হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
মানব সভ্যতার ইতিহাসে ধর্মের অবদানই যে সর্বাধিক, এ সম্বন্ধে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। এর প্রধান কারণ এই বিশ্বজগৎ যাঁর সৃষ্টি, তিনিই মানুষ কিভাবে জীবন চালিয়ে বিশ্বের মানব জাতির শান্তি ও কল্যাণ নিশ্চিত করবে, তার বিধান দিয়েছেন ধর্মের মাধ্যমে। এ কারণে প্রকৃত ধর্ম একটিই। তবে আমরা যে আজ পৃথিবীতে বহু ধর্মের উপস্থিতি দেখতে পাই, তার মূলে রয়েছে এক ধরনের মানুষ কর্তৃক প্রকৃত ধর্মের বিকৃতি ও অপব্যবহার, যা শুধু ধর্মের মূল উদ্দেশ্যকেই ব্যর্থ করে দিচ্ছে না, ধর্মের নামে অধর্মের চরম দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করে ইতিহাসের পাতাকেও কলঙ্কিত করে চলেছে। এমনটা যে শুধু মধ্যযুগে ঘটেছে, তাও নয়। আজকের সভ্যতাগর্বী বিশ্বেও এমনটা দেদার ঘটে চলেছে। সাধারণ মানুষ পছন্দ করুক বা না করুক, এমনটা যে আজও ঘটে চলেছে, এটাই নির্মম বাস্তবতা।
প্রকৃত ধর্ম যে একটাই, তার কারণ সমগ্র বিশ্বজগতের ¯্রষ্টা ও প্রতিপালক একজনই। আর যেহেতু সমস্ত জীবজন্তু, সর্বোপরি সমগ্র মানবজাতি এক ¯্রষ্টার সৃষ্টি, তাই মানুষে মানুষে ভেদ-বৈষম্যের প্রশ্ন শুধু অবান্তরই নয়, বিশ্বের শান্তির নিরিখে অনাকাংখিতও বটে। আজ যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেশে মানুষে মানুষে নানা সমস্যা হচ্ছে তার মূলে রয়েছে বিশ্ব ¯্রষ্টার একত্ব এবং তাঁর সৃষ্ট মানবজাতির একত্ব সম্বন্ধে ভ্রান্ত ধারণা। এই ভ্রান্ত ধারণার অনিবার্য পরিণতিতে মানব জাতির বিভিন্ন অংশের মধ্যে রেষারেষি, অশান্তি ও হানাহানি দেখা দেয়ায় বিশ্বের অনেক দেশে শান্তি প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে।
দু:খের বিষয় সমগ্র বিশ্বে আমাদের প্রিয় জন্ম ভূমি বাংলাদেশ একটি শান্তিকামী দেশ হিসাবে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করতে সক্ষম হলেও আমাদের প্রতিবেশী কোন কোন দেশে প্রায়ই এমন সব দু:খজনক ঘটনা ঘটে চলেছে, যার উত্তাপ আমাদেরও সইতে হচ্ছে। হ্যাঁ, আমরা এখানে আমাদের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত (সাবেক বার্মা) বর্তমানের মিয়ানমার সম্পর্কেই বলতে চাইছি।
মিয়ানমারে সাম্প্রতিক অতীতে এক পর্যায়ের সেনা শাসন চালু হয়। সেনা শাসন শুরু হওয়ার পর সে দেশের অন্যতম আদি বাসিন্দা রোহিঙ্গাদের উপর শুরু হয় অকথ্য নির্যাতন। রোহিঙ্গাদের অপরাধ তারা ধর্ম বিশ্বাসে মুসলমান, আর বার্মার অধিকাংশ মানুষ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। পৃথিবীতে এমন কোন দেশ পাওয়া যাবে না, যেখানে শুধু এক ধর্মের লোক বাস করে। বাংলাদেশ মুসলিম প্রধান দেশ হলেও এদেশে বাস করে অনেক হিন্দু ও খৃস্টান। এদেশের পূর্বাঞ্চলীয় পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক বৌদ্ধ বাস করে। বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের আরাকানে (বর্তমানের রাখাইন) মুসলমান বাস করবে, এতে আশ্চর্যের কিছু নেই।
অথচ বার্মায় সেনা শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এই রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে শুরু হয় অকথ্য নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণের অভিযান। রোহিঙ্গাদের বাড়ী ঘরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। মোটের উপর যেসব কাজে রোহিঙ্গাদের আদি জন্ম ভূমিতে তাদের টিকে থাকা তাদের জন্য অসম্ভব হয়ে যায়, তার কোনটাই বাকী রাখেনি বার্মার সেনা বাহিনী।
অগত্যা প্রাণ বাঁচাতে রোহিঙ্গারা তাদের পশ্চিম দিকে অবস্থিত বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে চেষ্টা করে। কিন্তু বাংলাদেশও পৃথিবীর অন্যতম জনবহুল দেশ। স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশ এই বাড়তি জনসংখ্যার বোঝা বহন করতে অক্ষম হলেও মানবিকতার কারণে অসহায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে বাধ্য হয়। পাশাপাশি বাংলাদেশ জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে এই মানবিক বিপর্যয়ের দিকে।
আগেই বলা হয়েছে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা-খেদা অভিযান শুরু হয় যে দেশে সেনা শাসন প্রতিষ্ঠার পর। তখন সে দেশের গণতন্ত্রকামী নেত্রী অং সান সূচি ছিলেন গৃহবন্দী। অনেকেরই সেদিন আশা ছিল দেশে যদি কোন দিন গণতন্ত্র ফিরে আসে তবে রোহিঙ্গাদের দু:সময়ের অবসান হবে, তারা মিয়ানমারের অন্যতম আদিবাসী হিসাবে তাদের সকল মানবাধিকার ফিরে পাবে। এর পর এক পর্যায়ে সূচির সাথে সেনা শাসকদের কী একটা সমঝোতা হল। একটা নির্বাচন হল। অং সান সূচির দল তাতে সেনা বাহিনীর সাথে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অংশীদার হল।
দু:খের বিষয় মিয়ানমারে বর্তমানে যে শাসন চলছে, তাকে কোন বিচারেই গণতান্ত্রিক শাসন বলা চলে না। গণতন্ত্রে কখনও জনগণের কোন অংশকে মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত করার অবকাশ থাকে না। দেশে অং সান সূচির দল ক্ষমতায় রয়েছে। অথচ সেনা বাহিনী আগের মতই রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সবরকম বর্বর নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। এই পটভূমিতে বিশ্বের বহু গণমাধ্যমে অং সান সূচিকে গণতন্ত্রের খলনায়িকা এবং মিয়ানমারের বর্বর সেনা বাহিনীর হাতের পুতুল বলে আখ্যায়িত করতে বাধ্য হচ্ছেন।
মিয়ানমারের বর্বর সেনা বাহিনী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যে নির্মম নির্মূল অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে, তার বিরুদ্ধে টু শব্দটিও উচ্চারণ করছেন না এককালের গণতন্ত্রী নেত্রী হিসাবে খ্যাত শান্তির জন্য নোবেল বিজয়ী অং সান সূচি। প্রশ্ন আসে তবে কি মিয়ানমারের এই তথাকথিত গণতান্ত্রিক নেত্রীও মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর রোহিঙ্গা নির্মূল অভিযানের প্রতি বাস্তবে সমর্থন দানেরই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন?
অবশ্য মিয়ানমারের সেনাবাহিনী বা গণতান্ত্রিক নেত্রী অং সান সূচি রোহিঙ্গা নির্মূল অভিযানের প্রতি সমর্থন দানের সাহসই পেতেন না যদি মিয়ানমারের উগ্রপন্থী বৌদ্ধ ধর্ম নেতাগণ এই অভিযানের প্রতি জোর সমর্থন না জানাতেন। সেই নিরিখে বলা চলে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যে চরম অমানবিক নির্মূল অভিযান চলছে মিয়ানমারে, তার জন্য মূলত দায়ী এই উগ্রপন্থী বৌদ্ধ ধর্ম নেতৃবৃন্দ। অথচ বৌদ্ধ ধর্ম পৃথিবীতে যে প্রধান পরিচিতি পেয়েছে তা অহিংস ধর্ম হিসাবে। আমরা জানি না, মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের বিতাড়নের পেছনে যে বৌদ্ধ ধর্মনেতাদের মূল প্ররোচনা রয়েছে, তারা বৌদ্ধ ধর্মের মূল ইতিহাস আদৌ কখনও পাঠ করেছেন কিনা?
পাঠ করে থাকলে তারা জানতেন, বর্তমানে যে হিন্দু ও মুসলিম নামের দুটি সম্প্রদায় উপমহাদেশে প্রধান ধর্ম-সম্প্রদায় হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে তাদের ধর্মের জন্ম এই উপমহাদেশে হয়নি। অথচ বৌদ্ধ ধর্মের জন্ম হয় উপমহাদেশে। পরবর্তীকালে এক পর্যায়ে বৌদ্ধ-বিদ্বেষী এক কট্টর হিন্দু শাসকের আমলে উপমহাদেশ থেকে বৌদ্ধ বিতাড়ন অভিযান শুরু করা হয়। সেই অভিযানের সমর্থক ধর্মগুরুদের ধর্মীয় দিক নির্দেশনায় বলা হয়েছিল : কোন বৌদ্ধকে দেখা মাত্র যে হত্যা করবে, সে চিরকাল স্বর্গবাসী হবে। আর কোন বৌদ্ধকে দেখার পরও তাকে যে হত্যা না করবে তাকে চিরকালের জন্য নরকগামী হতে হবে। এই বক্তব্যে প্ররোচিত হওয়ার ফলে সারা উপমহাদেশে যে বৌদ্ধ গণহত্যা শুরু হয় তার ফলে প্রাণে বাঁচতে বৌদ্ধরা উত্তরে চীন, তিব্বত প্রভৃতি অঞ্চলে, পূর্বে বার্মা, থাইল্যাÐ, জাপান প্রভৃতি দেশে এবং দক্ষিণে শ্রীলঙ্কায় পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। যারা পালাতে না পেরে থেকে যেতে বাধ্য হয় উপায়ন্তের না দেখে তাদের অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। সে নিরিখে এদেশের অনেক মুসলমানের পূর্ব পুরুষ বৌদ্ধ ছিলেন।
বৌদ্ধদের প্রকৃত ইতিহাস সম্বন্ধে নজির বিহীন অজ্ঞতা নিয়ে আজ মিয়ানমারের যেসব উগ্রপন্থী বৌদ্ধ ধর্মনেতারা রোহিঙ্গা নির্মূল অভিযানে প্ররোচনা যুগিয়ে চলেছেন, তারা এর মাধ্যমে ধর্মের নামে শুধু চরম অর্ধমের কাজই করে চলেছেন না, উপায়ন্ত এর মাধ্যমে তারা অহিংসার ধর্ম বৌদ্ধ ধর্মকে নিজেদের অজান্তেই কলংকিত করে চলেছেন।
ধর্মের নামে অর্ধমের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শনের জন্য এবার আমরা আমাদের আরেকটি প্রতিবেশী দেশ ভারতের কিছু সাম্প্রতিক ঘটনার অবতারনা করব। ধর্ষণের দায়ে ভারতের এক ধর্মগুরু গুরমিত রাম সিংকে সে দেশের আদালত ২০ বছরের কারাদÐ দিয়েছে। হরিয়ানার পাঁচকোলার সিবিআইয়ের বিশেষ আদালতের বিচারক জগদীপ সিং রোহতাকের সুপারিয়ারকেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়ে জেলের ভিতরে তৈরী হওয়া বিশেষ আদালতের এজলাসে এই সাজা ঘোষণা করেন। এর আগের শুক্রবার সিবিআই আদালত তাকে দোষী সাব্যস্থ করে। এর পরই ধর্মগুরুর ভক্তরা হিংসায় মেতে উঠেছিল। হরিয়ানা পাঞ্জাব তো মেতে উঠেছিলই হরিয়ানা পাঞ্জাব ছাড়িয়ে হিংসার আগুন দিল্লীর দোরগোরায়ও পৌঁছে যায়। এ সহিংসতার ৩৮ জনের মৃত্যু ঘটে। ২০০২ সালে সিরসা আশ্রমের দুই নারীকে ধর্ষণের অভিযোগে পুলিশ স্ব:ত প্রনোদিত হয়ে মামলা দায়ের করেছিল। এর আগে ধর্ষিত এক নারী তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীসহ বিভিন্ন দপ্তরে ধর্ষণের বিবরণ জানিয়ে চিঠি দিয়েছিলেন। এর পরই মামলা শুরু হয়। সিবিআইয়ের বিশেষ আদালত প্রায় ১৪ বছর মামলাটি চলার পর স্বঘোষিত ধর্মগুরুকে দোষী সাব্যস্ত করেন আদালত।
উপমহাদেশের জনগণ ধর্মভক্ত। সেই হিসাবে তারা ধর্মগুরুদেরও বিশেষ মর্যাদা দিতে আগ্রহী। কিন্তু ধর্মগুরুরা নিজেরা যেখানে ধর্মের মর্যাদা নষ্ট করে অধর্মের চরম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন সেখানে আইন ও আদালতের চোখে তারা দোষী সাব্যস্ত হবেন তাতে আর বিচিত্র কি!
ধর্ম প্রকৃত প্রস্তাবে মানুষের জীবনে মহত্তম দিক-নির্দেশনার উৎস। সেই ধর্মকে যদি ধর্মের সাথে সংশ্লিষ্টরা অপব্যবহারের মাধ্যমে অমর্যাদা ও কলঙ্কিত করে তোলে, তা হলে তার জন্য ধর্ম অপব্যবহারীদের দোষী সাব্যস্ত না করে উপায় কি? মিয়ানমারের উগ্র বৌদ্ধ ধর্মগুরুরা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বর্বরতা চালাতে প্ররোচিত করে যে জঘন্য অন্যায় করেছেন, ভারতের স্বঘোষিত ধর্মগুরুরা ঠিক একইভাবে ধর্মের অপব্যবহারের মাধ্যমে ধর্মের বদনাম ডেকে এনেছেন। তাদের এসব অপকর্মের জন্য ধর্ম দায়ী না হলেও এ দায় থেকে ধর্মগুরুদের রেহাই পাবার যে কোন পথই নেই তা বলাই বাহুল্য।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।