Inqilab Logo

শুক্রবার ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ন্যায়বিচার করলেই হবে না তা দৃষ্টিগোচর হতে হবে

ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার রায়-১৭

ইনকিলাব ডেস্ক : | প্রকাশের সময় : ২৪ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

 ১৯৯৮ সালে কমনওলেথ লেটিমার হাইজ নীতিমালায় (Latimer House Guidelines for the Commonwealth) বলা হয়, ‘বিচর বিভাগে নিয়োগের ক্ষেত্রে একটা যথোপযুক্ত স্বাধীন প্রক্রিয়া থাকতে হবে। যেখানে কোন স্বাধীন ব্যবস্থা ইতোমধ্যে চালু হয় নি সেখানে সংবিধান কিংবা বিধিবদ্ধ আইনের মাধ্যমে গঠিত একটি কমিশনের মাধ্যমে নিয়োগসমূহ সম্পন্ন করতে হবে। যথাযথভাবে গঠিত কমিশনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হোক কিংবা না হোক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় বিচার বিভাগের সকল পর্যায়ে নিয়োগের জন্য নির্বাচিত ব্যক্তিদের গুণগত মান ও মনের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাার ব্যবস্থা থাকবে।’
আগেই বলা হয়েছে, সংবিধানের ৯৫(২)(গ) অনুচ্ছেদে ইতিপূর্বে উচ্চতর বিচার বিভাগে বিচারকদের মানদন্ড/যোগ্যতা নির্ধারণের বিষয়ে আইন পাসের কথা বলা হয়েছে, যাতে করে প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার অধিকারী জনগণকে কোন্্ বৈশিষ্টের গুণে নতুন বিচারকরা বিচার বিভাগের পদে নিয়োগের জন্য যোগ্য বিবেচিত হয়েছেন এবং নির্বাচনের জন্য কি পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে তা অবহিত করা যায়। নিয়োগ পদ্ধতিতে সৃযোগ-সুবিধার সাম্য, মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ, নারী-পূরুষের বৈষাম্য রোধ, সততা এবং টেকনিক্যাল, নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধের মত অন্যান্য মানদন্ড, ভাষার ওপর দখলের বিষয় প্রতিফলিত থাকতে হবে এবং সব শেষে অনুধাবন ও রায় প্রদানের সক্ষমতা প্রমাণিত হতে হবে। একটা প্রবাদ আছে, ‘ ন্যায়বিচার শুধু করলে হবে না, ন্যায়বিচার করা হয়েছে তা দৃষ্টিগোচর হতে হবে।’ (Justice shall not only be done it shall also seen to have been done,)।
ধর্ম, লিঙ্গ, কিংবা রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নির্বিশেষে সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তিদের মধ্য থেকে এই নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। বিচারক হিসেবে যেমুহূর্তে তিনি শপথ নিলেন সেমুহূর্ত থেকে তিনি কি ছিলেন আর কি হতে পারতেন তা ভুলে গিয়ে তাকে মনে রাখতে হবে যে, তিনি একটি নতুন জীবনের পথে যাত্রা শুরু করেছেন। তিনি নিজেকে একজন পক্ষপাতহীন বিচারক হিসেবে মেনে নিয়ে সেভাবে চিন্তা করতে, কথা বলতে এবং মর্যাদাশীল চালচলন ও আচার-আচরণ বজায় রাখবেন, যাতে করে ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য জনগণ তার ওপর আস্থা রাখতে পারে। এ প্রসঙ্গে আমি আরও যোগ করতে চাই যে, উচ্চ কিংব নিম্ন আদালত নির্বিশেষে একজন যোগ্য ব্যক্তিকে নিছক নিয়োগদানই শেষ কথা নয়। এজন্য যথাযথ বিচারিক শিক্ষাগত প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এ প্রসঙ্গে পর্যাপ্ত তহবিল দিয়ে একটি বিচার বিভাগীয় সংস্থার নিয়ন্ত্রণাধীনে প্রথাগত ও প্রচলিত প্রশিক্ষণের আয়োজন করতে হবে। বিচার বিভাগীয় প্রশিক্ষণের মধ্যে থাকবে আইনের শিক্ষাদান, বিচারিক দক্ষতা এবং নৈতিক ও নারী-পূরুষ ইস্যুসহ সামাজিক বিষয়; যাতে করে জ্ঞান, বিশেষ করে আধুনিক বিশ্বের ঘটনাবলী সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়া যায়। আধুনিক ঘটনাবলীর সাথে সাথে বিচারিক দক্ষতাও হালনাগাদ হয়। যৌক্তিকতা প্রমানের জন্য একটি প্রাচীন প্রবাদ তুলে ধরছিঃ ‘বিচারালয় যতই সমৃদ্ধ হবে, রায় ততই সমৃদ্ধ হবে।’ (More rich the Bar is, more rich the judgments are.) এবং এ বিপরীত। বিরাজমান প্রেক্ষাপটে মানোন্নয়নের জন্য বিজ্ঞ অ্যাডভোকেটদের যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রদান অত্যন্ত অরিহার্য। অন্যথায় সুষ্ঠু বিচার প্রশাসন ব্যবস্থা পরিচালনা ও তা বজায় রাখা খুবই দুরূহ হয়ে পড়বে। ২৬-৯-২০০১ তারিখে বিচারপতি শ্রী এইচ আর খান্নার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে ভারতীয় জাতীয় কমিশন সুপিরিয়র জুডিশিয়ারি সংক্রান্ত পরামর্শপত্রে উল্লেখ করে, ‘বিচর বিভাগের নিষ্কলুষ নাম, এর স্বাধীনতা এবং এর ভাবমর্যাদা সুরক্ষায় শীর্ষ বিচার বিভাগের (Superior Judiciary) সদস্যদের মধ্যকার বিপথগামী আচরণের দৃষ্টান্তের বিষয়ে সুষ্ঠুভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং তা পরিশুদ্ধকরণ আমাদের উদ্বেগের বিষয়। কিছু অযোগ্য ব্যক্তির কারণে বিচার বিভাগের ভাবমর্যাদা কুলষিত হচ্ছে। এটি রোধ করতে হবে। কেননা বিচার বিভাগের ভাবমর্যাদা ও সুখ্যাতি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। শীর্ষ আদালতে ভাবমর্যাদা কার্যকারিতা বৃদ্ধির সহায়ক কৌশল তৈরি করা সমভাবে জরুরি।’
যেহেতু শীর্ষ আদালত সংবিধানের রক্ষক, সেহেতু এই আদালত ভয়-ভীতি ও অনুকম্পা ছাড়া কিংবা কোন চাপ বা হুমকির মধ্যেও বাদী পক্ষের অধিকারের ব্যবস্থা গ্রহণে বিচারিক নীতিমালা অনুসরণ করবে।
উপরের পর্যবেক্ষণ থেকে এটা স্পষ্ট যে, ৯৫অনুচ্ছেদের সঙ্গে সংগতি রেখে নিয়োগ প্রক্রিয়া সুষ্পষ্টভাবে নিয়মানুযায়ী বর্ণিত হতে হবে। ‘প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আলোচনা’-এর বিষয়টি আরও উন্মুক্ত করতে হবে, যাতে করে এটি শুধু প্রধান বিচারপতি ও নির্বাহী বিভাগের প্রতিনিধির মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে এবং অর্থবহ ও বাস্তব হয়। এতে করে প্রার্থীদের প্রজ্ঞার ক্ষমতা ও দুর্বলতা সম্পর্কে মূল্যায়নের জন্য প্রধান বিচারপতি তার স্বতীর্থ ভ্রাতৃবৃন্দ ও আদালতের সিনিয়র সদস্যদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে পারবেন।
সুপ্রিম কোর্ট অ্যাডভোকেট এসোসিয়েশন বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া মামলয় [(১৯৯৩)(৪)এসসিসি ৪৪১] ‘ন্যায়বিচার সুরক্ষা এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার স্বার্থে’ এস পি গুপ্তের মামলার সুপ্রিম কোর্টের ৯ জন বিচারপতির মধ্যে ৭ জনই মামলাটির সিদ্ধান্ত নাকচ করার পর ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট বিচারক নিয়োগের সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি নির্ধাারণ করে। সেখানে বলা হয় যে, ‘দুই জন সিনিয়র মোস্ট বিচারকের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে প্রধান বিচারপতি এ ব্যাপারে সুপারিশ তৈরি করবেন এবং এই সুপারিশকে নির্বাহী বিভাগ কর্তৃক স্বাভাবিকভাবে কার্যকারিতা দিতে হবে.....এবং বিচারক নির্বাচনের বিষয়টি বিচার বিভাগের হাতে থাকবে.....।’
এছাড়াও আমি আমাদের দেশের জন্য একটা বিষয় যোগ করতে চাই। সেটি হচ্ছে, দুই জন সিনিয়র মোস্ট বিচারকের মতামত গ্রহণকালে প্রধান বিচারপতি হাইকোর্টের বিচারক এবং সিনিয়র সদস্যদের কাছ থেকেও মতামত নিতে পারেন, কেননা তাদের কাছাকাছি কিংবা তাদের সঙ্গে সদস্যরা থাকেন। তাছাড়া কোন বিশেষ প্রার্থীর/আইনজীবীর জ্ঞানের গভীরতা, আচার-ব্যবহার এবং বিচারক হিসেবে নিয়োগ পেলে তিনি ন্যায়বিচারের প্রতি কতটা দায়িত্বশীল হবেন সে সম্পর্কে বিচার বিভাগই ভাল জানে। যথাযথ যাচাই-বাছাইয়ের পর একবার এ ধরণের ব্যাপক পদ্ধতি গ্রহণ করা হলে ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রছাড়া কোন বিচারককে অপসারণের জন্য কোন শাস্তিমূলক ব্যাবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন পড়বে না। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা দেশে ও বিদেশে বেশ কয়েকটি সিদ্বান্তের মৌলিক বিষয় হওয়ায় এর প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা প্রয়োজন, যাতে করে এই স্বাধীসতার ধারণা বিচারক নিয়োগ ও অপসারণ উভয় ক্ষেত্রে নির্বাহী কিংবা অন্য কোন প্রভাব বিস্তারকারীকে দূরে রাখার বিষয়টি সংগতিপূর্ণ হতে হয়।
সে যা-ই হোক,অনুচ্ছেদ ৯৫(২) পাঠ করার পর প্রতীয়মান হয়েছে যে, এই অনুচ্ছেদটিতে উচ্চতর বিচার বিভাগে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে অযোগ্যতার বিষয়টি তিনটি ক্যাটাগরিতে বর্ণিত হয়েছে। তবে ৯৫ ও ৯৬ অনুচ্ছেদ দুটি একসঙ্গে পড়লে জানা যাবে, সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগের মানদন্ড কি হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ষোড়শ সংশোধনী

৫ নভেম্বর, ২০১৭
১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ