Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সচেতন নাগরিক ও জুরিরা অনেক সংশোধনী চ্যালেঞ্জ করেছেন

ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার রায়-১৩

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ২০ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম


দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধান পাস করার সময় আইনসভা সচেতনভবে রক্ত স্নাত সংবিধানের প্রস্তাবনায় অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে নিম্নোক্ত বিষয় জুড়ে দেয়ঃ
আমরা বাংলাদেশের জনগণ ---------------
অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতার সেই সকল মহান আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে;
আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি য়ে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা--যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে; ---এতদ্বারা--- আমরা এই সংবিধান রচনা ও বিধিবদ্ধ করিয়া সমবেতভাবে গ্রহণ করিলাম।
সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ঃ [৭] (১) প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে।
(২) জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোন আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসমঞ্জস্য হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে। ]
বৈষম্য অর্জনের লক্ষ্য হাসিলে সংবিধান প্রণেতারা এর দ্বিতীয় ভাগে (অনুচ্ছেদ ৮ থেকে ২৫) রাষ্ট্রীয় নীতির মৌলিক নীতিমালা বর্ণনা করেন। যেখানে ৮ অনুচ্ছেদে বল হয়েছেঃ
[৮। (১) জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও ধর্ম নিরপক্ষতা-এই নীতিসমূহ হইতে উদ্ভূত এই ভাগে বর্ণিত সকল নীতি রাষ্ট্র পরিচালনার মূল নীতি বলিয়া পরিগণিত হইবে।
(২) এই ভাগে বর্ণিত নীতিসমূহ বাংলাদেশ-পরিচালনার মূল নীতি হইবে, আইন প্রণয়নকালে রাষ্ট্র তাহা প্রয়োগ করিবেন। এই সংবিধান ও বাংলাদেশের অন্যান্য আইনের ব্যাখ্যাদানের ক্ষেত্রে তাহা নির্দেশক হইবে এবং রাষ্ট্র ও নাগরিকদের কার্যের ভিত্তি হইবে, তবে এই সকল নীতি আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য হইবে না।]
সংবিধানের ৫৫ অনুচ্ছেদের আওতায় ক্ষমতা অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন। ৬৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদকে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে এবং ষ্ষ্ঠ ভাগের প্রথম পরিচ্ছেদের বিভিন্ন অনুচ্ছেদে দেয়া এখতিয়ারসহ ৯৪ অনুচ্ছেদের আওতায় আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ এই দুইটি বিভাগসহ সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ৯৪(৪) অনুচ্ছেদে বিচার বিভাগীয় কার্যক্রম চালানোর জন্য প্রধান বিচারপতি ও অন্যান্য বিচারককে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। অপরদিকে ২২অনুচ্ছেদে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণের ব্যবস্থা রেখে বলা হয়েছেঃ ‘২২৷ রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমূহ হইতে বিচারবিভাগের পৃথকীকরণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন৷’ অর্জিত সাফল্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আইন প্রণয়নকারীরা সঠিকভাবে অনুধাবন করেছিলেন যে, রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান যথা নির্বাহী, আইনসভা (সংসদ) ও বিচার বিভাগকে সংবিধানের চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ ভাগে বর্ণিত অন্য কোন অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের হস্তক্ষপছাড়াই নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে তাদেরকে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। অন্যথায় শহীদদের চরম আত্মত্যাগ বৃথা যাবে এবং অর্থহীন হয়ে পড়বে। বিগত ৪৬ বছরে ১৯৭২ সালের মূল সংবিধান বেশ কয়েকবার সংশোধিত হয়েছে/অনেক ধারা বাতিল হয়েছে/কিছু অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সচেতন নাগরিক ও জুরিরা এরূপ সংশোধনীর অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ করেছেন। মুখলেসুর রহমান মামলা থেকে শুরু করে অষ্টম সংশোধনী মামলা, মাসদার হোসেন মামলা, ১০ বিচারক মামলা, পঞ্চম সংশোধনী মামলা, ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলা, ইত্যাদির মত অনেক মামলা সংবিধানের সঙ্গে সঙ্গতিহীন দেখতে পেয়ে এই আদালত এরূপ অনেক সংশোধনী ও আইনকে নিয়মনীতি বিরুদ্ধ (ultra vires) বলে পদ্ধতিগতভাবে ঘোষনা করেছে। উপমহাদেশের বেশ কিছু সিদ্ধান্তের ওপর ভিত্তি করে এবং অন্য এখতিয়ারভুক্ত অন্য জুরিদের মতামত বিবেচনা করে এই আদালত মনে করে যে, অন্যান্যের মধ্যে ‘সার্বভৌমত্ব’, ‘সংবিধানের আধিপত্য’, ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা’, এবং ‘আইনের শাসন’ সংবিধানের মৌলিক কাঠামো। মাসদার হোসেন মামলায় এই ডিভিশন বেঞ্চ বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে যে, বিচার বিভাগ বিচারিক কার্যক্রম পরিচালানোর সঙ্গে সরাসরি জড়িত নিজস্ব প্রশাসনিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য এই বিভাগকে বিশেষ করে সংসদ ও নির্বাহী বিভাগ থেকে মুক্ত করতে হবে। সুতরাং যতক্ষণ পর্যন্ত অন্য দুটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান থেকে বিচার বিভাগ সম্পূর্ণভাবে না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অর্জিত হবে না। অন্যথায় সংবিধানের আওতায় নিয়োগকৃত বিচারকরা তাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে তারা যে স্বাধীন সেকথা অনুভব করতে পারবেন না। এই মামলার নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে আমাদের মূলত বিচার্য সংবিধানের ৯৪, ৯৫, ও ৯৬ অনুচ্ছেদ। ষোড়শ সংশোধনীতে ৯৬ অনুচ্ছেদে সংশোধনী আনা হয়েছে। এই অনুচ্ছেদে বিচারকদের চাকরির সীমা সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে ৯৬ অনুচ্ছেদে যা ছিল তা প্রথম সংশোধন করা হয় ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে। এতে উচ্চতর আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছ থেকে নিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির কাছে দেয়া হয়। তিনি কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান সাপেক্ষে এরূপ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন। তবে এই ক্ষমতাই শুধু দেয়া হয়েছে, কিন্তু আগেই বর্ণিত অনুবিথি ব্যতিত নতুন কোন বিধি বা আইন কখনও করা হয় নি। এর পর সামরিক শাসনামলে ১৯৭৭ সালের ১ জানুয়ারি তৎকালীন সামরিক শাসক 2nd Proclamation (Tenth
Amendment) Order 1977 ১৯৭৭ -এর মাধ্যমে ৯৬ অনুচ্ছেদ আবারও সংশোধন করে। তখন এতে প্রজাতন্ত্রের ৯৬(৩) অনুচ্ছেদের আওতায় গঠিত সুপ্রিম জুডিশিয়ার কাউন্সিলের কাছ থেকে রিপোর্ট চাওয়ার ভিত্তিতে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি কতৃক বিচারকদের অপসারণ করার পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়। ১৯৭৯ সালে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে এটির অনুমোদন, নিশ্চিতকরণ ও বৈধতা দেয়া হয়।
(সংশোধনী ঃ গত ১৮ তারিখে দৈনিক ইনকিলাবের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত ‘ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার রায়-১১’ -এর প্রথম বাক্যে প্রথম বন্ধনীর মধ্যে ভুলে ‘প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা’ লেখা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এখানে হবে ‘বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকি’। এই ত্রুটির জন্য আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত। --বার্তা সম্পাদক)



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ষোড়শ সংশোধনী

৫ নভেম্বর, ২০১৭
১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ