Inqilab Logo

বুধবার, ২৬ জুন ২০২৪, ১২ আষাঢ় ১৪৩১, ১৯ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

কমছে পানি বাড়ছে আহাজারি

| প্রকাশের সময় : ২০ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

যমুনার পানি এখন বিপদসীমার নীচে : সুরমা কুশিয়ারা ধলেশ্বরী পদ্মা আড়িয়াল খাঁয় পানি কমছে, ভাঙন বাড়ছে, নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী মসজিদ, ঘর-বাড়ি ও ফসলি জমি। বাড়ছে বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ, ছড়িয়ে পড়েছে রোগব্যাধি
ইনকিলাব ডেস্ক : দেশের প্রায় সবগুলো নদীর পানি কমতে থাকায় বন্যার প্রকোপ কমে আসছে। তবে বাড়ছে নদীভাঙন। আর গৃহহারা মানুষের দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে। সেই সঙ্গে বানভাসি মানুষের আহাজারিতে বাতাস ভারি হয়ে উঠছে।
বরগুনায় ভাঙনে দিশেহারা তালতলীর তেতুলবাড়ীয়ার বাসিন্দারা। মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ায় শতাধিক বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে, ভাঙনের মুখে ৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
বন্যা কবলিত ও পানিবন্দি মানুষ খাদ্য ও আশ্রয় সঙ্কটে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। বন্যা ও নদী ভাঙনের শিকার মানুষের দুঃখ-কষ্টের কথা তুলে ধরে আমাদের সংবাদদাতাদের পাঠানো তথ্যের আলোকে ডেস্ক রিপোর্ট-
চট্টগ্রাম থেকে বিশেষ সংবাদদাতা জানান, বন্যার পানি ধীরে ধীরে আরও কমে এসেছে। কিন্তু খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি, ওষুধ-পথ্য, আশ্রয়স্থল তথা বন্যায় ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত বসতঘর মেরামতের অভাবে বন্যা কবলিত এলাকাগুলোতে এখনও থামেনি বন্যার্ত লাখো অসহায় মানুষের সীমাহীন কষ্ট আর দুর্ভোগ। ত্রাণ সহায়তা এখনও খুবই অপ্রতুল। বন্যার্ত পরিবারগুলো এখন পানি নামার পর নিজেদের বাড়িঘরে অনেকেই ফিরে গেছেন। কিন্তু প্রায় বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে দিশেহারা। তারা এ মুহূর্তে চান গৃহনির্মাণসামগ্রী। যা অসহায় পরিবারগুলোর ক্রয়ক্ষমতার বাইরে।
তাছাড়া বন্যার্ত বেশিরভাগ মানুষের হাতে এখন কাজকর্ম নেই। নেই আয়-রোজগারের উপায়। এতে জীবনধারণ কঠিন হয়ে পড়েছে। এদিকে গতকাল (বুধবার) সর্বশেষ তথ্য-উপাত্ত অনুসারে টানা প্রায় দুই সপ্তাহ পর যমুনা নদ এখন সবক’টি পয়েন্টেই বিপদসীমার নীচে নেমে গেছে। অন্যদিকে টাঙ্গাইলে ধলেশ্বরী নদী এবং সিলেটে সুরমা-কুশিয়ারা এই তিনটি নদীতে ৫টি পয়েন্টে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। তবে সবক’টি পয়েন্টে পানি হ্রাস অব্যাহত থাকায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র সূত্র জানায়, সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে, তা অব্যাহত থাকতে পারে। দেশের মোট ৯০টি পানির সমতল পর্যবেক্ষণ পয়েন্টের মধ্যে গতকাল পানি বৃদ্ধি পায় ২৫টিতে। হ্রাস পায় ৫৮টি পয়েন্টে। অপরিবর্তিত থাকে ৪টি পয়েন্টে। নদ-নদীর প্রবাহের পূর্বাভাসে জানা গেছে, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, পদ্মা ও সুরমা-কুশিয়ারা নদ-নদীসমূহের পানির সমতল আরও হ্রাস পাচ্ছে। গঙ্গা নদীর পানি কিছুটা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনায় পানি হ্রাস আগামী ৭২ ঘণ্টায় অব্যাহত থাকতে পারে। গঙ্গা নদীর পানি বৃদ্ধি আগামী ২৪ ঘণ্টায় স্থিতিশীল থাকতে পারে। পদ্মা সদীর পানির সমতল হ্রাস আগামী ৭২ ঘণ্টায়ও অব্যাহত থাকতে পারে। অন্যদিকে সিলেট অঞ্চলে সুরমা-কুশিয়ারা নদ-নদীর পানি হ্রাস আগামী ২৪ ঘন্টায়ও অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
বরগুনা থেকে মোঃ মোশাররফ হোসেন জানান, সারা বছরই নদীতে স্বাভাবিক জোয়ারের থেকে সামান্য পানি বাড়লেই প্লাবিত হয় গ্রামের পর গ্রাম। বন্ধ হয়ে যায় রান্না, ভাসিয়ে নিয়ে যায় ঘরের আসবাপত্র। বছরের পর বছর এমন ভোগান্তি পোহাচ্ছে বেড়িবাধের পার্শবর্তী এলাকার বসবাসরত বাসিন্দারা। অনেকে ঘড়-বাড়ি ছেড়ে মাথা গোজাঁর ঠাই পেতে চলে গেছেন অন্যত্র। একারনে নদী ভাঙনে দিশেহারা হয়ে পরেছে বরগুনা জেলার তালতলী উপজেলার তেতুলবাড়ীয়া গ্রামের বাসিন্দারা। সিডরে ভাঙনের পর তেতুলবাড়িয়া বেরিবাধটি দশ বছরেও স্থায়ী ভাবে নির্মান করতে পারেনি পানি উন্নয়ন বোর্ড।
জানা যায়, ২০০৭ সালের ঘূর্ণীঝড় সিডরে তালতলী উপজেলার তেতুলবাড়িয়ার এ বাঁধটির বেশ কিছু স্থান স¤পুর্ণ বিদ্ধস্ত করে ফেলে। বাধের কিছু কিছু জায়গা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়। এরপর নদীর অনবরত ভাঙন বাঁধটিকে আরোও দুর্বল করতে থাকে। বাঁধের পাশে থাকা অনেক পরিবার বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে অন্যত্র। প্রতি মাসে অমাবশ্যা ও পূর্ণীমার সময় নদীতে বাড়ে জোয়ারের পানি। ৪ থেকে ৫ দিন ধরে ঘর, বাড়ি রাস্তাঘাট সবকিছু জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়ে থাকে। বন্ধ হয়ে যায় রান্না খাওয়া, দূর্ভোগের শেষ থাকেনা এলাকাবাসীর। লবন পানিতে বার বার প্লাবিত হওয়ায় জমির ফষল নষ্ট হয় প্রতিবার। তেতুলবাড়ীয়া গ্রামের বাসিন্দা জয়নাল, ফারুক, হেমায়েত জানান, বর্ষা মৌসুমে মাঝে মধ্যে জরুরি মেরামতের কাজ শুরু হয়। সেই কাজের নামেও চলে লুট-পাট। যদি ভালো করে কাজ করা হতো, তাহলে পরিবার পরিজন নিয়ে নদীর তীরে হলেও বাস করতে পারতাম। বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী এসএম মশিউর রহমান জানান, স্থায়ী ভাবে বেরিবাধ নির্মানের জন্য যে পরিমান অর্থ দরকার তেমন বরাদ্দ আসছে না। আর্থিক সংকটের কারনে বাধ্য হয়ে বরাবরের মতো বেরিবাধ ভাঙার পর জরুরি মেরামতের বিকল্প নেই।
শিবচর (মাদারীপুর) থেকে এম সাঈদ আহমাদ জানান, পদ্মা ও আড়িয়াল খা নদের পানি কমতে থাকায় মাদারীপুরের শিবচরের ৩ ইউনিয়নে নদী ভাঙনের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ পর্যন্ত এ ৩ ইউনিয়নের শতাধিক বাড়ি ঘর নদীতে বিলীন হয়েছে। আড়িয়াল খার ভাঙনে আক্রান্ত হয়েছে একটি শতবর্ষী ঐতিহ্যবাহী মসজিদ। ভাঙন ঝুকিতে রয়েছে স্কুল-মাদ্রাসাসহ অসংখ্য স্থাপনা।
জানা যায়, পদ্মা ও আড়িয়াল খা নদের পানি কমতে থাকায় উপজেলার পদ্মা নদীর চরাঞ্চল কাঁঠালবাড়ি, চরজানাজাত ও আড়িয়াল খা নদের তীরবর্ত্তী সন্ন্যাসীরচরে নদী ভাঙনের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেয়েছে। পানি কমলেও পানির তোড়ে ও তীব্র স্রোতের ফলে চরাঞ্চলের কাঠালবাড়ি ও চরজানাজাত ইউনিয়নের ৮০টি ঘরবাড়ি নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। তবে এখনো পানিবন্দী হয়ে রয়েছে চরের ৪ ইউনিয়নের হাজার হাজার পরিবার। নদী ভাঙন কাছাকছি চলে আসায় কাউলিপাড়া দারুল উলুম মাদ্রাসা ও মাদানী কমপ্লেক্স এ সরিয়ে নেয়া শুরু হয়েছে। ভাঙন ঝূকিতে রয়েছে চরাঞ্চলের একমাত্র মাধ্যমিক বিদ্যালয় ইলিয়াস আহম্মেদ চৌধুরী মাধ্যমিক বিদ্যালয়টিসহ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অসংখ্য ঘরবাড়ি। আড়িয়াল খা নদের ভাঙনে সন্ন্যাসীরচরের ৮ নং ওয়ার্ডের শতবর্ষী প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী একটি মসজিদ ভাঙন আক্রান্ত হয়েছে। ইউনিয়ন যুবলীগ সভাপতি আবুল হোসেনের বাড়িসহ ১৫টি ঘরবাড়ি নদীতে বিলীন হয়েছে। এদিকে মঙ্গলবার বিকেলে পদ্মা নদীর ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্থ কাঁঠালবাড়ি ইউনিয়নের কাওলীপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকা জেলা প্রশাসক ওয়াহিদুল ইসলাম, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইমরান আহমেদ, উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) শরিফুল ইসলাম পরিদর্শন করেছেন।
মাদারীপুর জেলা প্রশাসক ওয়াহিদুল ইসলাম বলেন, নদী ভাঙন কবলিতদের জন্য আমরা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট ত্রানের চাহিদা পাঠিয়েছি। আশা করি দু-এক দিনের মধ্যেই আমরা ত্রান পৌছে দিতে পারবো। আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আপাতত উচু স্থানে অস্থায়ী ঘর তুলে চালু রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
সাটুরিয়া (মানিকগঞ্জ) মো: সোহেল রানা খান জানান, মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলার নদীর পানি
বৃদ্ধির সাথে সাথে বেড়েছে ভাঙন। উপজেলায় ৩টি ইউনিয়নে ধলেশ্বরী ও কালিগঙ্গা নদীর ভাঙঙ্গনে নদী গর্ভে বিলিন হয়ে গেছে শতাধিক বাড়ি, কাচা পাকা সড়ক, ফসলি জমি বাশঝাড়। আর ধলেশ্বরী ও কালিগঙ্গা নদীর ভাঙনের কারনে হুমকির মধ্যে আছে উপজেলার ৪টি উচ্চ বিদ্যালয়, ৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১টি মাদ্রাসা, ২টি বাজার, বড় ব্রিজ, কবর স্থানসহ বহু স্থাপনা।
বাড়িহারা শতাধিক পরিবারের কয়েক শতাধিক মানুষ আশ্রয় নিয়েছে অন্যানের বাড়ি ও খোলা আকাশের নিচে। রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে না খেয়ে দিন পাড় করলেও এখন পর্যন্ত তালিকা ছাড়া কোনো কিছু মিলেনি ওই পরিবার গুলোর।
সরেজমিনে এ তিনটি ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে দেখা গেছে, ভাঙন কবলিত পরিবারগুলি সবচেয়ে কষ্টে আছে। বিগত এক সপ্তাহে শতাধিক বাড়ি ভাঙনের স্বীকার মানুষগুলি খোলা আকাশের নিচে টিন ফেলে ও অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। গবাদি পশু নিয়ে তারা পড়েছে বিপাকে।
ভাঙনের শিকার ছনকা গ্রামের মোন্তাজ আলী জানায়, বাড়ি ছাড়া হইছি ঠাই নিয়ে ফসলের ক্ষেতের মধ্যে ভাঙা টিনের ঘরটি কাওরা দিয়ে আছি। কিন্তু বৃষ্টি নামলেই পরিবার নিয়ে ভিজতে হয়। আমরা নদী ভাঙন থেকে স্থায়ী মুক্তি চাই।
মানিকগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড এর সহকারী প্রকৌশলী মো. আব্দুল হামিদ মিয়া জানায়, আমরা ওই সব নদীভাঙন কবলিত এলাকা সরজমিনে পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বন্যা

১৫ অক্টোবর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ