Inqilab Logo

শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চট্টগ্রামে চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলা তদন্তে গতি নেই

দিয়াজের মৃত্যুর কারণ জানতেই ৯ মাস পার

| প্রকাশের সময় : ৪ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

রফিকুল ইসলাম সেলিম : কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা দিয়াজ ইরফান চৌধুরীর ‘মৃত্যু’ আত্মহত্যা না হত্যা তা নিশ্চিত হতে লেগেছে ৯ মাস। মৃত্যুর কয়েক ঘন্টার মধ্যে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসকেরা বলে দিলেন ‘দিয়াজ আত্মহত্যা করেছে’। তার পরিবার ওই ময়না তদন্ত প্রতিবেদন প্রত্যাখান করে আদালতে যান। দীর্ঘদিন পর আদালত পুর্নময়না তদন্ত করতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগকে দায়িত্ব দেন। তারা বলছেন দিয়াজ আত্মহত্যা করেনি তাকে ‘আঘাতপূর্বক শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে’।
বুধবার আদালতে এই প্রতিবেদন দাখিল করে মামলার তদন্তকারি সংস্থা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি বলেছে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের মধ্যে বিরোধের জেরে এই খুন। এ হত্যাকান্ডের রহস্য উদঘাটনে দীর্ঘ তদন্তের প্রয়োজন। ছাত্রলীগ নেতা দিয়াজ ইফরান চৌধুরী হত্যা মামলার মতো চট্টগ্রামে আলোচিত আরও অনেক হত্যা মামলার তদন্তে গতি নেই। এতে করে একদিকে এসব খুনের ঘটনায় জড়িতরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। অন্যদিকে হতাশ হয়ে পড়ছে নিহতের স্বজনেরা। তাদের বিচারের অপেক্ষা কেবলই দীর্ঘ হচ্ছে। কয়েকটি আলোচিত হত্যা মামলার তদন্ত শেষ হলেও তদন্ত যথাযথ না হওয়ায় আদালত অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন। এসব মামলার অধিকতর তদন্ত চলছে। রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের তদন্ত নিয়েও চলছে নানা টালবাহানা।
গত বছরের ২০ নভেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বাসা থেকে উদ্ধার করা হয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সম্পাদক দিয়াজ ইরফান চৌধুরীর লাশ। দিয়াজের অনুসারী ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা তখন দাবি করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মাণকাজের দরপত্র নিয়ে বিরোধের জেরে তাকে হত্যা করে লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। তার বিরোধী হিসাবে পরিচিতরা বলতে থাকেন দিয়াজ আত্মহত্যা করেছেন। এরমধ্যে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রথম ময়নাতদন্তের পর ২৩ নভেম্বর চিকিৎসকরাও বলেন দিয়াজ ‘আত্মহত্যা’ করেছেন।
পরদিন ২৪ নভেম্বর দিয়াজের মা জাহেদা আমিন বাদী হয়ে ১০ জনের বিরুদ্ধে আদালতে হত্যা মামলা করেন। তার আপত্তিতে লাশের পুনঃময়নাতদন্ত হয়। দ্বিতীয় ময়নাতদন্তে খুনের ঘটনা প্রমানিত হলেও শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত এই মামলার কোন আসামি গ্রেফতার করা হয়নি। খুনিদের গ্রেফতারের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মানববন্ধন করেছে দিয়াজের সহপাঠিরা। দিয়াজের পরিবারের সদস্যরাও খুনিচক্রের সদস্যদের পাকড়াও করার দাবি করে আসছে।
এদিকে ঘটনার ৪ বছর পরও তদন্ত শেষ হয়নি সিআরবি এলাকায় সংঘটিত জোড়া খুন মামলার। বিগত ২০১৩ সালের ২৪ জুন রেলওয়ের টেন্ডারবাজিতে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের দুই পক্ষের বন্দুকযুদ্ধে যুবলীগ কর্মী সাজু পালিত ও হেফজখানার শিশু ছাত্র আরমান হোসেন মারা যান। এ ঘটনায় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের দু’টি গ্রুপ জড়িত থাকায় তদন্ত শেষ করতে গড়িমসি করে থানা পুলিশ। পরে মামলাটি তদন্ত করে মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। ডিবি তদন্ত করে সন্ত্রাসী বাবর ও লিমনসহ উভয় পক্ষের ৬২ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। ২০১৫ সালের ২৬ নভেম্বর চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম আদালত ডিবির এ চার্জশিট পর্যালোচনা করে ‘ত্রুটিপূর্ণ তদন্তের’ জন্য অসন্তোষ প্রকাশ করে চাঞ্চল্যকর এ মামলাটি পিবিআইকে অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন। বিচারের এমন দীর্ঘসূত্রতার কারণে ছাত্রলীগ নেতা লিমন ও যুবলীগ নেতা হেলাল আকবর বাবরসহ মামলার ৮৭ আসামির সবাই জামিনে আছে।
২০১৬ সালের ২৯ মার্চ প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা প্রশাসন অনুষদের ৩১তম ব্যাচের বিদায় অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে খুন হন বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএর ছাত্র নাসিম আহমেদ সোহেল। এ ঘটনার পর ১৩ জনের নাম উল্লেখ করে ঘটনার পরদিন সোহেলের বাবা আবু তাহের মামলা করেন। তাকে কিভাবে কারা খুন করেছে তার পুরো দৃশ্য সিসিটিভিতে রের্কড হয়ে যায়। ওই রের্কড ধরেও পুলিশ তাদের সবাইকে পাকড়াও করতে পরেনি। পুলিশ বলছে এই খুনের মূলহোতা ইব্রাহীম সোহান। তাকেই পুলিশ ধরতে পারেন। থমকে আছে আলোচিত এই হত্যাকান্ডের তদন্ত। চট্টগ্রাম মহানগর ও বিশ্ববিদ্যালয়ে গত কয়েক বছরে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের বিরোধে খুন হয়েছে আরও বেশ কয়েকজন। এসব রাজনৈতিক হত্যা মামলা তদন্তও গতিহীন। আসামী বাদি সবাই ছাত্রলীগের। এক্ষেত্রে তদন্ত করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে পুলিশ কর্মকর্তারা। ফলে খুনিরা প্রকাশ্যে ঘুরছে, আর স্বজনহারানোরা বিচার অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন।
খুলশী থানার দুই নম্বর গেট এলাকায় ২০১৪ সালের ১৭ মার্চ নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন ফোরকান ও কামরুল নামের দুই ছাত্রলীগ কর্মী। তাদের শরীর থেঁতলে ও হাত-পায়ের রগ কেটে খুন করার পর লাশ ফেলে দেওয়া হয় নির্মাণাধীন একটি ভবনের সেপটিক ট্যাঙ্কে। পুলিশ জানায়, এলাকায় চাঁদাবাজি নিয়ে ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের বিরোধে এ জোড়া খুনের ঘটনা ঘটে। আলোচিত এ মামলায় সে বছর ১৮ ডিসেম্বর চার্জশিট দেয় খুলশী থানা পুলিশ। তবে তদন্তে ত্রæটি থাকায় মামলাটি অধিকতর তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় পিবিআইকে। পিবিআই তদন্ত করে দেখতে পায় প্রকৃত খুনীকে বাদ দিয়ে অন্য একজনকে ওই মামলায় চার্জশিটে অভিযুক্ত করা হয়। প্রকৃত আসামীকে এর মধ্যে গ্রেফতার করেছে পিবিআই। মামলাটির এখনো তদন্ত চলছে।
দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টিকারী সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যা মামলার তদন্তও এখন কার্যত হিমাগারে। দুই আসামী ক্রসফায়ারে মারা গেছে। পুলিশের দাবি মতে, হত্যাকান্ডের মূলহোতা আবু মুছা ওরফে মুসা শিকদার এখনো হাওয়া। তাকে ধরতে প্রায় দেড় বছর আগে ৫ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে পুলিশ। তবে তার সন্ধান মিলছে না। ফলে মুছাতেই আটকে আছে আলোচিত এ হত্যা মামলার তদন্ত। গত বছরের ৫ জুন ছেলেকে স্কুল বাসে তুলে দিতে গিয়ে নগরীর জিইসি মোড় সংলগ্ন ও আর নিজাম রোডে নির্মমভাবে খুন হন মাহমুদা খানম মিতু।
২০১৫ সালের ১০ জানুয়ারি নগরীর পাঁচলাইশের তেলিপট্টি এলাকার নিজ বাসার গলির মুখে নার্সিং কলেজের শিক্ষিকা অঞ্জলি রানী দেবীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় অজ্ঞাতপরিচয় যুবকদের আসামি করে পাঁচলাইশ থানায় মামলা করা হয়। ঘটনার দু’দিন পর মামলাটি পুলিশ কমিশনারের নির্দেশে নগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ তদন্ত শুরু করে। সেই তদন্ত শেষ হয়নি এখনও। খুনের রহস্য উদঘাটন করা যায়নি, ধরা পড়েনি খুনীচক্রের কেউ। এতে হতাশ হয়ে পড়েছেন অঞ্জলির স্বামী ও মামলার বাদী চিকিৎসক রাজেন্দ্র লাল চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘স্ত্রী খুন হওয়ার কয়েক দিন পর মুঠোফোনে আমাকেও হুমকি দেয় অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিরা। এ ঘটনায় থানায় সাধারণ ডায়েরি করি। কিন্তু কারা আমাকে হুমকি দিয়েছে, তা বের করতে পারেনি পুলিশ। ভয়ে-আতঙ্কে নগরীর বাসা ছেড়ে বেশ কয়েক মাস ধরে হাটহাজারীর গ্রামের বাড়িতে বসবাস করছি। মৃত্যুর আগে স্ত্রী হত্যার বিচার দেখে যেতে চাই।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চট্টগ্রাম

৩০ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ