Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৪ মে ২০২৪, ১০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৫ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

‘মৌলিক কাঠামো পরিবর্তনের ক্ষমতা সংসদকে দেয়া হয়নি’

ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার রায়-১১

ইনকিলাব ডেস্ক : | প্রকাশের সময় : ১৮ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আমাদের সংবিধানে প্রদত্ত বিচারকদের অপসারণের বিবর্তন সম্পর্কে আমি (প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা) আগেই আলোচনা করেছি। এই মামলায় বিচারকদের অপসারণের বিধান সম্বলিত ষোড়শ সংশোধনীতে আমাদের মৌলিক কাঠামো লঙ্ঘিত হয়েছে কি না সে ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে হবে। সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদ এবং ৭খ অনুচ্ছেদের আওতায় সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতার মধ্যে সংবিধােেনর মৌলিক কাঠামো পরিবর্তনের ক্ষমতা সংসদকে দেয়া হয় নি। সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর মধ্যে রয়েছে সাংবিধানিক নীতিমালা। এগুলো এমনই মৌলিক যে তা সংশোধনের ক্ষমতা সীমিত।
১৪২ অনুচ্ছেদ বলা হয়েছে ঃ [এই সংবিধানে যাহা বলা হইয়াছে, তাহা সত্তে¡ও-
(ক) সংসদের আইন-দ্বারা এই সংবিধানের কোন বিধান সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন বা রহিতকরণের দ্বারা সংশোধিত হইতে পারিবেঃ
তবে শর্ত থাকে যে,
(অ) অনুরুপ সংশোধনীর জন্য আনীত কোন বিলের সম্পূর্ন শিরোনামায় এই সংবিধানের কোন বিধান সংশোধন করা হইবে বলিয়া স্পষ্টরুপে উল্লেখ না থাকিলে বিলটি বিবেচনার জন্য গ্রহণ করা যাইবে না;
(আ) সংসদের মোট সদস্য-সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে গৃহীত না হইলে অনুরুপ কোন বিলে সম্মতিদানের জন্য তাহা রাষ্ট্রপতির নিকট উপস্থাপিত হইবে না;
(খ) উপরি-উক্ত উপায়ে কোন বিল গৃহীত হইবার পর সম্মতির জন্য রাষ্ট্রপতির নিকট তাহা উপস্থাপিত হইলে উপস্থাপনের সাত দিনের মধ্যে তিনি বিলটিতে সম্মতিদান করিবেন, এবং তিনি তাহা করিতে অসমর্থ হইলে উক্ত মেয়াদের অবসানে তিনি বিলটিতে সম্মতিদান করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে।]
অপরদিকে ৭খ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ঃ [সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, সংবিধানের প্রস্তাবনা, প্রথম ভাগের সকল অনুচ্ছেদ, দ্বিতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদ, নবম-ক ভাগে বর্ণিত অনুচ্ছেদসমূহের বিধানাবলী সাপেক্ষে তৃতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদ এবং একাদশ ভাগের ১৫০ অনুচ্ছেদসহ সংবিধানের অন্যান্য মৌলিক কাঠামো সংক্রান্ত অনুচ্ছেদসমুহের বিধানাবলী সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন, রহিতকরণ কিংবা অন্য কোন পš’ায় সংশোধনের অযোগ্য হইবে।]
এ বিশ্লেষণ থেকে এই উসংহারে পৌঁছানো যাবে যে, সংবিধানের কোন সংশোধনীতে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো বদলানো হলে সেটাকে অসাংবিধানিক ঘোষনা করা যাবে এবং করতে হবে। সন্দেহ ও বিরোধ নেই যে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংবিধানের মৌলিক কাঠামো। ক্ষমতার অবাধ প্রয়োগ রোধে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ধারণা গড়ে উঠেছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হারিয়ে গেলে তা চিরতরে চলে যায়, আর ফিরিয়ে আনা যায় না। এই আদালত কখনই সংবিধানে প্রদত্ত ক্ষমতায় পাস করা বলে প্রতীয়মান আইনের সংবিধানিকতার চূড়ান্ত বিচারক হিসেবে তার সাংবিধানিক কার্যক্রম পরিত্যাগ করে নি। বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক বলেন, ‘অনুরূপভাবে যে-ই হোক না কেন এবং যা-ই হোক না কেন আমরা বাংলাদেশ যে একটি প্রজাতন্ত্র সে অবস্থান থেকে বিচ্যূত ও নমনীয় হব না। আমাদের অবশ্যই এ দেশকে একটি প্রজাতন্ত্র হিসেবে তুলে ধরতে হবে।’ {মামলাঃ সিদ্দিক আহমেদ বনাম বা!লাদেশ সরকার, ৩৩ বিএলডি (এডি) ১২৯}। অনুরূপভাবে মোঃ শোয়াইব বনাম বাংলাদেশ সরকার (২৭ ডিএলআর ৩১৫) মামলায় বিচারপতি ডি সি ভট্টাচার্য বলেন, ‘লিখিত সংবিধানের অধীনে পরিচালিত দেশে রাষ্ট্রের নির্বাহী প্রতিষ্ঠান তথা অন্যান্য পতিষ্ঠানের সকল ক্ষমতার উৎস সংবিধান। এই সংবিধানে জনগণের ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে এ কথা সুষ্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, সংবিধান জসগণের ইচ্ছার পরম প্রকাশ হওয়ায় এটি প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন। প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতা এবং সেগুলোর প্রয়োগ কেবলমাত্র সংবিধানের আওতায় ও কর্তৃত্বে হতে হবে।
সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ঃ [৭ / (১) প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে।
(২) জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোন আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসমঞ্জস্য হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে। ]
প্রধান বিচারপতি জন মার্শাল সতর্ক করে দেন যে, ‘জনগণই সংবিধান তৈরি করেছে এবং তারাই আবার এটি ভাঙতে পারে।’ সংবিধানে রূপায়িত হয়েছে ‘ আমরা জনগণই’ এর (সংবিধানের) চূড়ান্ত প্রভূ ও সুবিধাভোগী। সংবিধানে প্রজাতন্ত্রের প্রথম প্রতিজ্ঞায় অন্তর্লিখিত হয়েছে ন্যয়বিচার। এর অর্থ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় প্রজাতন্ত্রের মালিক কোটি কোটি জনগণের পক্ষে ন্যয়বিচারের প্রতিশ্রæতি বাস্তবায়ন করবে। ‘একটি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে জনগণের ইচ্ছাই সবার ওপরে এবং রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানকেই জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। একই সঙ্গে বিচার বিভাগকে স্বাধীন, সুষ্ঠু ও প্রভাবমুক্তভাবে কাজ করতে দেয়া রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব। তাই, আমাদের বীর শহীদরা যে লক্ষ্যে আত্মত্যাগ করেছিলেন সেই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা তথা জনগণের সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, জনগণের প্রতি জবাবদিহিতা, স্বাধীনতার ঘোষনা, জাতীয় স্বাধীনতার ঐতিহাসিক সংগ্রাম, জাতীয়তাবাদের নীতিমাল, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র সুরক্ষার জন্য মূল সংবিধানের ৯৬(২) অনুচ্ছেদে প্রদত্ত বিধান সাপেক্ষে আইনসভাকে সুপ্রিকোর্টের তিনজন শীর্ষ (ঝবহরড়ৎ সড়ংঃ) বিচারককে নিয়ে কোন বিচরকের অসদাচরণ ও অসমর্থ্যতা তদন্তের ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রধান বিচারপতিসহ তিনজন শীর্ষ বিচারককে দিয়ে তদন্ত অনুষ্ঠান একটি পদ্ধতি। এতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সুরক্ষিত হতে পারে এবং সে ক্ষেত্রে সংবিধানের ৭খ অনুচ্ছেদ সংবিধান সংশোধনের পথে কোন বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। এই সংযোজন করা যেতে পারে এই করণে যে আমাদের সংবিধান জাতির ভিত্তিমূলক দলিল। এটি শুধুমাত্র আইন নয়, বরং ‘আইনের ওপর আইন।’ সাংবিধানিকভাবে এরূপ কোন বিধান না থাকায় সংবিধানের অন্যতম মৌলিক কাঠামো বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বিতর্কিত সংশোধনী দ্বারা লঙ্ঘিত হতে যাচ্ছে। এ কারণে বিচার বিভাগ দারুণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ভবিষ্যতে (এ নিয়ে) আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম সোরগোল তুলতে পারে। রাশিয়ার কয়েকজন বিচারকের ব্যাপারে বিচারপতি ব্রেয়ারের বিবৃতিতে অন্তত এ কথারই প্রতিধ্বনি শোনা যায়। ১৯৭১ সালে যার জন্য ৩০ লাখ লোক শহীদ হয়েছে, এদেশের মানুষ তেমন একটি বিচার ব্যবস্থা চালু রাখতে চায়। রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করা আমাদের পবিত্র দায়িত্ব, যাতে করে বিচার বিভাগ সুষ্ঠুভাবে এবং সংবিধান ও এ দেশের অন্যান্য আইন অনুযায়ী তারা ভূমিকা পালন করতে সক্ষমতা, সম্পদ ও প্রয়োজনীয় স্বাধীনতা অর্জন করতে পারেন। আইনের শাসনের জন্য পূর্বশর্ত হচ্ছে একটি স্বাধীন ও যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনকারী বিচার াবভাগ। এর জন্য প্রয়োজন সঠিক আইন ব্যবস্থা এবং সুষ্ঠু শুনানি ও ন্যয়বিচার প্রাপ্তির অধিকার। স্বাধীন-নিরপেক্ষবিচার বিভাগ ছাড়া গণতন্ত্র টিকে থাকতে পারে না। সুপ্রিমকোর্টকে সংবিধানের হেফাজতকারী হিসেবে কাজ করতে এবং বিচার বিভাগেকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে দেয়া রাষ্ট্রের সব অঙ্গ বা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব। অন্যথায় প্রলয় কান্ড ঘটতে আর বাকি থাকবে না।



 

Show all comments
  • Urmi ১৮ আগস্ট, ২০১৭, ২:৫৯ এএম says : 0
    Many many thanks to The Daily Inqilab for this news
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ষোড়শ সংশোধনী

৫ নভেম্বর, ২০১৭
১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ