পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
খন্দকার দেলোয়ার হোসেন
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিরল ব্যক্তিত্ব, অনন্য মানুষ, ভাষাসৈনিক, ’৯৬-এর গণঅভ্যুত্থানের বীরযোদ্ধা, মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম সংগঠক, অকুতোভয় রাজনীতিক, বিএনপির দুঃসময়ের অভিভাবক, অ্যাডভোকেট খন্দকার দোলোয়ার হোসেন আজ আমাদের মাঝে নেই। তার আজ ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি না থাকলেও তার স্মৃতি, অবদান ও কর্মকা- বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে। তিনি নিজেই একটি ইতিহাস। দার্শনিক এঙ্গেলস বলেছিলেন- Human being make their history themselves ‘মানবম-লী নিজেরাই নিজেদের ইতিহাস সৃষ্টি করে।’ বস্তুত খন্দকার দেলোয়ার হোসেন ছিলেন সময়ের সেই সাহসী পুরুষ যিনি নিজেই নিজের ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। বর্ষীয়ান রাজনীতিক খন্দকার দেলোয়ার হোসেন নিজ জেলা মানিকগঞ্জের পারিবারিক গোরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত। গণতন্ত্রের অকুতোভয় এ বীর ১/১১ এর পর তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অসুস্থ কর্মকা-ে অসুস্থ হয়ে প্রায়ই হাসপাতালে চলে যেতেন। আবার বেরিয়ে এসে সাহসের সঙ্গে যুক্তি কৌশল দিয়ে ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করতেন।
প্রবীণ এ জননেতার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের শেষ ক’টি বছর ছিল ঘটনাবহুল। একটি প্রতিকূল পরিবেশে দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপির মহাসচিবের দায়িত্ব নিয়ে ১/১১-এর শাসকদের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রাম চালিয়ে যান। তার এই সংগ্রামের ফলে রক্ষা পেয়েছিল বাংলাদেশের গণতন্ত্র।
তার চিরবিদায়ের অর্থ হলো, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী চেতনার একটি জানালা বন্ধ হয়ে যাওয়া।
অভিজ্ঞ এই রাজনীতিকের ইন্তেকাল নিঃসন্দেহে জাতীয়তাবাদী ধারার রাজনীতির অপরিসীম ক্ষতি। তিনি ছিলেন গণতন্ত্র ও নীতির প্রশ্নে আপসহীন লৌহমানব।
আপাদমস্তক রাজনীতিবিদ খন্দকার দেলোয়ার হোসেন ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন অত্যন্ত সাদাসিদে মানুষ। মাটি ও মানুষের জন্য রাজনীতি করার আদর্শ লালন করে সারাজীবন শেষ করেছেন যারা, তাদের সারিতে তার নাম চিরভাস্বর হয়ে থাকবে। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রত্যক্ষ রাজনীতির পাঠ নিয়ে যারা আজীবন রাজনীতিতে ডুবেছিলেন হাতেগোনা সেসব মানুষের একজন ছিলেন তিনি।
খন্দকার দেলোয়ার হোসেন ছিলেন নির্লোভ, নিরহঙ্কার, মানবতাবাদী, দৃঢ়চেতা, নীতির প্রশ্নে আপসহীন, গণতন্ত্রের অতন্ত্র প্রহরী আর বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী চেতনার বিশ্বাসীদের এক বলিষ্ঠ নেতা। মনে পড়ে খ্যাতনামা নাট্যকার হেনরিক ইবসেন (Henrik Ibsen) তার অত্যন্ত জনপ্রিয় নাটক An enemy of the people- এ লিখেছিলেন ‘ÔA community is like a ship everyone ought to be prepared to take the helm, একটি রাজনৈতিক সম্প্রদায় একটি জাহাজের মতো। এই জাহাজ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের জন্য প্রত্যেককে তৈরি হওয়া উচিত।’ সত্যিই মহাসচিব খন্দকার দেলোয়ার হোসেন বিএনপি নামক জাহাজের হাল ধরার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। যার প্রমাণ ১/১১ এর পর দুই বছর শাসনকালে তার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব।
আজ এ কথা স্বীকার্য যে, স্বাধীনতার পর আমাদের প্রিয় বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং রক্ষায় তিনজন মানুষের ভূমিকা প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে থাকবে। স্বাধীনতার পর শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃ প্রবর্তন করেছিলেন। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃ প্রবর্তন করেছেন এবং রক্ষায় এখনো সংগ্রাম করে চলেছেন। আর খন্দকার দেলোয়ার হোসেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হায়েনাদের হাত থেকে গণতন্ত্রকে রক্ষা করে গেছেন।
খন্দকার দেলোয়ার হোসেনের জীবন পর্যালোচনা করলে প্রতীয়মান হয় যে, তিনি ছিলেন মানবতা ও নৈতিকতার এক অপূর্ব সমন্বয়, যা বাংলাদেশের রাজনীতিতে খুব কমই দেখা যায়। জেডিবি মিলার (JDB Miller)--এর কথার প্রতিফলন ঘটেছিল খন্দকার দেলোয়ার হোসেনের জীবনে। মিলার বলেছিলেন- ‘ÔPolitics is a man of getting things done, often with a strong sense of moral urgency’‘তীব্র নৈতিকতাবোধ প্রসূত কল্যাণমূলক কর্মসম্পাদনের মাধ্যম রাজনীতি’।
বাংলাদেশের মানুষ ভোলেনি যে, একটি স্বাধীনতা দেশে পরাধীনতার আধুনিক শিকল পরানোর জন্য ১/১১ এর জন্ম দিয়েছিল কিছু সুবিধাভোগী দেশীয় সুশীলেরা এবং তাদের মাখন খাওয়া প্রবাসী সন্তানরা। ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে স্বাধীন বাংলার সূর্য যেভাবে ডুবে গিয়েছিল সেই একই অশনি বার্তা ছিল ১/১১ সরকারের অবৈধ কর্মকা-ে। খন্দকার দেলোয়ার হোসেন সেই বার্তা টের পেয়েছিলেন বলেই বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্রের স্বার্থে তা রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। অ্যাডভোকেট খন্দকার দেলোয়ার হোসেন মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯৫৭ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে (ন্যাপ) যোগ দিয়ে সক্রিয় রাজনীতি শুরু করেন। এ ছাড়া ছাত্রাবস্থায় তিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন এবং পরবর্তীকালে সে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সরকার তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে ন্যাপের প্রার্থী হয়ে ১৯৭০ সালে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক হিসেবে ভূমিকা রাখেন। ১৯৭৮ সালে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের গঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের জন্মলগ্ন থেকেই তিনি সংযুক্ত থেকে বিএনপির রাজনীতি শুরু করেন।
১৯৯০ সালে স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন সাত দলীয় লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য হিসেবে গণআন্দোলন সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে বাংলাদেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক অনন্য ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন। তিনি ২য়, ৫ম, ৬ষ্ঠ, ৭ম, ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে পাঁচবার সংসদে দায়িত্ব পালন করেন।
অপসংস্কৃতি, স্বজনপ্রীতি, বাকশালী ষড়যন্ত্র, স্বৈরাচারী মনোভাব ও আধিপত্যবাদের থাবা থেকে দেশের স্বার্থ রক্ষায় এবং গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় জনগণের ভাগ্য উন্নয়নে বিএনপির সব স্তরের নেতা-কর্মী সর্বদা তার অনুসৃত নীতি আদর্শ বাস্তবায়নে শ্রদ্ধাশীল থাকবÑ এ প্রত্যয় ব্যক্ত করছি।
আপাদমস্তক গণতান্ত্রিক এ নেতা মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে রাজনীতি করে দেশ, জাতি ও গণতন্ত্রের জন্য যে অবদান রেখে গেলেন তা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি ও তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। কবি বলেছেনÑ ‘যখন তুমি এসেছিলে ভবে/কেঁদেছিলে তুমি-হেসেছিল সবে/এমন জীবন তুমি করিবে গঠন/মরণে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন’।
খন্দকার দেলোয়ার হোসেনের জীবনে কবির সেই উক্তিগুলোর বাস্তব প্রতিফলন ঘটেছে। হাসতে হাসতে তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে। পেছনে পড়ে থাকল বেদনার্ত, শোকার্ত লক্ষ-কোটি মানুষ, নোনা জলে সিক্ত হলো যাদের কপোল।
হাবিব-উন-নবী খান
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।