Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

যদি এতই মধুর সম্পর্ক তাহলে বাংলাদেশ কেন কিছুই পাচ্ছে না

কামরুল হাসান দর্পণ | প্রকাশের সময় : ১১ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে সম্পর্ক কেমন? কমন এ প্রশ্নটি যদি বাংলাদেশের জনগণের সামনে উপস্থাপন করা হয়, তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের উত্তর হবে একরকম, আর সরকারের নীতিনির্ধারকদের উত্তর হবে আরেক রকম। সরকারের নীতিনির্ধারকদের উত্তরটি একজন সাধারণ মানুষও সরাসরি বলে দিতে পারবে। উত্তরটি হবে, ‘অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অত্যন্ত সুমধুর। এক অনন্য উচ্চতায় রয়েছে।’ সাধারণ মানুষের উত্তরটি এমন দ্বিধাহীন চিত্তে হবে না। উত্তর দিতে গিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের আচরণের নেতিবাচক অনেক দিকই তাদের মনে জেগে উঠবে। প্রথমেই তাদের মনে এ প্রশ্নের উদয় হবে, ভারতকে তো আমরা উদার হয়ে সবই দিয়ে দিলাম, বিনিময়ে আমরা কী পেলাম? ভারত শুধু নিয়েই গেছে, কিছুই দেয়নি। আর ভারতের উত্তরও সবার জানা। কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশের মতো এমন উদার চিত্তের বন্ধু পৃথিবীতে আর নেই। যার কাছ থেকে চাইবামাত্র সব পাওয়া যায়, তার চেয়ে ভালো আর কে হতে পারে? নতুন করে ভারতের কাছ থেকে এর উত্তরও পাওয়া গেছে। গত শুক্র ও শনিবার রাজধানীর একটি হোটেলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ ও দিল্লির ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন যৌথভাবে দুই দিনের ‘বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সংলাপ’-এ ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির মুখপাত্র এম জে আকবর বলেছেন, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বর্তমান সময়ই ‘সেরা’। তার এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, ভারতের কাছে বর্তমান সম্পর্ক তো সেরা হবেই। কারণ বাংলাদেশের কাছ থেকে সে যা চেয়েছে, তার সবই পেয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান সরকারও তাকে দুই হাত ভরে দিয়েছে। যা চেয়েছে, তার সব চাহিদাই পূরণ করেছে। বিনিময়ে দেশ কিছু না পেলেও সরকার পেয়েছে ভারতের সমর্থন। কোনো সরকারের ক্ষমতায় থাকার জন্য দেশের ন্যায্য দাবি আদায় বা গিভ অ্যান্ড টেক পন্থা অবলম্বন না করে প্রতিবেশী দেশের চাহিদা অবলীলায় পূরণ করে দেয়ার মতো এমন নীতি অবলম্বন করে, তার নজির বিশ্বের আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা আমাদের জানা নেই। আরো বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, সংসদের বিরোধী দল এবং সংসদের বাইরের প্রধান রাজনৈতিক দলও এ নিয়ে টুঁ শব্দ করেনি বা করছে না। তাদের এই বিরোধিতা না করার বিষয়টিও অজানা নয়। কারণ তারা জানে, বিরোধিতা করলে সরকারের অংশীদারিত্ব ও সংসদে পোষ্য বিরোধী দলের ভূমিকা হারানোর শঙ্কা রয়েছে। অন্যদিকে সংসদের বাইরের প্রধান রাজনৈতিক দলের ক্ষমতায় যাওয়ার আশাটুকু হারিয়ে যাবে।

দুই.
ভারতের ক্ষমতাসীন দল এবং তার নেতারা এখন বাংলাদেশের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। প্রশংসায় বাংলাদেশকে ভাসিয়ে দিচ্ছে। গত শনিবার বিজেপির সাধারণ সম্পাদক রাম মাধব প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎকালে বলেছেন, বাংলাদেশের যে উন্নয়ন হচ্ছে, তা অতুলনীয়। বাংলাদেশ বলিষ্ঠ ও গতিশীল নেতৃত্বে এগিয়ে যাচ্ছে। তার এ কথা যদি আমরা দ্বিধাহীনভাবে বিশ্বাস করতে পারতাম, তাহলে এর চেয়ে উত্তম আর কিছু হতো না। বরং তার এ কথা শুনে যে কারও মনে হওয়া স্বাভাবিক, নিজ স্বার্থ বিবেচনা না করে যারা চাহিবামাত্র বিনাবাক্যে প্রয়োজনীয় সবকিছু দিয়ে দেয়, তারা তো যে কারও কাছেই ভালো হবে। তাদের মতো ভালো মানুষ আর হতে পারে না। পৃথিবীর নিয়মই হচ্ছে, দিতে পারলেই ভালো। কাজেই ভারত সরকারের সব চাহিদা যখন বাংলাদেশ সরকার পূরণ করেছে, তখন বাংলাদেশের মতো ভালো দেশ তার কাছে আর কে হতে পারে! ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কটা এখন এমনই। বাংলাদেশ সফরে এসে বিজেপির সাধারণ সম্পাদক নতুন একটি কথা শুনিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশকে ভারত এখন আর বিগ ব্রাদার বা বড় ভাইয়ের দৃষ্টিতে দেখে না। তার অর্থ হচ্ছে, ভারত এতদিন বাংলাদেশকে সমমর্যাদা ও সৎপ্রতিবেশীর দৃষ্টিতে দেখেনি। বাংলাদেশের বড় ভাই হয়েছিল এবং বড় ভাইয়ের মতোই ধমক ও খবরদারির মধ্যে রাখত (এখনও যে রাখছে, তা সবাই জানেন)। এর মধ্য দিয়ে এতদিন ধরে এদেশের জনগণ ভারতের বিরুদ্ধে ‘দাদাগিরি’র যে অভিযোগ করে আসছিল, তারই স্বীকৃতি মিলেছে। ভারত ও বাংলাদেশের সরকার দুই দেশের সম্পর্ককে যে এতদিন বন্ধুত্বপূর্ণ বলে আসছিল, তা যে সঠিক ছিল না এবং জনগণের কথাই সঠিক ছিল, তা প্রমাণিত হয়েছে। অথচ যে কোনো প্রতিবেশী দেশের কাছেই প্রত্যেক দেশ সমমর্যাদার সম্পর্কই কামনা করে। এর ব্যত্যয় পরোক্ষভাবে দেশের আত্মসম্মানের ওপর হস্তক্ষেপ বোঝায়। এই হস্তক্ষেপকেই আমাদের দেশের একটি শ্রেণী মেনে নেয় এবং এখনও মেনে নিচ্ছে। ভাবটা এমন বড় ভাই চড় মেরেছে; তিনিই তো মারবেন! আবার কেউ কেউ ভারত আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল, এ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে গিয়ে বিগলিত হয়ে ওঠেন। হ্যাঁ, উপকারীর উপকারের কথা অবশ্যই স্বীকার করা উচিত। তবে এর অর্থ এই নয়, উপকারকারী তার ওপর খবরদারি করবে এবং যা চাইবে তা দিয়ে দিতে হবে বা তার কথামতো চলতে হবে। উপকারের অর্থ কারও মাথা কিনে নেয়া নয়। এ ধরনের স্বার্থবাদী উপকারকারীকে কি কখনো ভালোভাবে দেখা যায়? যারা বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য জীবনবাজি রেখে রণাঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, তাদের অনেকের মুখে প্রায়ই একটা কথা শোনা যায়, পিন্ডি থেকে মুক্ত হয়ে দিল্লির গোলামী করার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করিনি। দুঃখের বিষয়, মুক্তিযোদ্ধাদের এমন আক্ষেপ বাংলাদেশের শাসক গোষ্ঠীই হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করে না। তাদের কথাবার্তায় এমন ভাব পরিলক্ষিত হয়, দিল্লির সুনজর না থাকলে কস্মিনকালেও ক্ষমতায় থাকা বা যাওয়া যাবে না। কী অসম্মানজনক ও আত্মমর্যাদাহীন মনোভাব! অথচ আমরা স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছি শুধু জাতি হিসেবে স্বাধীন ও সার্বভৌম হিসেবে মাথা উঁচু করে বিশ্বের বুকে বসবাস করার জন্য, অন্য কারও আধিপত্যের কবলে পড়ার জন্য নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, হঠাৎ করে বিজেপি নেতা কেন বললেন, ভারত বাংলাদেশকে বিগ ব্রাদার বা বড় ভাইয়ের দৃষ্টিতে দেখে না? একটু উপলব্ধি করলেই এর উত্তর পাওয়া যাবে। বড় ভাই যখন ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে ধমক দিয়ে সব আদায় করে নেয় এবং চাওয়ার আর কিছু থাকে না, তখন ছোট ভাইয়ের সঙ্গে বড় ভাইসুলভ আচরণ করার প্রয়োজন পড়ে না। স্বার্থ হাসিল হয়ে গেলে তো সবকিছুই ‘ভাই ভাই ঠাই ঠাই’ হয়ে যায়। কাজেই ভারত এখন এ কথা বলতেই পারে। এম জে আকবর মৈত্রী সংলাপের কর্ম অধিবেশনে বক্তৃতা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘একাত্তরে আমরা দখলদার বাহিনীকে পরাজিত করলেও এ দেশে জেঁকে থাকা অপশক্তিকে রুখতে পারিনি। তাই গণতন্ত্রবিরোধী শক্তি ক্ষমতায় এসেছে।’ তার এ কথার অর্থ হচ্ছে, একাত্তরে যেন তারাই দেশ স্বাধীন করে দিয়েছে এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ের দেখভালের দায়িত্বও তাদের ছিল। একটু বেখেয়াল হওয়ায় গণতন্ত্রবিরোধী শক্তি ক্ষমতায় এসেছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়েও তারা হস্তক্ষেপ করার বিষয়টি মনেপ্রাণে ধারণ করে। এর প্রমাণ তো পাওয়া গেল, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের আগ মুহূর্তে। সে সময় ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বাংলাদেশে এসে যেভাবে একটি একতরফা নির্বাচন করার পরামর্শ দিয়ে যান, তা সচেতন মহলমাত্রই জানেন। তখন অভিযোগ উঠেছিল, ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছে এবং সরকারও তা মেনে নিয়েছে। অনেকে বলেন, ভারতের কূটকৌশলপূর্ণ পরামর্শের কারণে পুনরায় ক্ষমতায় আসার কৃতজ্ঞতা প্রকাশস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার ভারতের দীর্ঘদিনের চাওয়া স্থল ও নৌ ট্রানজিট দিয়ে দেয়। এর বিপরীতে সরকার কৃতিত্ব দাবি করতে থাকে ৪২ বছর আগে করা স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে। বলা বাহুল্য, এ চুক্তি বাস্তবায়ন কোনো নতুন পাওয়া ছিল না। শুধু পুরনো চুক্তির বাস্তবায়ন ছিল, যে চুক্তির বাস্তবায়ন হওয়ার কথা ছিল ৪২ বছর আগে। অথচ সরকার এমন ভাব দেখিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছে, যেন ভারতের কাছ থেকে বিরাট কিছু পাওয়া গেছে। এখন এ চুক্তিকে এক কুমিরের বাচ্চাকে সাতবার দেখানোর বিষয়ে পরিণত করে ব্যাপক সাফল্যের কৃতিত্ব প্রচার করে চলেছে। সরকার হয়তো বলতে পারে, অতীতের কোনো সরকার তো এই চুক্তির বাস্তবায়ন ভারতের কাছ থেকে আদায় করতে পারেনি। এ কথার যুক্তি থাকলেও এ যুক্তিও দেখানো যায়, অতীতের সরকারগুলো যদি ভারতের সব চাহিদা পূরণ করে দিত, তাহলে এ চুক্তি বাস্তবায়নে কোনো সমস্যা হতো না। যে ভেবেই হোক, অতীতের সরকারগুলো এমনকি বর্তমান ক্ষমতাসীন দল ইতোপূর্বে ক্ষমতায় থাকতেও ভারতের এ চাহিদা পূরণ করেনি। এর কারণ, ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশের জীবনমরণ সমস্যা হয়ে থাকা পানির ন্যায্য হিস্যা এবং এ সংক্রান্ত চুক্তি, সীমান্ত হত্যা বন্ধসহ অন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আদায়ে ট্রানজিটকে একটি বার্গেইনিং পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করা। বর্তমান সরকার বাংলাদেশের সমস্যাগুলো সমাধানে দর কষাকষির একমাত্র এই ইস্যুটিকে অবলীলায় দিয়ে দিয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশের সমস্যাগুলো সমাধানের আর কোনো কৌশলগত ও কার্যকর কোনো ইস্যু হাতে নেই। এসব সমস্যা সমাধানের বিষয়টি পুরোপুরি ভারতের খেয়ালখুশির ওপর চলে গেছে।

তিন.
ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের বিষয়টি যে সুকঠিন হয়ে পড়েছে, তা এক তিস্তা চুক্তি সম্পাদন নিয়ে ভারতের টালবাহানা থেকেই বোঝা যাচ্ছে। মৈত্রী সংলাপ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী বলে দিয়েছেন, ‘তিস্তা চুক্তির বিষয়ে বল এখন ভারতের কোর্টে। তিস্তা চুক্তি নিয়ে ইতোমধ্যে একটা খসড়া তৈরি হয়েছে। তাই এ বিষয়ে নতুন করে কোনো আলোচনা হবে না।’ তার অর্থ হচ্ছে, এ চুক্তি কবে হবে তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। এটি এখন পুরোপুরি ভারতের মর্জির ওপর নির্ভর করছে। ফলে এদেশের জনগণ বার বার প্রশ্ন করতেই পারে, ভারতের কাছ থেকে আমরা কী পেলাম? এই যে মৈত্রী সংলাপ হয়ে গেল, সেখানেও তো আলোচনায় বাংলাদেশের প্রাপ্তি নিয়ে কোনো কিছু উল্লেখ করা হয়নি। কেবল দুই দেশের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক, সম্পর্কের সেরা সময় ইত্যকার কথা এবং স্তুতি ছাড়া বাংলাদেশের প্রাপ্তির কোনো কথাই বলা হয়নি। এই স্তুতিতে এদেশের বিরক্তির কোনো শেষ নেই। তারা একতরফা বন্ধুত্বের নামে স্তুতি চায় না। তারা চায় গিভ অ্যান্ড টেক-এর মাধ্যমে সমমর্যাদার সম্পর্ক। ভারত একতরফাভাবে সব নিয়ে যাবে বিনিময়ে বাংলাদেশ কিছুই পাবে না, এ সম্পর্ক তাদের কাছে কেন বিশ্বের কারও কাছেই গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ তারা দেখছে, ভারত নির্দয়ভাবে পানি প্রত্যাহার করে নেয়ায় বাংলাদেশের নদ-নদীগুলো মরে গেছে। পানির অভাবে দেশের একটি বিশাল অংশে মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কৃষকরা সেচ প্রকল্পের লাখ লাখ একর জমিতে ফসল ফলানো কমিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের সরকার কি ভারতকে এ বিষয়গুলো অবহিত করেছে বা করছে? সরকার তো পারত, রাম মাধব, এম জে আকবরদের হেলিকপ্টারে চড়িয়ে বাংলাদেশের নদ-নদীগুলোর অবস্থা দেখিয়ে আনতে। বড়ই আফসোসের বিষয়, বাংলাদেশের জীবনমরণ এ সমস্যার ব্যাপারে সরকারের তরফ থেকে কোনো উদ্যোগই পরিলক্ষিত হচ্ছে না। কেবল সভা-সেমিনার করে দুই দেশের ভালো সম্পর্ক নিয়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা এবং আত্মতুষ্টিতে ভোগা ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। জনগণ দেখছে, সময়ের ‘সেরা সম্পর্ক’ বাংলাদেশের নদ-নদীতে পানি এনে দিতে পারছে না। কী এক বিচিত্র ও তাজ্জব এই ‘সেরা সম্পর্ক!’ এমন সম্পর্ক বিশ্বের আর কোথাও দেখা যায় না। এ কথা এখন নিশ্চিত করে বলা যায়, বাংলাদেশ অদূর ভবিষ্যতে ভারতের কাছ থেকে তার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় দূরে থাক, পারস্পরিক ব্যবসা-বাণিজ্যের ভারসাম্য, সীমান্ত হত্যা বন্ধসহ কোনো দাবিই আদায় করতে পারবে না। এমন আশঙ্কা বিশ্লেষকদের কথাবার্তায়ও প্রকাশিত হয়েছে। মৈত্রী সংলাপে সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, ‘স্থলসীমান্ত সমস্যা সমাধানে দুই দেশ ৪০ বছর অপেক্ষা করেছে। কিন্তু পানি সমস্যা সমাধানে আমরা আরো ৪০ বছর অপেক্ষা করতে পারি না। পানির সঙ্গে খাদ্য নিরাপত্তা ও অভিবাসন সরাসরি জড়িত।’ তার এ কথা থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, পানি সমস্যা সমাধানের বিষয়টি এক অনিশ্চিত পথের দিকে ধাবিত। এই অনিশ্চয়তা ভারতের আচরণ থেকেই বোঝা যাচ্ছে। সে পানির বিষয়ে কথা না বলে, বাংলাদেশের সঙ্গে সেরা সম্পর্ক, বর্তমান সরকার গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করেছে ইত্যাদি নানা প্রশংসামূলক কথার প্রলেপে বাংলাদেশের সমস্যাগুলোকে ঢেকে দিচ্ছে। ভারতের প্রশংসায় সরকারও গদগদ হয়ে উঠছে। তার এই গদগদ হওয়ার কারণ যে ভারতের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক সমর্থন লাভ, তা কারও বুঝতে অসুবিধা হয় না। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, ভারতের সঙ্গে সরকারের এত ভালো সম্পর্কের কোনো ফল বাংলাদেশের জনগণ দেখতে পাচ্ছে না। এই ভালো সম্পর্ক বাংলাদেশের সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারছে না। নিদেনপক্ষে তিস্তা চুক্তি করতে পারছে না। তাহলে এই ভালো সম্পর্কের অর্থ কী? আমরা জানি, মধুর সম্পর্কের মাধ্যমে বড় ভাই হোক, ছোট ভাই হোক বা বন্ধু হোক, যে কারও কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পাওয়া যায়, এমনকি অসম্ভব কিছুও আদায় করা যায়। ভারতের সঙ্গে যদি বাংলাদেশ সরকারের এতই মধুর সম্পর্ক থাকে, তাহলে সরকার তার কাছ থেকে কোনো কিছু আদায় করতে পারছে না কেন? এ নিয়ে খুব একটা আবদার করতেও তো দেখা যাচ্ছে না। উল্টো পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা বলে দিলেন, তিস্তা চুক্তির বল এখন ভারতের কোর্টে। তার অর্থ, তিনি এটি ভারতের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। ভাবটা এমন ভারত দিলে দেবে, না দিলে না দেবে। বন্ধুত্বের কী নমুনা! এমন বন্ধুত্ব দুনিয়াজুড়ে খুঁজে পাওয়া মুশকিলই বটে!

চার.
বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ভারত সরকারের সম্পর্ক ‘সেরা’ এটা অস্বীকারের উপায় নেই। তবে বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে সেরা সম্পর্ক কিনা, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। কারণ, সরকার জনগণের সমর্থনকে তোয়াক্কা না করে ভারতের সমর্থনকেই যে বেশি গুরুত্ব দেয়, তা আমরা ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে দেখেছি। ফলে জনগণ কী মনে করল না করল, তাতে সরকারের কিছু যায় আসে না। বাংলাদেশ শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে গেলেও সমর্থন দেয়ার কৃতজ্ঞতাস্বরূপ দেশের ন্যায্য দাবি-দাওয়া নিয়ে যে ভারতের সঙ্গে তর্ক-বিতর্কে যাবে না, তা নিশ্চিত। এর ফলে ভারত যে দাবিই করুক তা সে বিনাবাক্য ব্যয়ে দিয়ে দেবে, এটাই স্বাভাবিক। ইতোমধ্যে ভারতের মর্জি মতো ট্রানজিট মাশুল নির্ধারণ, মানবিক কারণের উছিলায় স্থল ও পানি পথে ভারতের এক অংশ থেকে আরেক অংশে বিনামাশুলে খাদ্য পরিবহনের সুবিধাসহ অন্যান্য অনেক সুবিধাই সরকার দিয়েছে। শুধুমাত্র ক্ষমতায় থাকার ক্ষেত্রে সমর্থন দেয়া নিয়ে দেশের অনেক ন্যায্য স্বার্থ বিসর্জন দেয়ার এমন নজির বিশ্বে আর একটিও আছে বলে আমাদের জানা নেই। এটা দুর্বল মেরুদ-ের সরকারের পরিচায়ক। আবার এই দুর্বলতা ও নতজানু সম্পর্ককে ‘সেরা’ সম্পর্ক হিসেবে অভিহিত করা এক ধরনের প্রপঞ্চ ছাড়া কিছুই নয়। যে কোনো সরকারের এ ধরনের আচরণ জাতির জন্য দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। এ কথা নিশ্চিত করেই বলা যায়, প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে আমাদের জনগণ কখনই মন্দ সম্পর্ক চায় না। তারা মনেপ্রাণে সুসম্পর্কই চায়। তবে এ সুসম্পর্কের ভিত্তি অবশ্যই সমমযার্দাপূর্ণ হওয়া বাঞ্ছনীয়। এক বন্ধু কেবল খেয়ে যাবে, আরেক বন্ধু অভুক্ত থেকে চেয়ে চেয়ে দেখবেÑ এটা কোনো বন্ধুত্ব হতে পারে না। দুঃখজনক হলেও সত্য, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক যেন অনেকটা এরকম হয়ে পড়েছে। ভারত বন্ধুত্বের কথা বলে তার স্বার্থের ষোলকলা পূর্ণ করে চলেছে, আর আমরা শুকিয়ে মরছি। ভারতের সঙ্গে এ ধরনের বন্ধুত্ব বাংলাদেশকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে, এ নিয়ে জনগণের মনে অনেক শঙ্কা। আমরা আশা করব, সরকারের সঙ্গে ভারতের যে সুমধুর সম্পর্ক বিরাজ করছে, তা কাজে লাগিয়ে সরকার দেশের সমস্যাগুলো সমাধানের কার্যকর উদ্যোগ নেবে। অন্তত তিস্তা চুক্তিটি করে দেখাবে, বাংলাদেশ কিছু পেয়েছে।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: যদি এতই মধুর সম্পর্ক তাহলে বাংলাদেশ কেন কিছুই পাচ্ছে না
আরও পড়ুন