Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চট্টগ্রামে বড় দুই দলের অঙ্গ সংগঠনে বেহাল দশা

রফিকুল ইসলাম সেলিম | প্রকাশের সময় : ১৮ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

চট্টগ্রামে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির অঙ্গ সংগঠনে এখন বেহাল দশা। বছরের পর বছর কমিটি ছাড়াই চলছে এসব সংগঠনের কার্যক্রম। আর এই কারণে লেগে আছে কলহ, কোন্দল, গৃহবিবাদ। ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ সংগঠন ছাত্রলীগ, যুবলীগ আর স্বেচ্ছাসেবক লীগে খাই খাই অবস্থা চলছেই। টেন্ডারবাজি আর দখলবাজিতে সংঘাত সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ছে তারা। ক্ষণে ক্ষণে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করছে ছাত্রলীগ-যুবলীগ।
দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকলেও ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের অভ্যন্তরে রেষারেষি আর দলাদলি কমেনি। রাজপথের আন্দোলেনে দেখা না গেলে পদ-পদবি পাওয়ার লড়াইয়ে তাদের জুড়ি নেই। শ্রমিক আন্দোলন বলতে গেলে এখন আর কিছুই নেই। তার পরেও দুই দলে আছে একাধিক শ্রমিক সংগঠন। সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চলছে শ্রমিক লীগের দাপট। জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের তেমন কোন তৎপরতা নেই। তবে বড় দুই দলের নারীরা সক্রিয় আছেন রাজনীতিতে। মহিলা লীগ আর মহিলা দলের কমিটিও হয়েছে সম্প্রতি। উভয় শিবিরে নিজেদের মধ্যে দলাদলি আর রেষারেষি থাকলেও চট্টগ্রামের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে নারীদের উপস্থিতি বাড়ছে।
অঙ্গ সংগঠন বিশেষ করে ছাত্রলীগ ও যুবলীগকে নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বিভিন্ন ক্যাম্পাসে দফায় দফায় সংঘাত সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে তারা। ছাত্রদল ছাত্রশিবিরকে অনেক আগেই ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করে ছাত্রলীগ। এরপর নিজেদের প্রতিদ্ব›দ্বী নিজেরা। নিজেরা নিজেরাই খুনোখুনিতে লিপ্ত হচ্ছে। ছাত্রলীগের কলহে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ক্যাম্পাসে একাধিক লাশ পড়েছে। দলীয় কোন্দলে পাড়ায়-মহল্লায়ও সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। রেলের টেন্ডারবাজি নিয়ে সিআরবিতে জোড়া খুনের ঘটনা ঘটে। ছাত্রশিবিরকে হটিয়ে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম কলেজ ও মহসিন কলেজ দখল করার পর নিজেদের মধ্যে সংঘাত সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে ছাত্রলীগ। দু’টি কলেজের সবকটি ছাত্রাবাস বন্ধ দীর্ঘদিন। এসব ছাত্রাবাসে শিবির কর্মীরা থাকে ছাত্রলীগের এমন অভিযোগের পর প্রশাসন ছাত্রাবাসগুলো বন্ধ করে দেয়। এখন ক্যাম্পাসকে ঘিরেই ছাত্রলীগ সংঘাত সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে প্রতিনিয়ত। এর ফলে চরম আতঙ্কে রয়েছে দু’টি কলেজের কয়েক হাজার শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকেরা।
ছাত্রলীগের সহিসংতার পর কেন্দ্র থেকে কিছু নেতাকে বহিষ্কার করা হচ্ছে। তবে বহিষ্কৃত নেতারা ঘুরেফিরেই থেকে যাচ্ছে ছাত্রলীগে। সংঘাতের জেরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কমিটি বাতিল করা হয়। তবে সেখানে সহিংসতার ঘটনা চলছেই। বাতিল কমিটির নেতারাই ক্যাম্পাসে নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম কলেজেও ছাত্রলীগের কোন কমিটি নেই বলে কেন্দ্র থেকে বলা হয়েছে। তবে কে শোনে কার কথা, সবকিছু চলছে ছাত্রলীগের নামে। তাদের কর্মকান্ডে এখানকার নেতারাও এখন ত্যাক্ত-বিরক্ত। ছাত্রলীগের এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী গ্রুপ আর আ জ ম নাছির উদ্দীন গ্রুপের বিরোধ মেটাতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকেও একাধিকবার চট্টগ্রাম আসতে হয়। এরপরও বিরোধের অবসান হয়নি। বেপরোয়া ছাত্রলীগের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না।
ছাত্রলীগের দাপটে এ অঞ্চলের বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অন্য ছাত্র সংগঠনের প্রকাশ্য কোন তৎপরতা নেই। এর ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক ছাত্র রাজনীতির গণতান্ত্রিক চর্চা এখন বন্ধ। চাকসুসহ কোন কলেজেই নেই ছাত্র সংসদ নির্বাচন। ছাত্রদের দাবি আদায়ের আন্দোলনের চেয়ে ক্যাম্পাসে উন্নয়ন কর্মকান্ডের দিকেই নজর ছাত্র নেতাদের। কোথাও আবার ছাত্র সংগঠনগুলোর ভর্তি বাণিজ্যের শিকার হতে হচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের। ছাত্রলীগের একচ্ছত্র দখলবাজির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারেনি জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ এ অঞ্চলের কোন ক্যাম্পাসে তাদের কোন শক্ত অবস্থান ছিল না। বেশিরভাগ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের কমিটি নেই। মহানগর ও জেলায় কমিটি থাকলেও তা মেয়াদোত্তীর্ণ। সরকার বিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদলের ভূমিকা চোখে পড়ার মতো নয়। তবে নিজেদের মধ্যে পদপদবি নিয়ে তাদের মারামারিতে লিপ্ত হতে দেখা যায়। মহানগর এবং জেলায় রাজপথে সক্রিয় ছিল এমন অনেক ছাত্রদল নেতা এখন কারাগারে। সরকার বিরোধী আন্দোলনে নির্মম খুনের শিকারও হয়েছেন অনেকে। মিথ্যা মামলায় ঘরছাড়া অনেক ছাত্রদল নেতা। অভিযোগ রয়েছে, কমিটি গঠনের সময় ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন করা হয়নি। নেতাদের পছন্দের যারা তাদের কমিটিতে পদ দেওয়া হয়। আর এ কারণে ছাত্রদলের রাজনীতিতে স্থবিরতা বিরাজ করছে।
সরকারী দলের অঙ্গ সংগঠন যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগে কলহ-বিরোধ চরমে। টেন্ডারবাজি, সরকারি বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে মূলত এ বিরোধ। এ দুই সংগঠনের অনেক নেতার বিরুদ্ধে দখল-বেদখল, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজির অভিযোগ আছে। যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নামে অপরাধের বিভিন্ন ঘাট নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। ছাত্রলীগের মতো যুবলীগেও কলহ-বিরোধ লেগেই আছে। এর জেরে মহানগরী এবং জেলার বিভিন্ন এলাকায় সংঘাত সহিসংতা ও খুনোখুনির ঘটনাও ঘটছে। যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগে মহানগর এবং জেলা কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে অনেক আগে। যথাসময়ে সম্মেলন ও কমিটি না হওয়ায় সাংগঠনিকভাবে স্থবির এসব সংগঠন। মাঠের বিরোধী দল বিএনপির অঙ্গ সংগঠন যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলেও কলহ কোন্দলের কমতি নেই। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকার পরও পদ-পদবি নিয়ে বিরোধ রয়েছে নেতাদের মধ্যে। এ দু’টি সংগঠনের কিছু নেতার বিরুদ্ধেও জমি দখলসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ রয়েছে।
বন্দর শিল্পাঞ্চলের জন্য বিখ্যাত চট্টগ্রামে শ্রমিক আন্দোলন এখন যেন ইতিহাস। শ্রমিক আন্দোলন বলতে যা বোঝায় তার কিছুই এখন আর অবশিষ্ট নেই। শ্রমিক লীগ ও তাদের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখার নেতারা আন্দোলন সংগ্রামের চেয়ে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে দাপিয়ে বেড়ানোকে লাভজনক মনে করছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তাদের দাপটে সাধারণ শ্রমিকরা অনেকটা অসহায়। সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক লীগের দাপটে অনেক কর্মকর্তাও অসহায়। এসব প্রতিষ্ঠানের টেন্ডারবাজি থেকে শুরু করে সবকিছুই তাদের নিয়ন্ত্রণে। পক্ষান্তরে এসবের বিরুদ্ধে কোন আওয়াজ তুলতে পারেনি জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল। শ্রমিক দলের তৎপরতা ঝিমিয়ে পড়েছে অনেক আগে। মহানগরে কমিটি থাকলেও সাংগঠনিক তৎপরতা নেই। শ্রমিক দলের সদস্যদের সাথে কথা বলে জানা যায়, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় শ্রমিক লীগের একক আধিপত্য শুরু হয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। শ্রমিক দলের তৎপরতা না থাকায় অনেকে বাধ্য হয়ে শ্রমিক লীগের সাথে আপোষ করে দিন পার করছে।
আওয়ামী লীগ-বিএনপি উভয় দলেই নারীরা সক্রিয় রয়েছে। মহিলা লীগ ও জাতীয়তাবাদী মহিলা দল মাঠে ময়দানে কর্মসূচি পালন করছে। উভয় শিবিরে কলহ বিরোধ থাকলেও রাজনীতিতে তারা সক্রিয় রয়েছে। সম্প্রতি মহিলা লীগ ও মহিলা দলে মহানগর ও জেলা কমিটি হয়েছে। মহিলা লীগে সম্মেলন করে নতুন কমিটি গঠন করা হয়েছে। সীমিত আকারে হলেও মহিলা দলও সম্মেলন করে কমিটি করেছে। পদ-পদবি নিয়ে মহিলা লীগ এবং মহিলা দলে বিরোধ থাকলেও সাংগঠনিক কর্মকান্ড অব্যাহত আছে। সরকারি দল আওয়ামী লীগের অনেক গুরুত্বপূর্ণে থাকা নেতারা রাজনৈতিক কর্মকান্ডে নিষ্ক্রিয় রয়েছেন। এ নিয়ে দলের অভ্যন্তরে অসন্তোষ বিরাজ করছে। পক্ষান্তরে নারী নেত্রীদের প্রায় সকলেই রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছেন। সরকারি দলের বিভিন্ন কর্মসূচিতে নারী নেত্রীদের উপস্থিতিও বাড়ছে। বিএনপির মাঠ রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছেন নারীরা। পুলিশি নির্যাতনের মুখেও মহিলা দলের অনেক নেত্রীকে বিভিন্ন কর্মসূচিতে সক্রিয় দেখা যাচ্ছে। সরকারি দল আওয়ামী লীগের শরিক ১৪ দলের ছাত্র সংগঠনও মাঠে-ময়দানে সক্রিয় রয়েছে। বিভিন্ন ইস্যুতে তারা ক্যাম্পাসে মিছিল সমাবেশ করছে। অন্যদিকে ২০ দলের শরিক দলগুলোও ছাত্র সংগঠনের সীমিত তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। তবে কোন ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে তাদের তৎপরতা নেই।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চট্টগ্রাম

৩০ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ