছিল?
সোহেল রানা আরও বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় বাচ্চু সাহেবকে কেউ চিনতো না, কিন্তু খান আতা সাহেবকে সবাই চিনতো। ফলে বাচ্চু সাহেবের পালিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা যতটা সহজ ছিল, খান আতা সাহেবের জন্য ততটা সহজ ছিল না। যে কারণে তিনি সরাসরি যুদ্ধে যেতে পারেননি। তিনি বলেন, এমন অনেকেই রয়েছেন যারা একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধে সরাসরি অংশ নিতে পারেননি। কিন্তু স্বাধীনতার জন্য গান লিখেছেন, অনেকে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য টাকা সংগ্রহ করেছেন, খাবার দিয়েছেন।
সোহলে রানা বলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত পুলিশ, বিডিআর, আর্মি, শিক্ষক, চিকিৎসক পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে বেতন নিয়েছেন। এখন তাই বলে কি তারা রাজাকার? আবার বাংলাদেশের ৭ কোটি মানুষ তো আর যুদ্ধ করতে যায়নি, তাহলে তারাও কি রাজাকার?
বিশিষ্ট লেখক ও বøগার ডাক্তার পিনাকী ভট্টাচার্য সোহেল রানার উদ্ধৃতি দিয়ে গত ১৭ অক্টোবর একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে দেওয়া হলো, ‘স্বাধীনতার পরপর কয়েকজন শান্তিনগরে খান আতাকে রাজাকার হিসেবে আটক করেছিল। তাকে মেরে ফেলবে। তখন আমি ইকবাল হলের (বর্তমান শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ভাইস প্রেসিডেন্ট। আমি খবর পেয়ে জিপে করে আর্মস নিয়ে সেখানে উপস্থিত হই। আমি ওদের ১৫ জনকে পিটিয়ে আতা সাহেবের কাছে মাফ চাইতে বাধ্য করেছিলাম। সেদিন ওদের বলেছিলাম- খান আতা তোদের বাবা।’ - সোহেল রানা।
বিশিষ্ট ছড়াকার ও মুক্তিযোদ্ধা আবু সালেহ এ সম্পর্কে তার স্ট্যাটাসে বলেন, ‘বরেণ্য চলচ্চিত্রকার, অভিনেতা, গীতিকার শ্রদ্ধেয় খান আতা সম্পর্কে মুক্তিযোদ্ধা নাসিরুদ্দিন বাচ্চু যে বক্তব্য দিয়েছেন তা নিয়ে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে যা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন কথা আমি জানি না। তখন আমি রণাঙ্গনে ছিলাম। তবে অসহযোগ আন্দোলনের সময়ে আমি তার কাছে স্বাধীনতার আন্দোলন নিয়ে কথা বলতাম। তিনি তখন সিদ্ধেশ্বরী জামে মসজিদের রাস্তার অপর পাশে থাকতেন। আমার বাসাও সিদ্ধেশ্বরীতে।
জনাব খান আতা ভাইকে আমাদের বৈঠকগুলোতে ডাকলেই আসতেন এবং স্বাধীনতা আন্দোলনে উৎসাহ প্রদান করতেন। একইভাবে সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হোসেন ভাইও সহযোগিতা ও উৎসাহ দিতেন। তিনি থাকতেন চামেলীবাগে। চামেলীবাগে আমাদের গোপন ঘাঁটি ছিলো। সিরাজ ভাই আমাদের জন্য খাবারও পাঠাতেন। অসহযোগ আন্দোলন ও উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে এই এলাকার ভূমিকা অপরিসীম। সিরাজুদ্দিন হোসেন, খান আতা প্রমুখের সহযোগিতার কথা স্বীকার করতেই হবে আমাদের। সেখানে আমরা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ধারা নিয়ে আলোচনা করতাম এবং কীভাবে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের রূপরেখা হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হতো। আতা ভাইয়ের কাছ থেকে নানা পরামর্শ ও সহযোগিতা আমরা পেতাম। আজকে অনেকেই যারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বড় বড় কথা বলে সেই সময় তাদের টিকিটাও দেখি নাই কিংবা সেই সময় তাদের নামও শোনা যায়নি।’
প্রিয় পাঠক, যে কোনো ছুতা নাতায়, সেটা খান আতাকে নিয়েই হোক অথবা অন্য কোনো ইস্যুতে হোক, এক শ্রেণির মানুষ যারা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন, তারা বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষকে দুই ভাগে নয়, চার/পাঁচ ভাগে বিভক্ত করার ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধা, অমুক্তিযোদ্ধা, দালাল-রাজাকার, স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ইত্যাদি ইস্যুর আড়ালে এরা যেটি করছে সেটি দেশকে ঐক্যবদ্ধ করে প্রগতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা নয়। এরা ক‚-চক্রী। আগেই বলেছি, ইস্যুটি ফয়সলা হয়ে গেছে ৪৩ বছর আগে। কীভাবে হয়েছে সেটি বলবো পরবর্তী কিস্তিতে। (চলবে)
Email: [email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।