Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে বন্যা

প্রকাশের সময় : ১৪ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১২:১২ এএম, ১৪ আগস্ট, ২০১৭

একযোগে ফুলে-ফুঁসে উঠেছে দেশের প্রধান নদ-নদী : গজলডোবার সব গেট খুলে দেয়ায় ধেয়ে আসছে পানি, তিস্তা এলাকায় রেড এলার্ট সরিয়ে নেয়া হয়েছে এলাকাবাসীকে : শিশুসহ ২১ জনের মৃত্যু : লাখ লাখ একর ফসল পানির নিচে : দুর্যোগ মোকাবিলায় ছুটি বাতিল

ইনকিলাব ডেস্ক : বন্যা দিন দিন বিস্তৃত হচ্ছে। নদ-নদীপাড়ের শহর-গঞ্জ-জনপদে ভাঙন বাড়ছেই। একে একে তলিয়ে যাচ্ছে হাজারো বসতঘর ফসলি জমি হাট-বাজার রাস্তাঘাট। গত ২৪ ঘণ্টায় দিনাজপুরে ১৪, কুড়িগ্রামে ৬ এবং ঠাকুরগাঁয়ে একজনের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল (রোববার) সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত যমুনা-ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা-পদ্মা ও মেঘনা অববাহিকায় অবস্থিত নদ-নদীগুলো একযোগে ফুলে-ফুঁসে উঠেছে। চলতি মৌসুমে দ্বিতীয় দফায় গতকাল ব্রহ্মপুত্র নদ বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। উত্তর জনপদের ব্রহ্মপুত্রের পানি ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী পয়েন্টে বিপদসীমার ৩৯ সেমি উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। প্রধান এই নদ নুনখাওয়া পয়েন্টেও পানি বেড়ে গিয়ে বিপদসীমার কাছাকাছি চলে গেছে। অপরদিকে ভারতের উজানে গঙ্গার পানির ভাটির দিকে সৃষ্ট চাপে বিশেষত ফারাক্কা বাঁধের পানি ছেড়ে দেয়ার কারণে ভাটিতে পদ্মা নদীতে পানি ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়ে এখন বিপদসীমার খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। নদী ও পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ সূত্র ইনকিলাবকে জানায়, মূলত গত দু’সপ্তাহের টানা অতিবৃষ্টি-জনিত বন্যায় ভারতের উজানভাগ থেকে পানির ঢল-বান বা চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে। যেখানে অভিন্ন নদ-নদীগুলোর ৭০ থেকে ৯৪ শতাংশ পর্যন্ত পানি প্রবাহের মূল উৎস। আবার দেশের অভ্যন্তরেও ভারী বর্ষণে পানি আরো কিছুটা বেড়েছে। দেশের প্রধান নদ-নদীর তিনটি অববাহিকায় (যমুনা-ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা-পদ্মা ও মেঘনা) একযোগে পানি বৃদ্ধি পাওয়া বড় ধরনের বন্যার আশঙ্কা বহন করে। এ অবস্থায় দেশের উত্তরাঞ্চল, মধ্যাঞ্চল এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিস্তৃত হচ্ছে বন্যা ও বন্যার কারণে নদীভাঙন। গতকাল সর্বশেষ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের (সরাসরি বন্যা কবলিত ১৫ জেলায়) ১৬টি নদ-নদী ২২টি পয়েন্টে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এদিকে দেশের ব্যাপক এলাকা বড় ধরনের বন্যার কবলে পড়ার পরই অবশেষে টনক নড়েছে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষের। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় এর বিভাগসমূহ এবং রেডক্রিসেন্ট ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) বন্যাজনিত দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সবধরনের ছুটিছাঁটা বাতিলের দির্দেশ দেয়া হয়েছে।
চট্টগ্রাম থেকে শফিউল আলম জানান, নদ-নদী প্রবাহের পরিস্থিতি ও বন্যা পূর্বাভাসে গতকাল জানা যায়, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদ, গঙ্গা-পদ্মা এবং সুরমা-কুশিয়ারা নদ-নদীসমূহের পানির সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি আগামী ৭২ ঘণ্টায় অর্থাৎ পরবর্তী তিন দিনেও অব্যাহত থাকতে পারে। গঙ্গা-পদ্মা নদ-নদীর পানির সমতল বৃদ্ধি আগামী ৭২ ঘণ্টায়ও অব্যাহত থাকবে। সিলেটের সুরমা-কুশিয়ারা নদী দু’টির পানি বৃদ্ধি আগামী ২৪ ঘণ্টায় অব্যাহত থাকতে পারে। বিশেষজ্ঞ সূত্র জানায়, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা এবং গঙ্গা-পদ্মা এই প্রধান দুই নদ-নদী অববাহিকায় বাংলাদেশের প্রান্তে মূল নদী শাখা ও উপনদীগুলোতে আগামী ১৬ আগস্ট পর্যন্ত পানির প্রবাহ বৃদ্ধির বর্তমান প্রবণতা বজায় থাকতে পারে। এতে করে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতির আশঙ্কা রয়েছে। দেশের মোট ৯০টি নদী পর্যবেক্ষণ পয়েন্টের মধ্যে গতকাল ৭৭টিতে পানি বৃদ্ধি পায় এবং ১২টিতে হ্রাস পায়।
পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র সূত্র জানায়, মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকায় দেশের অনেক জায়গায় নদ-নদী অববাহিকায় ভারী বর্ষণ হয়েছে। যদিও তা আগের দিনের চেয়ে ছিল কম। গত ২৪ ঘণ্টায় নদ-নদী পর্যবেক্ষণ স্টেশনগুলোর মধ্যে ১০০ মিলিমিটারের উপরে বৃষ্টিপাত হয়েছে ৭টি স্থানে এবং ৫০ মিমির উপরে বৃষ্টি হয় ২০টি স্টেশনে। গত শনিবার ১০০ মিমির উপরে বর্ষণ হয় ১৫টি এবং ৫০ মিমির উপরে বৃষ্টি হয় ৩৮টি পয়েন্টে। গতকাল সর্বোচ্চ বর্ষণ হয়েছে লরেরগড়ে ২০০ মিমি। প্রসঙ্গত দীর্ঘমেয়াদি আবহাওয়া পূর্বাভাসে, চলতি আগস্ট মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত, বঙ্গোপসাগরে একাধিক লঘুচাপ, একটি মৌসুমি নিম্নচাপ সৃষ্টি এবং দেশের উত্তর, উত্তর-পশ্চিম এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বন্যার আশঙ্কার বিষয়টি জানানো হয়েছিল। তাছাড়া ভারতে গত মে-জুন মাস থেকেই স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি বর্ষণের পূর্বাভাস দেয়া হয়।
বন্যা পরিস্থতি ও নদ-নদী প্রবাহের তথ্য-উপাত্তে, ১৬টি নদ-নদী ২২টি পর্যবেক্ষণ পয়েন্টে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। শনিবার ১৪টি নদ-নদী ২১টি পয়েন্টে বিপদসীমা অতিক্রম করে। গতকাল কয়েকটি নদী বিপদসীমার খুব কাছাকাছি থেকে পানি বৃদ্ধি পায়। বিপদসীমা অতিক্রম করে প্রবাহিত উল্লেখযোগ্য নদ-নদীসমূহের সর্বশেষ অবস্থান হচ্ছে- অন্যতম প্রধান অববাহিকায় ব্রহ্মপুত্র নদ গতকাল বিপদসীমা অতিক্রমের পর কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী পয়েন্টে ৩৯ সেমি উপরে এবং নুনখাওয়া পয়েন্টে পানির সমতল বিপদসীমার কাছাকাছি (মাত্র ১৭ সেমি নিচে) রয়েছে। যমুনা নদে গতকাল পানি আরো বেড়ে গিয়ে এখন ৪টি পয়েন্টেই বিপদসীমা অতিক্রম করে গেছে। এগুলো হচ্ছে বাহাদুরাবাদে ৭৭ সেমি উপর দিয়ে, সারিয়াকান্দিতে ৫৩ সেমি উপরে, কাজীপুরে ৫৫ সেমি এবং সিরাজগঞ্জে ৬৩ সেমি উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। উত্তরের অন্যতম নদী তিস্তা নীলফামারী জেলার ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ৪০ সেমি উপরে প্রবাহিত হচ্ছিল। উত্তর জনপদের ধরলা নদীর পানি কুড়িগ্রামে আরও মারাত্মকভাবে বেড়ে গিয়ে বিপদসীমার ১২৪ সেমি উপরে, বদরগঞ্জে যমুনেশ্বরী ১১০ সেমি উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। উত্তর জনপদের সাথে দেশের মধ্যাঞ্চলেও গতকাল বিস্তৃত হয়েছে বন্যা। ঢাকা বিভাগের টাঙ্গাইলের এলাসিনঘাটে ধলেশ্বরী নদীর পানি বেড়ে গতকাল বিপদসীমার ১০ সেমি উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।
অপররদিকে গঙ্গা-পদ্মার অববাহিকায় পানি ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। সর্বশেষ গতকাল পদ্মা নদী গোয়ালন্দ পয়েন্টে বিপদসীমার মাত্র ২৩ সেমি নিচে ছিল। এছাড়া পদ্মা ও গঙ্গার সবক’টি পয়েন্টে পানি বেড়েই চলেছে। একই অববাহিকায় অবস্থিত দিনাজুপরে পুনর্বভা নদী বিপদসীমার ৭৮ সেমি উপরে, ঠাকুরগাঁও জেলায় টাঙ্গন নদী বিপদসীমার ৬০ সেমি উপরে ছিল।
বৃহত্তর সিলেটে সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানি আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। এরমধ্যে সুরমা কানাইঘাটে বিপদসীমার ১০৫ সেমি, সিলেটে ৩০ সেমি এবং সুনামগঞ্জে ৮২ সেমি উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। কুশিয়ারা নদীর পানিও আর বেড়ে গিয়ে অমলশীদে ৭৪ সেমি এবং শেওলায় ৬৪ সেমি উপরে প্রবাহিত হচ্ছিল। মনু নদী মৌলভিবাজারে বিপদসীমার ২৯ সেমি উপরে, জাদুকাটা নদী লরেলগড়ে বিপদসীমার ২৯ সেমি উপরে, সোমেশ্বরী নদী দুর্গাপুর পয়েন্টে ৬৪ সেমি উপরে এবং কংস নদী নেত্রকোণা জেলার জারিয়া জঞ্জাইল পয়েন্টে পানি আরো ভয়াবহ হারে বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ১৮২ সেমি উপরে প্রবাহিত হয়। দেশের দক্ষিণ-পূর্ব পার্বত্য অববাহিকা তথা বৃহত্তর চট্টগ্রামে বিভিন্ন নদ-নদীতে গত দু’দিনে পানি বাড়লেও গতকাল কর্ণফুলী নদী ছাড়া অন্যগুলোতে পানি হ্রাস পায়।
বিশেষজ্ঞ সূত্র জানায়, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদ এবং পদ্মা-গঙ্গায় পানি গত সপ্তাহের তুলনায় এখন বেশি হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভারতের উজানভাগের ঢলের পানি আসা অব্যাহত রয়েছে। সাব-হিমালয় অঞ্চল, গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ ও সিকিম এবং আসাম, অরুণাচল, মেঘালয়সহ উত্তর-পূর্ব ভারতে অতিবৃষ্টির কারণে সেখানকার বন্যার পানি ভাটিতে বাংলাদেশে নামছে। তাছাড়া ব্রহ্মপুত্রের উজানে তিব্বত চীন থেকেও ধেয়ে আসছে পানি। এ অবস্থায় আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত উজানের পানির স্রোত বা ঢলের তোড় অব্যাহত থাকার শঙ্কা থেকে যাচ্ছে।
উত্তরাঞ্চলে বন্যা দুর্গতদের পাশে সেনাবাহিনী
আইএসপিআর জানায়, সেনাবাহিনীর আরো ২টি প্লাটুনসহ মোট ৩ প্লাটুন সৈন্য সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনের অনুরোধে বন্যা দুর্গতদের উদ্ধার কাজে মোতায়েন করা হয়েছে। রংপুর জেলার গঙ্গাচড়া উপজেলায় শহর রক্ষা বাঁধ ভেঙে এলাকা তলিয়ে যায়। সেখানে উদ্ধার কার্যক্রম ও বাঁধ রক্ষার জন্য প্রাথমিকভাবে একটি প্লাটুন মোতায়েন করা হয়। এছাড়াও দিনাজপুরে তিস্তা বাঁধে ফাটল দেখা দেওয়ায় সেখান থেকে পানি প্রবেশ করে তলিয়ে যাওয়া এলাকার পানি বন্দীদের উদ্ধার কাজে অপর একটি প্লাটুন নিয়োজিত রয়েছে। এছাড়াও সেনাবাহিনীর একটি পর্যবেক্ষক দল তিস্তা ব্যারেজ পরিদর্শনের জন্য গমন করেছে।
উল্লেখ্য, গত শনিবার রংপুর অঞ্চলে বন্যা দূর্গত মানুষের উদ্ধার কাজে নামে সেনাবাহিনী। ঠাকুরগাঁও শহরের কাংগন নদীর পানি বেড়ে সমগ্র এলাকা তলিয়ে গেলে সেখানে ৮৪টি পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়ে। এ সময় বেসামরিক প্রশাসনের পাশাপাশি ৬৬ পদাতিক ডিভিশন এর অধীনস্থ ৯ ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়নের এক প্লাটুন সেনাসদস্য ৪টি ট্রাইশাক বোট, ৬টি ওবিএম, প্রয়োজনীয় লাইফ জ্যাকেট ও অন্যান্য উদ্ধার সামগ্রী নিয়ে উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করে। তারা সেখান থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পানিবন্দী মানুষ, গবাদিপশু ও গৃহস্থালি সামগ্রী উদ্ধার করে। সেনাবাহিনী সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে এবং স্থানীয় প্রশাসনের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করছে।
গজলডোবার সব গেট উন্মুক্ত : তিস্তা এলাকায় রেড এলার্ট
নীলফামারী সংবাদদাতা জানান, ভারী বর্ষণ আর উজানের ঢলে তিস্তা নদী ফুঁসে উঠেছে। সময়ের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পানি। তিস্তার পানি গতকাল সকাল থেকে বিপদসীমার ৪০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচেছ। ফলে তিস্তায় রেড এলার্ট জারী করে মানুষজনকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। ভারতীয় একাধিক গনমাধ্যম ও বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া খবরে জানা যায়, ভারতের গজলডোবা ব্যারেজের ৫৪টি সøুইসগেট খুলে দেওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সূত্রমতে, ভারতের গজলডোবা ব্যারেজর উজানে দো-মোহিনী পয়েন্টে গত কয়েকদিন ধরে অবিরাম বর্ষণ হচ্ছিল। পানির চাপ সামলাতে গজলডোবার সবকটি গেট খুলে দিয়েছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। গজলডোবার গেট খুলে দেয়ার কারণে তিস্তার বাংলাদেশ অংশে হু হু করে বাড়ছে পানি। উজান হতে ঢল বাংলাদেশের তিস্তা নদীতে ধেয়ে আসছে। এতে করে তিস্তা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। এদিকে ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজার রহমান জানান, ভারতের দো-মোহনী পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে ধেয়ে আসছে বাংলাদেশে। তাই আমাদের অংশে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। সেই সাথে তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি সøুইচ গেট খুলে রেখে সতর্ক দৃষ্টি রাখা হয়েছে।
কুড়িগ্রামে দুই লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী : ৪ জনের মৃত্যু
শফিকুল ইসলাম বেবু, কুড়িগ্রাম থেকে জানান, কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র ও ধরলা, তিস্তা ও দুধকুমারসহ সবগুলো নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। কুড়িগ্রাম-রংপুর মহাসড়কের সাড়ে চার কিলোমিটার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় কুড়িগ্রামের সাথে সারাদেশের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে নাগেশ্বরী, ভুরুঙ্গামারী ও ফুলবাড়ী উপজেলাসহ সোনাহাট স্থল বন্দরের যোগাযোগ ব্যবস্থা।
কুড়িগ্রাম সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল বরকত মোঃ খুরশিদ আলম জানান, কুড়িগ্রাম-রংপুর মহাসড়ের সাড়ে ৪ কিলোমিটার ও কুড়িগ্রাম-ভুরুঙ্গামারী সহড়ের সাড়ে ৯ কিলোমিটার সড়ক পানিতে তলিয়ে আছে। এরমধ্যে কুড়িগ্রাম ভুরুঙ্গামারী সড়কের পাটেশ্বরী এলাকায় দুইটি পয়েন্টে ধ্বসে গেছে।
কুড়িগ্রাম পৌরসভা এলাকার ভেলাকোপায় দুলু মিয়ার দেড় বছরের শিশু বাবু বন্যার পানিতে ডুবে ও কুড়িগ্রাম সদরের হলোখানা ইউনিয়নের খামার হলোখানায় খালেকের স্ত্রী জোসনা (২৫) এর সাপের কামড়ে মৃত্যু হয়েছে। এছাড়াও আরো দু’জনের মৃত্যু ও দু’জন নিখোঁজ রয়েছে বলে জানা গেছে। বন্যার পানিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তলিয়ে যাওয়ায় বন্ধ করে দেয়া হয়েছে সাড়ে ৫শ’ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ধরলা, ব্রহ্মপুত্র এবং দুধকুমারের পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে জেলার ৬০ ইউনিয়নের দুই লক্ষাধিক মানুষ। তলিয়ে গেছে ৪০ হাজার হেক্টর জমির রোপা আমন ক্ষেত।
লালমনিরহাটে ৫ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি
লালমনিরহাট থেকে মোঃ আই্য়ুব আলী বসুনীয়া জানান, জেলায় স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। বর্তমানে তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার ৬৫ সেঃ মিঃ ধরলা নদীর পানি বিপদসীমার ১১০ সেঃ মিঃ ও অন্যান্য নদীর পানি অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার ৫ লাখ মানুষ পানি বন্দি হয়ে পড়েছে। পানি উন্নয়ন র্বোডের ৬টি বাঁধ পানির তোড়ে ভেঙে গেছে। রেল লাইনের উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হওয়ায় কাকিনা- বুড়িমারী রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। গতকাল দুপুর ২টায় দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ৬৫ সেঃমিঃ তিস্তার পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয়েছে। ব্যারাজের সবগুলো কপাট খুলে পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। সেচ প্রকল্পের বন্যা পুর্ভাবাস কেন্দ্র জানায়, ’৮৮ সালের বন্যাকেও হার মানিয়েছে। অপরদিকে ধরলাসহ অন্যান্য নদীর পানি বিপদসীমার ১১০ উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় লালমনিরহাট সদর উপজেলার প্রায় সব কটি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। জেলার ৩৫টি ইউনিয়নের ৬০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন অন্তত ৫ লাখ মানুষ। তলিয়ে গেছে ঘরবাড়ী, রাস্তাঘাট, স্কুল, কলেজ, মসজিদ মাদরাসাসহ অসংখ্য স্থাপনা। যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার কারণে দুর্গত এলাকায় বানভাসী মানুষগুলোর জন্য শুকনো খাবার সরবরাহে বিঘœ হচ্ছে। খাবার পানির তীব্র সঙ্কট দেখা দেয়ায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন দুর্গত এলাকার মানুষজন।
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক মোঃ শফিউল আরিফসহ ৫টি উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তাগণ বন্যা দুগর্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। বানভাসী মানুষগুলোর জন্য নগদ ৪ লাখ টাকা, ও ১শ’ ৬০ মেঃ টনঃ চাল বরাদ্দ করা হয়েছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম।
সিলেটের সব নদীর পানি ছাড়িয়েছে বিপদসীমা
সিলেট অফিস জানায়, বর্ষা মৌসুমে টানা তৃতীয় দফা বন্যার কবলে সিলেট। পানির থাবায় বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে দেখা দিয়েছে বিপর্যয়। মূলত উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢল ও গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে বন্যার এ সর্বগ্রাসী রূপ। বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহতি হচ্ছে সুরমা, কুশিয়ারা, মনুসহ বিভাগের প্রায় নদীই। নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে অধিকাংশ মানুষ এখন মূলত পানিবন্দি। সড়ক ডুবে য্ওায়ায় যোগাযোগ্ও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে বিভিন্ন এলাকায়। তলিয়ে গেছে প্রান্তিক কৃষকের স্বপ্নের আমন চাষ। সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের সর্বশেষ তথ্য মতে বিপদসীমার উপরে পানি প্রবাহিত হচ্ছে কানাইঘাট- সুরমা ১৪.২৬, সিলেট-সুরমা-১১.৫৫, শেরপুর-কুশিয়ারা ৯.০৭, কানাইঘাট-লোভাচড়া নদী ১৪.৫১, সারিঘাট-গোয়াইন নদী ১২.৫৮, মৌলভীবাজার মনু রেল ব্রিজ ১৭.২৫, মনু সদর ১১.৯৬, হবিগঞ্জ বাল্লা-খোয়াইনদী ২১.২৬।
সুনামগঞ্জে দুই লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি
সুনামগঞ্জ জেলা সংবাদদাতা জানান, অবিরামা বর্ষণ ও পাহাড়ী ঢলে সুনামগঞ্জের নদ-নদী ও হাওর-বাওড়ে অব্যাহত পানি বৃদ্ধি থাকায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। জেলার ৮টি উপজেলার দুই লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। গতকাল বিকেল ৩টায় সুরমা নদীর পানি সুনামগঞ্জ পয়েন্টে বিপদ সীমার ৮২ সেন্টিমিটার দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সুনামগঞ্জে ২ হাজার ৬৫০ হেক্টর রোপনকৃত রোপানা আমন ও ৬৬৫ হেক্টর রোপা আমন বীজতলা পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
২১ হাজার মানুষ পানিবন্দি : চলছে নদীভাঙন
মোশাররফ হোসেন বুলু, সুন্দরগঞ্জ (গাইবান্ধা) থেকে জানান, কয়েক দিনের ভারি বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ৯ ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়েছে প্রায় ২১ হাজার পরিবার। নদী ভাঙনের মুখে ২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। উপজেলার ৯ ইউনিয়নের প্লাবিত হওয়ায় ২১ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পরেছে। সেই সাথে দেখা দিয়েছে ব্যাপক নদী ভাঙন। তলিয়ে গেছে ২ হাজার হেক্টর আমন ক্ষেত। পানিবন্দি মানুষ গবাদি পশু হাঁস-মুরগী নিয়ে অতি কষ্টে দিনাতিপাত করছে। অনেকেই বাঁধে ও আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়ে অবর্ণনিয় অভাব অনটনের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। বন্যা এলাকায় দেখা দিয়েছে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির অভাব।
তানোরে কৃষি ও মৎস্য খাতের ব্যাপক ক্ষতি
তানোর (রাজশাহী) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, রাজশাহীর তানোরে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় কৃষি ও মৎস্য খাতের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তানোর পৌর এলাকা ও বিভিন্ন ইউপিরসহ বিস্তীর্ণ এলাকার ফসলের জমি তলিয়ে গেছে ভেঙে পড়েছে কাঁচা মাটির ঘর বাড়ি। এসব এলাকায় প্রায় সহস্রাধিক বসতবাড়িতে বন্যার পানি ঢুকেছে। বন্যার পানি বৃদ্ধি পাওয়াই প্রায় আড়াই হাজার হেক্টর রোপা-আমণের খেত তলিয়ে গেছে। অনেক এলাকায় আমনের বীজতলাসহ শাক-সবজির মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। অনেক রাস্তা আর কালভ্রাট ভেঙ্গে জনগণের যাতায়াত মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে।
উলিপুরে ১৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি
হাফিজ সেলিম, উলিপুর (কুড়িগ্রাম) থেকে জানান, ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, দুধকুমর ও তিস্তা নদীর বানের পানিতে উপজেলার ৮ ইউনিয়নের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বহ্মপুত্র বিচ্ছিন্ন সাহেবের আলগা ইউনিয়নের ৫২টি চর তলিয়ে যাওয়ায় ১৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। গ্রামের বেশির ভাগ রাস্তা তলিয়ে যাওয়া যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। উপজেলার ১০ হাজার ১শ’ হেক্টর জমির রোপা আমন ক্ষেত, ১শ’ হেক্টর জমির বীজতলা ও ২শ’ হেক্টর জমির শাক-সবজি তলিয়ে গেছে।
নড়াইলে নবগঙ্গা নদীর ভাঙনে ওয়াপদা বেড়ী বাঁধ
নড়াইল জেলা সংবাদদাতা জানান, নড়াইলের কালিয়ায় নবগঙ্গা নদী ভাঙনের তীব্রতা মারাত্মক আকারে বৃদ্ধি পেয়েছে। যে কোন মুহূর্তে কালিয়া পৌর সভার বড়কালিয়া-নাওরা ঝুঁকিপূর্ণ ওয়াপদা বেড়ীবাঁধটি ভেঙে যেতে পারে। বেড়িবাঁধটি ভেঙে গেলে উপজেলার ৪টি ইউনিয়নের প্রায় ২৫ হাজার পরিবার অধ্যুষিত ৫ হাজার ৭শ’ হেক্টর ফসলি জমি ও প্রায় ১ হাজার মাছের ঘের ক্ষতির সম্মুখীন হবে। এছাড়া খুলনা জেলার তেরখাদা, রূপসা ও দিঘলিয়া (আংশিক) উপজেলার কয়েক হাজার একর ফসলি জমি ও ২ হাজারের ঊর্ধ্বে মাছের ঘের তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এতে কয়েক হাজার কোটি টাকার ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। বড়কালিয়া ওয়াপদা ঝুকিপূর্ণ বেড়ীবাঁধটির দিকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তেমন কোন নজর বা খেয়াল নেই।
কালিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধ করে দিয়েছি। এছাড়া নদী ভাঙনের বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।’



 

Show all comments
  • রফিক ১৪ আগস্ট, ২০১৭, ৩:৩৫ এএম says : 0
    হে আল্লাহ তুমি তোমার খাস রহমত নাযিল করো।
    Total Reply(0) Reply
  • মোঃ সালাহ উদ্দিন ১৪ আগস্ট, ২০১৭, ১২:২৭ পিএম says : 0
    এসব আমাদের নিজ থেকে ডেকে আনা দুর্যোগ! এতদিন রমনা বটমূলে কিছু পরগাছা বাঙালীর দুর্যোগের মাস বৈশাখকে আমন্ত্রণ জানাতো। এই বছর সারাদেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে "এসো হে বৈশাখ" বাধ্যতামূলক করা হয়েছে!!! নে.... সারা বছরের জন্য দুর্যোগ নে!!! মুক্তিতো আল্লাহ্‌ তায়ালার কাছেই।
    Total Reply(0) Reply
  • Habib ১৪ আগস্ট, ২০১৭, ২:২৭ পিএম says : 0
    Asun amara sobai bonna durgotoder pase darai
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বন্যা

১৫ অক্টোবর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ