পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) যেন অনিয়মের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। যে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করার কাজে নিয়োজিত, তাদের মধ্যেই দলাদলি এবং অনিয়ম বাসা বেঁধেছে। শিক্ষক নিয়োগেরক্ষেত্রে যোগ্যতার চেয়ে স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে অযোগ্যদের নিয়োগ দেয়ার এন্তার অভিযোগ উঠেছে। গতকাল একটি দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বর্তমান উপাচার্যের অধীনে গত ৮ বছরে ৯০৭ জন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে শেষ ৩ বছরে নিয়োগ পেয়েছেন ৩৫০ জন। শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিল করে এবং যোগ্য প্রার্থীদের বাদ দিয়ে নিয়োগ দেয়া হয়েছে অন্তত ৭৮ জন এবং ন্যূনতম যোগ্যতা পূরণ না করেই দুই বিভাগে নিয়োগ পেয়েছেন ১০ জন। এছাড়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখিত সংখ্যার চেয়ে দুই বা ততোধিক সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার ঘটনা ঘটেছে ৪১ জনের ক্ষেত্রে। ¯œাতকোত্তর ছাড়া নিয়োগ পেয়েছেন অন্তত ৩ জন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসনের গত তিন বছরে বিশেষত নতুন বিভাগগুলোয় শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম হয়েছে সবচেয়ে বেশি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারপন্থী নীল দলের শিক্ষকদের অভ্যন্তরীন দ্ব›েদ্বর কারণে বর্তমান উপাচার্যের নেতৃত্বে প্রশাসনিক ক্ষমতায় থাকা অংশটি নিজেদের পছন্দ ও অনুগত শিক্ষকদের সংখ্যা বাড়াতে অনেক অনিয়ম করেছে। আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন নীল দল থেকে নির্বাচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি শিক্ষক নিয়োগের হাল নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এ নিয়ে উপাচার্যকে অনেক শিক্ষক বিভিন্ন সময়ে বললেও তিনি শুনতে চান না। তারা আঁকুতি জানিয়েও বলেছেন, আমরা-আপনি একসময় ক্যাম্পাসে থাকব না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থাকবে। শিক্ষক নিয়োগে যদি এমন অনিয়ম হয়, তাহলে আমরা কাদের কাছে বিশ্ববিদ্যালয় রেখে যাচ্ছি!
দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম এককালে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়েছিল। এখন এর পড়ালেখার মান এতটাই নি¤œগামী যে বিশ্বের পাঁচশ’ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায়ও ঠাঁই পায়নি। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, এ বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসম্পন্ন শিক্ষার বিয়য়টি নি¤œগামী এবং প্রকট আকার ধারণ করেছে। মানসম্পন্ন শিক্ষা নিয়ে খুব কম শিক্ষার্থীই বের হতে পারছে। অথচ আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে মানসম্পন্ন শিক্ষা ও শিক্ষার্থীর খুবই প্রয়োজন। এসব শিক্ষার্থী দেশের উন্নয়নের চালিকা শক্তির ভূমিকা পালন করার কথা। দুঃখের বিষয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান কমে যাওয়ায় খুব কম শিক্ষার্থীই দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতি এবং নেতৃত্বের হাল ধরতে পারছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান যেভাবে নি¤œ দিকে ধাবিত, তাতে শুধু সার্টিফিকেটধারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, কর্মক্ষেত্রে তারা যোগ্যতার প্রমাণ দিতে পারছে না। এতে তাদের মধ্যে হতাশা বৃদ্ধির পাশাপাশি বেকারত্বের মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের যারা শিক্ষক তারাই যদি অযোগ্য বা অনুপযুক্ত হন, তবে তারা কী শিক্ষা দেবেন? যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাগত যোগ্যতার চেয়ে দলীয় পরিচয় ও আত্মীয়তাকে প্রাধান্য দিয়ে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয় এবং তাতে উপাচার্যসহ প্রশাসন জড়িয়ে থাকে, সে বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসম্পন্ন শিক্ষা কোনোভাবেই পাওয়া সম্ভব নয়। শুধু তাই নয়, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পুনরায় নিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে প্রভাব বিস্তার করেনএবং দলাদলিতে লিপ্ত থাকেন, সেখানে পড়ালেখার সুষ্ঠু পরিবেশ ও মানসম্মত শিক্ষা পাওয়ার আশা দুরাশায় পর্যবসিত হওয়াই স্বাভাবিক। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার ক্ষেত্রে যেসব শিক্ষার্থী শীর্ষ স্থান লাভ করে এবং তারা যদি আগ্রহী হয়, তবে তাদেরকে সানন্দে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। বিগত কয়েক বছর ধরে আমরা এ নিয়মের ব্যত্যয় দেখছি। প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হওয়া ছাত্রটি শিক্ষকতায় আগ্রহ প্রকাশ করলেও তার পরিবর্তে কম যোগ্যতাসম্পন্নদের নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। এমনকি ¯œাতোকোত্তর ডিগ্রী নেই, এমন ব্যক্তিদেরও শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয় হয়েছে। আবার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখিত যোগ্যতার চেয়েও কম যোগ্যরা নিয়োগ পেয়েছে। এছাড়া ক্ষমতাসীন দলের কম যোগ্যতা সম্পন্নদের অগ্রাধিকার ভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। প্রধান বিচারপতিও বলেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঐতিহ্য অনুযায়ী শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে না। এ চিত্র থেকে এটাই প্রতীয়মাণ হচ্ছে, শিক্ষাকে তার স্বাভাবিক ধারায় প্রবাহিত হতে না দেয়ার প্রতিযোগিতা চলছে। বিগত কয়েক বছর ধরে দেশের সার্বিক শিক্ষার মান নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। অনেকে এ ভেবে আশ্বস্ত হয়েছিলেন, অন্তত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পড়ালেখার মান বজায় রয়েছে। এ ধারণা যে ভুল ছিল, তা শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে চরম অনিয়ম ও অযোগ্যদের প্রাধান্য দেয়া এবং স্বয়ং উপাচার্যর অনিয়মতান্ত্রিক কার্যকলাপ থেকে প্রমাণিত হয়েছে। দেশের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে এ ধরনের অপকর্ম পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেছে।
শিক্ষক নিয়োগ এবং অনিয়ম নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক শিক্ষকদের মধ্যকার অভ্যন্তরীণ কোন্দল যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানকে শঙ্কার মধ্যে ফেলে দিয়েছে, তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বর্তমান উপাচার্যের স্বপদে বহাল থাকা নিয়ে যে রাজনীতি, অনিয়ম এবং মারামারি-হানাহানি হয়েছে, তা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। এ নিয়ে আদালত পর্যন্ত যেতে হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি শিক্ষাঙ্গণে এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার জন্ম হওয়া কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। এতে এটাই পরিলক্ষিত হচ্ছে, শিক্ষকরাই শিক্ষকদের মর্যাদা ধরে রাখতে পারছেন না। বলা বাহুল্য, শিক্ষক হওয়ার মতো প্রকৃত যোগ্যদের পরিবর্তে যদি অযোগ্যদের নিয়োগ দেয়া হয়, তবে সেখানে ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে পারস্পরিক মর্যাদাপূর্ণ সম্পর্ক অটুট থাকার কোনো কারণ থাকতে পারে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে হলে, শিক্ষকদেরই আগে সচেতন হওয়া বাঞ্চনীয়। শিক্ষক হিসেবে যোগ্যদের নিয়োগ দেয়া এবং অনিয়ম ও দুর্নীতিকে সমূলে উৎপাটন করতে না পারলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমর্যাদা পুনরুদ্ধার করা যাবে না। আমরা মনে করি, শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে যেসব অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে, তা সরকারের তরফ থেকে খতিয়ে দেখে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা এবং যোগ্যদের নিয়োগ দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।