Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দেশের স্থিতিশীলতার নিশ্চয়তা দিতে পারে সম্মিলিত রাজনৈতিক প্রজ্ঞা

ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার পূর্ণাঙ্গ রায়-৩

| প্রকাশের সময় : ৯ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

ইনকিলাব ডেস্ক : যে কোন রাজনৈতিক সমাজ বা ক্যমিউনিটির সৃজনশীল বিবর্তন ঐ সমাজ-জীবনের আগে আগে চলে। এর সঙ্গে রয়েছে ‘ট্রায়াল এন্ড এরর’ নামক যাচাই-বছাই পদ্ধতি। তবে ইতিহাসে কিছু আপাতবৈপরিত্য রয়েছে। সব রাজনৈতিক সমাজ তাদের রাজনৈতিক জীবনে এই সৃজনশীল ‘ট্রায়াল এন্ড এরর’-এর অনাকাক্সিক্ষত ধাক্কা সামলাতে পারে না। সবাই সময়ের পরীক্ষায় টিকে থাকতেও পারে না। কেননা শুধুমাত্র শক্তিশালী অর্থনীতি, শুধুমাত্র গগনচুম্বি ভবন এবং শুধুমাত্র বিশাল ও সুদীর্ঘ সেতুর পর সেতু কোন দেশের স্থিতিশীলতা ও বিকাশকে নিশ্চয়তা দিতে পারে না। বরং এর জন্য প্রয়োজন ‘সম্মিলিত রাজনৈতিক প্রজ্ঞা’। এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্বের সেই দেশটিই সবচেয়ে দুর্ভাগা যে দেশটির উল্লিখিত সব সম্পদই রয়েছে; কিন্তু নেই শুধু ‘সম্মিলিত রাজনৈতিক প্রজ্ঞা’। কোন দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বলতে যা বোঝায় তা একটি ‘আপেক্ষিক ধারণা’। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই ধারণার বিবর্তন ঘটে। কিন্তু একটি জাতির অদৃশ্যমান কাঠামো, যার ওপর গড়ে ওঠে সেই প্রজ্ঞার ধারণা কখনই পরিবর্তিত হয় না। এই রায়ের পরবর্তী অংশে আমি (প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা) এই সম্মিলিত প্রজ্ঞার বিষয়ে আরও আলোকপাত করব।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ইতিহাসে এমন কিছু সময় আসে যখন সমাজের সবচেয়ে সিনিয়র, সবচেয়ে ঝানু এবং সবচেয়ে শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিদেরকে তাদের অস্থিত্বের ভিত রচনাকারী কিছু মৌলিক ও সুষ্পষ্ট বিষয় স্মরণ করিয়ে দিতে হয়। আমার দেশবাসীকে, বিশেষ করে যারা প্রজাতন্ত্রের সুউচ্চ ও দায়িত্বশীল আসনে বসে আছেন তাদেরকে বিনয়ের সঙ্গে এই সত্য স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, বাংলাদেশের একটি ‘লিখিত’ সংবিধান রয়েছে। আমি ইচ্ছাকৃতভাবে ‘লিখিত’-এর উপর বিশেষ জোর দিয়েছি। এ শব্দটি মানবজাতির সামাজিক-রাজনৈতিক বিবর্তনের বাঞ্ছিত উল্ফনের পরিমাপ প্রকাশ করে। লিখিত সংবিধানের আবির্ভাবের আগে মানব সমাজের রাজনৈতিক জীবন ছিল গেঁয়ো, অভব্য এবং সত্যিকারের মধ্যযুগীয়। মধ্যযুগীয় রাজতন্ত্র ও আধুনিক প্রজাতন্ত্রের মধ্যে একটা জটিল পার্থক্য রয়েছে। মধ্যযুগীয় রাজতন্ত্রে রাজাই ছিলেন একই সঙ্গে আইন প্রণেতা ও আইনদাতা। রাজাই ছিলেন বিচারক। মৃত্যুদন্ড দেয়া ও তা কার্যকর করার দায়িত্বও ছিল তার। এর বিরোধিতা করে রাজনৈতিক নেতা ও দার্শনিকরা সব সময় এমন একটা পদ্ধতি প্রতিষ্ঠার চিন্তা-ভাবনা করতে থাকেন যেখানে রাজার অবাধ, নিরংকুশ ও সর্বময় ক্ষমতা একটা ‘সুষম সীমাবদ্ধতায়’ আনা যায়, যাতে করে তিনি সেটা লঙ্ঘন করতে না পারেন। এভাবেই গড়ে ওঠে আধুনিক সংবিধানের চিন্তা ধারা। আধুনিক সংবিধান মূলত লিখিত সংবিধান। লিখিত সংবিধান তো দূরের কথা মধ্যযুগের রাজারা কোনরূপ সংবিধানের তোয়াক্কা করতেন না। সুতরাং আমরা যদি বিগত দু’হাজার বছরের মানব জাতির রাজনৈতিক ইতিহাস বিবর্তনে সমন্বিত পাঠের দিকে মনযোগ দেই, তবে আমরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্রম বিবর্তন ও অব্যহত বিকাশ দেখতে পাব। অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে এই উন্নয়ন, রাষ্ট্রকে স্থিতিশীল ও বিকাশমান করতে দলিল প্রণয়ন ও্ উপায় খুঁজে বের করায় সহায়ক হয়েছে। পরিশেষে জনগণ লিখিত সংবিধান পাওয়ার ধারণায় পৌঁছে গেছে। আমাদের উচিত নিজেদেরকে একটি সাদামাঠা প্রশ্ন করা। আর তা হচ্ছেঃ আমাদের পূর্বপুরুষরা কেন কোনো সংবিধান না পাওয়ার মঞ্চ থেকে সরে গিয়ে লিখিত সংবিধান পাওয়ার মঞ্চে উঠলেন?
এর অলঙ্ঘনীয় ও স্পষ্ট জবাব হচ্ছেঃ আমাদের পূর্বপুরুষরা এমন একটা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন যেখানে সকল ক্ষমতা ও কর্তৃত্বপ্রয়োগের কথা সুস্পষ্টভাবে একটি পবিত্র ও অলঙ্ঘনীয় দলিলে লেখা থাকবে এবং রাষ্ট্রের যে কেউ যে ক্ষমতা প্রয়োগ করুন না কেন তিনি সংবিধানে বর্ণিত সীমা লাঙ্ঘন করতে পারবেন না। আমি যে ‘সুষম বিধিনিষেধ’-এর কথা বলেছি এটিই সেটা। লিখিত সংবিধান পাওয়ার অর্থ, প্রয়োগের ক্ষমতা পাওয়া। তবে সে ক্ষমতা কার্যত সীমাবদ্ধ এই কারণে যে এটি অবাধ কিংবা অসীম নয়। আবার এটি সুষম এই কারণে যে, এই ক্ষমতা প্রয়োগকালে সরকারের সব সংস্থা এক্যবদ্ধভাবে একযোগে কাজ করবে যাতে জনগণের সর্বোচ্চ কল্যাণ নিশ্চিত হয়।
লিখিত সংবিধানের আওতায় ক্ষমতা প্রয়োগ যেন ঔরমংধি চুুঁষব (জিগস’ ধাঁধাঁ) নিয়ে কাজ করার মত। এই ধাঁধাঁয় চতুর্ভজ আকৃতির টাইলসের মত খন্ডগুলোকে সরিয়ে সরিয়ে ঠিকমত সাজাতে হয়। টাইলসগুলোতে এক বা একাধিক ছবির ছোট ছোট অংশ থাকে। ঠিকমত সাজাতে পারলে খেলা শেষে একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র ফুটে ওঠে। আধুনিক রাষ্ট্রীূ যন্ত্র নিঃসন্দেহে একটি জটিল ব্যবস্থা। সেখানে ক্ষমতার পৃথকীকরণ পুরাদস্তর নয়। ফলে এটিতে প্রায়ই জট পাকিয়ে যায় এবং একটি ধাঁধাঁর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। তবে সংবিধানের কাঠামোর মধ্যে পড়ে এটি সুশৃঙ্খল হয়ে যায় যাতে করে কোন কিছুই চিরকাল পৃথক বা সংহতিহীন হয়ে পড়ে থাকে না।
আমাদের দেশের নাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ এবং এই প্রজাতন্ত্রের একটি ‘লিখিত’ সংবিধান রয়েছে। এই রায়ে পৌঁছানোর জন্য পূূর্ববর্তী প্যারাগুলো আমাদেরকে ঘটনা, বিষয়াবলী ও যৌক্তিক কারণ বুঝতে সাহায্য করবে। (চলবে)



 

Show all comments
  • রফিক ৯ আগস্ট, ২০১৭, ২:২৮ এএম says : 0
    পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম
    Total Reply(0) Reply
  • তানিশা ৯ আগস্ট, ২০১৭, ২:২৯ এএম says : 0
    একদম ঠিক কথা
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ষোড়শ সংশোধনী

৫ নভেম্বর, ২০১৭
১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ