Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বিচার বিভাগ সংবিধানের রক্ষক

ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার রায়-৪

| প্রকাশের সময় : ১১ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

ইনকিলাব ডেস্ক : বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল মিস্টার মাহবুবে আলম এবং বিজ্ঞ ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মিস্টার মুরাদ রেজার যুক্তি-তর্কের একটি অভিন্ন সুর ছিল। তা হচ্ছেঃ ‘বিচারকদের অপসারণের পদ্ধতিটি একটি নীতি নির্ধারক সিদ্ধান্ত; যা পার্লামেন্টের একতিয়ার। ষোড়শ সংশোধনী সংবিধান বিরোধী বলে হাইকোর্টের ঘোষনা ক্ষমতা পৃথকীকরণের লঙ্ঘন। আর তাই অবৈধ।’ তারা ্উভয়েই একই পয়েন্টের ওপর জোর দেন। তা হলোঃ ‘নির্বাহী বিভাগ অনির্বাচিত বিচারকদের নিয়োগ দেয়। তারা (বিচারকরা) জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন না বরং তারা তাদের বিচারিক দায়িত্ব পালন করেন; এর বেশী কিছু নয়। তারা আরও বলেন, অনির্বাচিত বিচারকরা অবৈধভাবে নীতি নির্ধারণী দিয়ে আইন প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা এবং সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের ক্ষমতা চাইছেন। আদালতের সব বিচারিক পর্যালোচনা (Review), রায়ের (Adjudication) পদ্ধতি স্বয়ং বিচারিক জবাবদিহিতা বলবত করে। এই জবাবদিহিতা জনগণের কাছে, যাদের ওপর বিচারকের রায় প্রভাব ফেলে তাদের কাছে। যখন কোন বিচারক এরূপ আচরণ করেন যে তিনি নৈতিকভাবে সংবিধানের রক্ষক, তখন বিচারিক সিদ্ধান্তের জটিল মন্তব্যে এই জবাবদিহিতা প্রস্ফুটিত হতে দেখা যায়। বিচারকরা তাদের দায়িত্ব পালনকালে সাংবিধানিক চেতনা সমুন্নত রাখেন। এ প্রেক্ষাপটে সংবিধান মোতাবেক তাদের ওপর অর্পিত কার্যক্রমের ভাবগাম্ভীর্য, ঐকান্তিকতা ও গুরুত্ব তাদেরকে অনুধাবন করতে হবে। একজন যাজককে কখনো বাইবেল (কিংবা ভগবত গীত) ছাড়া দেখা যায় না। ঠিক তেমনি সাংবিধানিক পরামর্শদাতা হতে চাইলে আজকের একজন আদর্শবান বিচারককে আদালতের ভেতরে ও বাইরে পকেটে সংবিধান নিয়ে চলতে হবে। কারণ আপনি যতই আমাদের সংবিধানের বিধি-বিধানগুলো পড়বেন ততই আপনি বর্তমান কালের সমস্যাবলী সমাধানের প্রচেষ্টায় এর বিধানাবলীর প্রয়োগ সম্পর্কে জানতে পারবেন। (Before Memory Fades’ --by Fali S. Nariman).
১৭৭৬ সালে আমেরিকার প্রতিষ্ঠাতারা স্বাধীনতা ঘোষনার খসড়া তৈরি করতে ফিলাডেলফিয়ায় সমবেত হন। এই স্বাধীনতা ঘোষনার দলিলে গ্রেট ব্রিটেনের সঙ্গে আমেরিকার জনগণের রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা হয়। এভাবে ‘ইউনাইটেড স্টেটস অব অ্যামেরিকা’ নামে মুক্ত-স্বাধীন একটি নতুন দেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। এর ১১ বছর পর ১৭৮৭ সালে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করে আমেরিকান দেশপ্রেমিকরা স্বাধীনতা লাভ করেন। অন্যান্যদের সাথে নিয়ে এই দেশপ্রেমীরা নতুন দেশ শাসনের পরিকল্পনায় যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের খসড়া তৈরি করতে আবারও ফিলাডেলফিয়ায় সমবেত হন।
পরিকল্পনাটি অনুমোদিত হওয়ার পর ১৭৮৯ সালে একটি নতুন সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ঘোষনাপত্র (Declaration) এবং সংবিধান (Constitution) আমেরিকার প্রতিষ্ঠাকালীন দলিল। ঘোষনাপত্রে প্রতিষ্ঠাতারা তাদের নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও তারা যে সরকারের আভাস দিয়েছেন তার রূপরেখা তুলে ধরেন। সুন্দর বিশ্বের উদ্দেশে ভাষন দিতে গিয়ে আমেরিকার প্রতিষ্ঠাতারা ঘোষনাপত্রের তাৎক্ষণিক লক্ষ্য সম্পর্কে বলেন, স্বাধীনতা ঘোষনার ব্যাপারে তাদের সিদ্ধান্তের যৌক্তিতা প্রকাশ করাই এর লক্ষ্য। এই লক্ষ্যে তারা বৈধ সরকারের একটি তত্ত¡ দেন। তার পর তারা তুলে ধরেন যে, ব্রিটিশ শাসকরা সেটা থেকে কতটা বিচ্যূত হয়েছে। ঘোষনার মৌলিক অংশটি দলিলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি লাইন দিয়ে শুরু হয় ঃ “We hold these truth to be self-evident.” ” (আমরা এই সত্য পোষণ করি যে, আমরা নিজেরাই স্বচ্ছ থাকর)। -----
বিচার বিভাগ সংবিধান ও তার মৌলিক মূল্যবোধের Watchdog বা রক্ষক। গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় একে সংবিধানের জীবনীশক্তিও বলা হয়। লিখিত গণতান্ত্রিক সংবিধানের আওতায় কর্মপালনকারী আদালতসমূহের বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মারবারি ভি মেডিসন পার্লামেন্টে পাস করা কয়েকটি আইন অসাংবিধানিক হিসেবে ঘোষনা করেন। এ ধরণের ক্ষমতা প্রয়োগের জন্য দক্ষ ও স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার প্রয়োজন। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সম্প্রতি NJAC মামলায় তার পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেঃ
“বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অত্যন্ত অপরিহার্য রক্ষাকবচের মধ্যে রেেয়ছে - নির্বাহী বিভাগ ও পার্লামেন্টের হস্তক্ষেপ থেকে চাকরির মেয়াদকালের নিশ্চয়তা, বিচার বিভাগের সদস্য থাকার অযোগ্য বলে বিবেচিত বিচারকদের কঠোর ক্ষেত্রছাড়া অন্য বিচারকদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়ার বিরুদ্ধে সুরক্ষা, বেতন ও অন্যান্য ভাতা প্রাপ্তির সুরক্ষা, অসদাচরণ ও অযোগ্যতার কঠিন ক্ষেত্রছাড়া বিচার বিভাগীয় কাজের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বিচারকদের আচরণের বিষয়ে নির্বাহী বিভাগ ও পার্লামেন্ট কর্তৃক স্ক্রুটিনি থেকে দায় মুক্তি। আশাবাদী প্রত্যাশা নিয়ে এসব রক্ষাকবচের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে করে সুরক্ষাপ্রাপ্ত বিচারকরা নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা ও অকুতোভয়ে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারেন। একই মামলায় আরও বলা হয়ঃ
“অসাধু মামলাকারীরা সব সময় বিচারকদের প্রভাবিত করার ফাঁক-ফোকর খুঁজতে থাকে। রাষ্ট্র কিংবা এর প্রতিষ্ঠানসমূহ (আধুনিক গণতন্ত্রে সবচেয়ে বড় মামলাকারী) এর ব্যতিক্রম নয়। এ ধরণের প্রলোভন এবং বিচারক নির্বাচন প্রক্রিয়া ও তাদের চাকরির শর্ত নির্ধারণকারী আইন প্রণয়নের আইনগত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বিচার িিবভাগের প্রতি প্রচন্ড হুমকি সৃষ্টি করতে পারে। এ ধরণের আইন প্রণেতাদের সীমাহীন ক্ষমতা থাকলে তো কথাই নেই। সেজন্য সংবিধানে বিচার বিভাগে সদস্যদের মেয়াদকাল ও চাকরির শর্ত সুরক্ষায় অতিরিক্ত কবচ জুড়ে দেয়া হয়েছে এই আশায় যে, বিচার বিভাগে দায়িত্ব পালনকারী পুরুষ ও মহিলা এভাবে সুরক্ষিত হলে সম্পূর্ণ স্বাধীনবাবে ও দক্ষতার সাথে তারা তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারেন।
ভারতীয় সংবিধানের ১২১ অনুচ্ছেদে একটি নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এই ধারায় বলা হয়েছে, ‘সুপ্রিম কোর্ট কিংবা হাইকোর্টের কোন বিচারকের অপসারণ চেয়ে প্রেসিডেন্টের কাছে লিখিত আবেদন সংক্রান্ত প্রস্তাব উত্থাপন না করা পর্যন্ত তার (বিচারকের) দায়িত্ব পালনকালে তার আচরণ সম্পর্কে পার্লামেন্টে কোন আলোচনা করা যাবে না। আমাদের সংবিধানে এমন কোন বিধান নেই। ভারতে প্রেসিডেন্টের আদেশে সুপ্রিম কোর্টের কোন বিচারককে অপসারণ করা যাবে। প্রেসিডেন্ট পার্লামেন্টের প্রত্যেক কক্ষের বিশেষ সংখ্যা গরিষ্ঠ সদস্যের (অর্থাৎ ঐ কক্ষের মোট সদস্যের দুই তৃতীয়াংশের কম নয় এমন সংখ্যা গরিষ্ঠতা) সমর্থনে পার্লামেন্টে প্রস্তাব ওঠানোর অধিবেশনকালে তার কাছে পাঠানো আবদনপত্র পাওয়ার পর ঐ বিচারকের অপসারণ আদেশ জারি করতে পারেন।
ধাপ-ওয়ারি প্রক্রিয়াঃ
১। ১০০ সদস্যের (লোক সভার ক্ষেত্রে) এবং ৫০ সদস্যের (রাজ্যসভার ক্ষেত্রে) স্বাক্ষরিত অপসারণ প্রস্তাব স্পিকারকে/চেয়ারম্যানকে দিতে হবে। (পার্লামেন্টের দুকক্ষের যে কোন একটিতে এই অপসারণ পস্তাব উত্থাপন করা যাবে)
২। স্পিকার/েচেয়ারম্যান প্রস্তাবটি গ্রহণ কিংবা নাকচ করতে পারেন।
৩। এটি গৃহীত হলে স্পিকার/চেয়ারম্যান অভিযোগ তদন্তে ৩ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করবেন। কমিটির সদস্যদের হিসেবে সুপ্রিম কোর্টে প্রধান বিচারপতি বা একজন বিচারক, হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং একজন বিশিষ্ট জুরি নিয়ে গঠিত হবে।
৪। কমিটি ঐ বিচরকের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের (অসদাচরণ ও অযোগ্যতা) প্রমান পেলে পার্লামেন্টের যে কক্ষে এই প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছিল সেই কক্ষ প্রস্তাবটি বিবেচনার জন্য গ্রহন করবে।
৫। উত্থাপিত কক্ষে বিশেষ সংখ্যা গরিষ্ঠতায় প্রস্তাবটি পাস হলে এটি দ্বিতীয় কক্ষে পাঠানো হবে এবং সেখানেও তা বিশেষ সংখ্যা গরিষ্ঠতায় পাস হতে হবে।
৬। উভয় কক্ষে পাস হওয়ার পর ঐ বিচারককে অপসারণের জন্য প্রেসিডেন্টের কাছে আবেদন পাঠানো হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ষোড়শ সংশোধনী

৫ নভেম্বর, ২০১৭
১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ