Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চট্টগ্রামে প্রতিবন্ধী পিতাকে খুনের পর লাশ গুমের চেষ্টা

নরাধম হয়ে যাচ্ছে সন্তান পরিজন!

| প্রকাশের সময় : ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

রফিকুল ইসলাম সেলিম : ‘টাকার জন্য মায়ের সাথে বাবার ঝগড়া দেখে মাথায় রক্ত উঠে যায়। প্রথমে বাবাকে ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে আঘাত করি। মাথা ও ঘাড়ে কয়েবটি আঘাত করতেই তিনি ঘরের মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন। এরপর মা তার মুখে বালিশ চেপে ধরেন। খালা গলা চেপে ধরেন। এরপর আরও বেশ কিছুক্ষণ ব্যাট দিয়ে বুকে পেটে পিটাই। এরপর কাঁচি নিয়ে শরীরের বিভিন্ন অংশে খুঁচিয়ে খুুঁচিয়ে ছিদ্রের মতো করি। পরে বালিশ তুলে নাকে হাত দিয়ে ও হাতের শিরা দেখে নিশ্চিত হই বাবা মারা গেছেন।’
এভাবে নিজের জন্মদাতা প্রতিবন্ধী পিতাকে হত্যার বর্ণনা দিলেন পুত্র। সদরঘাট থানায় গতকাল (রোববার) পুলিশের সামনেই সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে পিতাকে খুনের দায় স্বীকার করে তার বর্ণনা দেয় সে। পরে তাকে আদালতে পাঠানো হয়। সেখানে সে ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। এর আগে শনিবার রাতে নগরীর সদরঘাট থানার রশিদ বিল্ডিং এলাকার বড় নর্দমায় বস্তাভর্তি লাশ ফেলে দেওয়ার সময় ধরা পড়ে আত্মস্বীকৃত এ খুনি পুত্র মোঃ সোহেল (২০)।
পরে পুলিশ নগরীর পশ্চিম মাদারবাড়ি টং ফকিরের মাজার এলাকার বাসা থেকে তার মা কোহিনূর বেগম (৪০) ও খালা জাহানারা বেগমকে (৪২) গ্রেফতার করে। আটক করা হয় লাশ ফেলতে সহযোগীতাকারী এক রিকশা চালকেও। পরে এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সোহেলের বোনকেও আটক করেছে পুলিশ। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) কোতোয়ালী জোনের সহকারি কমিশনার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সোহেল তার পিতাকে হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে। তাদের বাসা থেকে খুনের সব আলামতও সংগ্রহ করা হয়েছে।
সোহেল জানায়, তার পিতা তৈয়ব আলী (৫০) শারীরিক প্রতিবন্ধী। তার এক হাতের কবজি নেই। তাই তিনি ভারী কোন কাজ করতে পারতেন না। সোহেল একটি পোশাক কারখানার কর্মী, তার মাও একসময় পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। তাদের গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলায়। অভাব অনটনের কারণে প্রায় সোহেলের বাবা-মা ঝগড়া করতেন। সোহেলের দাবি প্রায় তার বাবা মাকে মারধর করতেন। শুক্রবার রাতেও তার বাবা মায়ের কাছে ৫০০ টাকা চায়। টাকা না পেয়ে তৈয়ব আলী তার স্ত্রী কোহিনূর বেগমকে গালি দিতে শুরু করেন। এসময় কোহিনূর বেগমও তাকে গালি দেন। মধ্যরাত পর্যন্ত তাদের ঝগড়া চলে।
সোহেল জানায়, এক পর্যায়ে সে বাসা থাকা কাঠের ব্যাট দিয়ে বাবাকে আঘাত করে। তিনি মাটিতে পড়ে গেলে তার মা ও খালা তাকে বালিশ দিয়ে চেপে ধরেন। ওই অবস্থায়ও সে তার বাবাকে ব্যাট দিয়ে আঘাত করতে থাকে। পরে নাকে হাত দিয়ে দেখে তিনি মারা গেছেন। এরপরও মৃত্যু নিশ্চিত করতে ঘরে থাকা একটি কাঁচির ডগা দিয়ে পুরো শরীরে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ছিদ্র করা হয়। পুলিশ জানায়, তৈয়ব আলীর শরীরে ৪৫ থেকে ৫০টির মতো গর্ত দেখা গেছে। প্রতিটি গর্তের গভীরতা প্রায় এক ইঞ্চি করে। লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরীকারী পুলিশ কর্মকর্তা জানান, কাঁচি দিয়ে গভীর ছিদ্র করা হয়েছে পুরো শরীরে।
সোহেল জানায়, পিতার মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর মা ও খালার পরামর্শে লাশ গুম করতে তা বস্তায় ভরা হয়। শনিবার দিনভর লাশ বাসায় বস্তায় রেখে ফেলে রাখা হয়। পরে তার এক বন্ধু ও এক পরিচিত রিকশা চালকের সহযোগীতায় বস্তাভর্তি লাশ রশিদ বিল্ডিং এলাকার কার্ভাডভ্যান স্ট্যান্ডের পেছনে বড় নর্দমায় ফেলে দিতে যায় তারা। এসময় এলাকার দারোয়ান নালায় কী ফেলা হচ্ছে জানতে চাইলে সোহেল, তার সাথে থাকা এক বন্ধু ও রিকশাচালক পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। সোহেলের ওই বন্ধু পালিয়ে গেলেও দারোয়ান স্থানীয়দের নিয়ে সোহেল ও রিকশাচালককে আটকে রেখে পুলিশে খবর দেয়। পরে পুলিশ গিয়ে সেখান থেকে লাশ উদ্ধার করে সোহেল ও রিকশাচালককে গ্রেফতার করে।
গ্রেফতার হওয়ার পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সোহেল তার বাবাকে হত্যার কথা স্বীকার করে। পরে তার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী টং ফকির এলাকার বাসা থেকে তার মা কোহিনূর, খালা জাহানারাকে গ্রেফতার এবং জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তার ছোট বোনকে আটক করা হয়। সোহেলের স্বীকারোক্তির বরাত দিয়ে পুলিশ কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, শারীরিক প্রতিবন্ধী তৈয়ব বিভিন্ন সময় টাকা-পয়সার জন্য ছেলে ও স্ত্রীকে নির্যাতন করে।
শুক্রবার রাতে তৈয়ব আলী বাসায় গিয়ে স্ত্রীর কাছ থেকে ৫০০ টাকা চায়। এসময় তারা টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানানোয় তৈয়ব আলীর সাথে তাদের গভীর রাত পর্যন্ত ঝগড়া হয়। ঝগড়ার এক পর্যায়ে রাত পৌনে ২টায় সোহেল তার বাবাকে কাঠের ব্যাট দিয়ে আঘাত করলে তিনি মাটিতে পড়ে যান। এসময় তার মা কোহিনূর ও খালা জাহানারা গলা টিপে ধরে। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে সে তার বাবার মুখে বালিশ চাপা দেয় এবং মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য কাঁচি দিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে ৪০-৫০টি আঘাত করে। পরে মা ও খালার সহায়তায় লাশটি বস্তায় ভরে রেখে দেয়।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রামে প্রায়ই স্বজনের হাতে স্বজন খুনের ঘটনা ঘটছে। ছেলের হাতে বাবা-মা, বাবার হাতে সন্তান, স্বামীর হাতে স্ত্রী, কিংবা স্ত্রীর হাতে স্বামী খুনের ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় দিনে দিনে নরাধম হয়ে যাচ্ছে পুত্র ও পরিবার পরিজনেরা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চট্টগ্রাম

৩০ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ