Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভারত থেকে পেট্রোলিয়াম আমদানির চাপ

প্রকাশের সময় : ১১ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের শিলিগুড়ি থেকে ডিজেল আমদানি শুরুর উদ্যোগ নিয়েছে। আগামী ১৯ মার্চ শিলিগুড়ির নুমালিগড় তেল শোধনাগার থেকে রেলপথে প্রথম চালানে ২,২০০ মেট্রিক টন ডিজেল আমদানির ক্ষণটিকে উৎসবমুখর করতে সেদিন ভারতের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ভারত পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন এবং বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ছাড়াও বাংলাদেশের জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ উপস্থিত থাকতে পারেন বলে গতকাল প্রকাশিত একটি সংবাদে জানা গেছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের মত ভারতও বিদেশ থেকে আমদানিকৃত জ্বালানি তেলের উপর নির্ভরশীল। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কিছু বাড়তি সুবিধাও পেয়ে থাকে। তা’ ছাড়া জ্বালানি তেল পরিশোধনে নিজস্ব সক্ষমতা বাড়িয়ে স্বনির্ভরতা অর্জনের পাশাপাশি এ খাতে বাণিজ্যিক সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগও গ্রহণ করছে সরকার। এহেন বাস্তবতায় ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে তড়িগড়ি করে আসামের রিফাইনারী থেকে ডিজেল আমদানির সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার ঘটনা এ খাতে বাংলাদেশের নিজস্ব উদ্যোগগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। গতকাল প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ভারত পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন ‘অ্যাগ্রেসিভ লবিং’র মাধ্যমে বাংলাদেশের জ্বালানি তেলের বাজার অতিদ্রুত তাদের দখলে নিতে চাইছে। এরই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনকে দিনাজপুরের পাবর্তীপুরে অবস্থিত অয়েল ডিপোকে শিলিগুঁড়ি থেকে আমদানিকৃত ডিজেল মজুদের জন্য তড়িগড়ি করে প্রস্তুত করতে হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। শিলিগুড়ির নুমালিগড় তেল শোধনাগার থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে বাংলাদেশে তেল রফতানি করতে চায় ভারত পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি এ খাতের বিকাশে সরকারের মহাপরিকল্পনা ইতিমধ্যেই একটি ইতিবাচক আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এ খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়সাপেক্ষ নতুন নতুন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া এগিয়ে চলেছে। দেশের একমাত্র সরকারী মালিকানাধীন তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারীর সংস্কার ও সম্প্রসারণেরও পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। প্রায় ৪৮ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত, বছরে ১৫ লাখ টন পরিশোধনক্ষমতাসম্পন্ন ইস্টার্ন রিফাইনারীর নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ফরাসী কোম্পানী টেকনিকপের সঙ্গে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারকও স্বাক্ষরিত হয়েছে গত বছর নভেম্বরে। ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএল)’র সংস্কার এবং একটি নতুন ইউনিট তৈরীর প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে এই রিফাইনারীর তেল পরিশোধন ক্ষমতা তিনগুণ বেড়ে ৪৫ লাখ টনে উন্নীত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। আগামী ২০১৮ সালে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হলে তেল আমদানি খাতে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের পাশাপাশি তরল জ্বালানির উপজাত এলপিজিসহ অন্যান্য পেট্রোলিয়াম পণ্যের আভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন। পাইপলাইনে ভারত থেকে পরিশোধিত তেল আমদানির যে কোন সিদ্ধান্ত বাংলাদেশে পেট্রোলিয়াম শিল্পের বিকাশের পথে বড় ধরনের অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে। ভারত পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের কাছ থেকে পাইপলাইনে তেল আমদানি বাংলাদেশের বিকাশমান অর্থনীতি ও জ্বালানি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হিসেবে গণ্য হতে পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন বছরে ৫০ লাখ মেট্রিক টন জ্বালানি তেল আমদানি করে থাকে, যার আর্থিক মূল্য প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। জ্বালানিখাতে সরকারকে দীর্ঘদিন বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয়েছে। গত কয়েক বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য কমতে কমতে তিনভাগের একভাগে নেমে আসায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ অনেকটা সহজসাধ্য হচ্ছে। ভৌগলিক কারণেই আঞ্চলিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। মাতারবাড়ি কয়লাবিদ্যুতকেন্দ্রসহ ১০টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র, গভীর সমুদ্রবন্দর এবং সমুদ্রপথে জ্বালানি তেল আমদানির জন্য সিঙ্গেল মুরিং টার্মিনাল তৈরীর পরিকল্পনা গ্রহণ করে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে সমুদ্রোপকূলবর্তী মহেশখালিকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের একটি হাব হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বিতর্কিত রামপাল বিদ্যুতকেন্দ্রসহ অনেক উদ্যোগের সাথেই ভারতের বাণিজ্যিক অংশীদারিত্ব গড়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশের জ্বালানি, বিদ্যুৎ এবং সামুদ্রিকবন্দরের সক্ষমতাবৃদ্ধির এসব উদ্যোগে বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ, নেপাল, ভুটানসহ আঞ্চলিক বাণিজ্যের নতুন সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে। সেখানে ভারতের পক্ষ থেকে বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে চাপিয়ে দেয়া তেলবাণিজ্য বাংলাদেশের জ্বালানি খাতের বিকাশ ও উন্নয়নের রোডম্যাপকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে। ভারতের সাথে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বিভিন্ন সময়ে ভারতের একতরফা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের দ্বারা প্রভাবিত হতে দেখা গেছে। এমনিতেই বাংলাদেশের সাথে ভারতের অনুকূলে বাণিজ্য বৈষম্য বেড়ে চলেছে। এ প্রেক্ষিতে, জ্বালানিখাতে ভারত নির্ভরতা সেই বৈষম্যকে আরো বাড়িয়ে তোলার পাশাপাশি আমাদের জ্বালানি নিরাপত্তায় বড় ধরনের হুমকি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যের কুয়েত, আরব আমিরাত, মিশর ছাড়াও চীন, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনাম থেকেও বাংলাদেশ জ্বালানি আমদানি করে থাকে। তবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের মত অতীব গুরুত্বপূর্ণ খাতে বাংলাদেশকে ভারত নির্ভর করে তোলার যে কোন প্রয়াস সচেতনভাবে এড়িয়ে চলা বাঞ্ছনীয়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভারত থেকে পেট্রোলিয়াম আমদানির চাপ
আরও পড়ুন