দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
এ. কে. এম. ফজলুর রহমান মুনশী
আল্লাহর সন্তুুষ্টির লক্ষ্যে মানুষের উপর বাইতুল্লাহ-এর হজ্জ করা ফরজ। (সূরা আলে ইমরান : রুকু-১০) ইসলামী ইবাদতের চতুর্থ রোকন হচ্ছে হজ্জ। আর এটাই হচ্ছে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগীর মানুষের প্রাথমিক ও আদি তরীকা।
হজ্জের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে ইচ্ছা ও আকাংখা করা। এবং এর উদ্দেশ্য হচ্ছে ধর্মীয় আশা-আকাংখা বাস্তবায়নে কোনও পবিত্র স্থান ভ্রমণ করা। কিন্তুু ইসলামের দৃষ্টিতে হজ্জ হচ্ছে আরব দেশের মক্কা শহর গমন করে হযরত ইব্রাহীম (আ:) কর্তৃৃক নির্মিত মসজিদ ‘খানায়ে কা’বার’ চতুর্দিকে প্রদক্ষিণ করা এবং মক্কার বিভিন্ন পবিত্র স্থানসমূহে হাজির হয়ে আদব এবং কর্মানুষ্ঠান প্রতিপালন করা।
মানবিক সভ্যতার প্রাথমিক ইতিহাস পাঠকারীদের অবশ্যই জানা আছে যে, মানব সমাজের প্রাথমিক আকার আয়তন খান্দান ও বংশভিত্তিক ছিল। এরপর অগ্রসর হয়ে তা কতিপয় তাঁবু ও ঝুপড়ি সদৃশ আবাদী এলাকায় পরিণত হয়। এর বহু পরে তা নগর কেন্দ্রিক সভ্যতায় উন্নীত হয়। এরপর বহু উন্নতি সাধিত হলে একটি কাওম বা জাতি এবং একটি রাষ্ট্র বা দেশের রূপ পরিগ্রহ করে। আর এই নগর সভ্যতাই মানুষ বৃদ্ধির সাথে সাথে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছে।
মক্কা হচ্ছে মানবিক উন্নতি ও অগ্রগতির যাবতীয় পর্যায় ও শ্রেণী বিন্যাসের এক বিন্যস্ত ইতিহাস। সে স্থানটি হযরত ইব্রাহীম (আ:)-এর জমানায় একটি সুনির্দিষ্ট খান্দানের ধর্ম প্রচারের প্রাণকেন্দ্র ছিল। তারপর হযরত ইসমাঈল (আ:)-এর জমানায় তা কতিপয় তাঁবু এবং ঝুপড়ির সমন্বয়ে একটি ক্ষুদ্র জনবসতিরূপে গড়ে উঠে। এরপর ক্রমশ: তা আরবের ধর্মীয় শহরের স্থান দখল করে নেয়। আর মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর নবুয়ত লাভের পর এটা ইসলামী দুনিয়ার ধর্মীয় কেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃত হয়।
দুনিয়ায় প্রাথমিক আবাদী প্রতিষ্ঠারকালে এই দস্তুর ছিল যে, প্রত্যেক আবাদী সুনির্দিষ্ট এলাকায় দু’টি মর্যাদাপূর্ণ মহল বানানো হত। এর একটি ছিল সে এলাকার বাদশাহের মহল বা দুর্গ এবং অপরটি ছিল সে এলাকার কাহিনীকার বা ধর্মগুরু এবং উপাসকদের জন্য। সামগ্রিকভাবে প্রতিটি আবাদী কোন না কোন নক্ষত্র বা দেবতার প্রতি অনুরক্ত ছিল এবং তারা সে দেবতার অথবা নক্ষত্রের আশ্রয়ে থাকার জন্য উদগ্রীব থাকত। তারা সেই আশ্রয়দাতা নক্ষত্র বা দেবতার পূজা-অর্চনাও করত। এই পূজার মÐপ বা আরাধনার জন্য উন্মুক্ত জায়গাটি শান্তির নিবাস বলে চিহ্নিত হত। তাদের নজর-নিয়াজের যাবতীয় অর্থ-কড়ি এবং উৎপাদিত পণ্যসম্ভার সেখানেই জমা করা হত। আর যতই এই আবাদীর বাদশাহী ও সা¤্রাজ্য বর্ধিত ও বিস্তৃত হত ঠিক ততই সেই দেবতার সা¤্রাজ্য অথবা পূজা-অর্চনার সীমানা বিস্তৃত হতে বিস্তৃততর হয়ে উঠতো। (তৌরাত গ্রন্থে ও বাবুল কালিদানের পুরাতন কাব্যগ্রন্থে এবং ইতিহাস ও পুরাতাত্তি¡ক গ্রন্থাবলীতে এসবের বর্ণনা পাওয়া যায়; তাছাড়া আরদুল কুরআন গ্রন্থেও এ সকল বিষয়ের সম্যক বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে।)
হযরত ইব্রাহীম (আ:)-এর পৈতৃক নিবাস ছিল ইরাকে। তৎকালে সেখানে কালিদানী সম্প্রদায়ের বসতি ও সা¤্রাজ্য ছিল। এই সাম্রাজ্য জুড়ে নক্ষত্রের পূজা-অর্চনা প্রচলিত ছিল। হযরত ইব্রাহীম (আ:) নুবওত লাভ করার পর এই দুনিয়ার বুকে সর্বপ্রথম নক্ষত্র পূজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং এক আল্লাহর উপাসনার প্রতি আহŸান জানান। ফলে তাঁর বংশধর ও গোত্রের লোকেরা এর জন্য তাঁর প্রতি অকথ্য নির্যাতনের স্টীমরোলার চালাতে থাকে। পরিশেষে তাঁকে স্বদেশ পরিত্যাগ করে সিরিয়া, মিসর ও আরবে হিজরত করতে হয়। এ সকল স্থানে হযরত আদম (আ:)-এর পুত্র সামের বংশধরগণ বসবাস করত। কালক্রমে তারা বিভিন্ন নামে এ সকল স্থানে নিজেদের সা¤্রাজ্যও গড়ে তুলেছিল।
পুরাতত্ত¡, বংশানুক্রমিক ধারা, ভাষা এবং অন্যান্য ইতিহাসের নমুনা হতে এ কথা সুস্পষ্ট জানা যায় যে, আরব ভূমি ছিল সামের বংশধরদের আদি আবাস ভূমি। এখান হতে বের হয়েই তারা ইয়েমেন এবং ফিলিস্তিনে পৌঁছেছিল। মিসরে এই বংশের লোকেরা ‘হিকসুস’ বা বেদুঈন শাসক নামে রাজ্য শাসন করত। (আরদুল কুরআনে এর বিশদ বিবরণ রয়েছে।)
হযরত ইব্রাহীম (আ:) অত্র এলাকার বিভিন্ন জনপদ ও শহর পরিভ্রমণ করে আরব ও সিরিয়া গমন করেন এবং মৃত সমুদ্রের সন্নিকটে জর্ডানে স্বীয় ভ্রাতুষ্পুত্র হযরত লূত (আ:)-কে আবাদ করেন। আর স্বীয় তনয় ইসহাক (আ:)-কে কেনান বা ফিলিস্তিনে বসতিস্থাপনের নির্দেশ দেন। আর অপর ছেলে মাদায়ুনকে ও অন্যান্যকে হিজাজের দিকে লোহিত সাগরের উপকূলে সেই স্থানে বসবাস করান যা আজও মাদায়েন নামে পরিচিত। এরও আগে অগ্রসর হয়ে তিনি স্বীয় পুত্র ইসমাঈল (আ:)-কে ফারান উপত্যকায় বসতি নির্মাণের আদেশ প্রদান করেন। বস্তুুত : এ সকল স্থান ছিল এমন রাজপথ তুল্য যেখানে মিসর ও সিরিয়া হতে হিজাজ ও ইয়েমেন এবং হিজাজ ও ইয়েমেন হতে সিরিয়া গমনাগমনকারী ব্যবসায়ী, সওদাগর এবং কাফেলার লোকদের যাতায়াত স্থল ছিল। লোকজন এসব এলাকা দিয়েই সর্বদা যাতায়াত করত।
এই বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে নিজের সন্তান-সন্তুতি ও বংশধরদের বসতি স্থাপনের পেছনে হযরত ইব্রাহীম (আ:)-এর দু’টি উদ্দেশ্য নিহিত ছিল। প্রথমত, ব্যবসায়ী কাফেলার গমনাগমনের ফলে তাদের প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী লাভে যেন অসুবিধা না হয় এবং একই সাথে তারা যেন সহজে ব্যবসা-বাণিজ্যে অংশগ্রহ করতে পারে। দ্বিতীয়ত, আল্লাহর খালেস তাওহীদের শিক্ষা প্রচারের জন্য এ সকল স্থান ছিল উত্তম কেন্দ্র। তাছাড়া ইরাক এবং সিরিয়ার অত্যাচারী ও নিষ্ঠুর গোত্রগুলোর সীমানার বাইরে অবস্থান করে নক্ষত্র পূজারী ও মূর্তি পূজারীদের খপ্পর হতে নিজেদেরকে রক্ষা করতে সক্ষম হবে এবং এরই ফাঁকে সত্য ধর্মের প্রচার ও প্রসারে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে।
বাইতুল্লাহ : হযরত ইব্রাহীম (আ:)-এর দস্তুর ছিল যে, যেখানেই তিনি রূহানিয়াত বা আধ্যাত্মিকতার জ্যোতি অবলোকন করতেন, সেখানেই আল্লাহর নামে একটি পাথর খাড়া করে আল্লাহর ঘর এবং কুরবানীর স্থান নির্মাণ করতেন। সুতরাং তৌরাত কিতাবের পয়দায়েশ পর্বে তাঁর তিনটি কুরবানীর স্থান বা আল্লাহর ঘর নির্মাণের ঘটনা বিবৃত আছে। ‘তারপর আল্লাহপাক আব্রাহামকে দর্শন দান করে বললেন : এই মুলুকেই আমি তোমার বংশধরকে পরিবর্ধিত করব। এবং সেখানে তিনি আল্লাহর জন্য যা তাঁর নিকট প্রকাশ পেয়েছিল একটি কুরবানগাহ নির্মাণ করলেন এবং সেখান হতে রওয়ানা হয়ে বাইতে ঈল (বাইতুল্লাহ)-এর পূর্বপ্রান্তে একটি পাহাড়ের সন্নিকটে নিজের আস্তানা কায়েম করলেন। ‘বাইতে ঈল’ ছিল এর পশ্চিমে এবং আঈ ছিল এর পূর্বে। সেখানে তিনি আল্লাহর জন্য একটি কুরবানগাহ নির্মাণ করলেন এবং আল্লাহর নাম স্মরণ করলেন।’ (১২-৭,৮)
এরপর তৌরিতে উল্লেখ করা হয়েছে : ‘এবং তিনি (ইব্রাহীম) ভ্রমণ করতে করতে দক্ষিণ দিক হতে ‘বাইতে ঈল’- এর ঐ স্থান পর্যন্ত পৌঁছলেন সেখানে তিনি প্রথমে একটি কুরবানগাহ নির্মাণ করলেন এবং সেখানে ইব্রাহীম (আ:) আল্লাহর নাম স্মরণ করলেন।’ (১৩-১৪)
তারপর তিনি অপর একটি স্থানে পৌঁছলেন, সেখানে আল্লাহর অহী এবং এবং বরকতময় পয়গাম লাভ করলেন এবং তাঁকে নির্দেশ করা হলো : “উঠ! এবং এই অঞ্চলের দৈর্ঘ্য ও প্রন্থে ভ্রমণ কর, এই অঞ্চলটি আমি তোমাকে দান করব। তাই ইব্রাহীম (আ:) স্বীয় আস্তানা গুটিয়ে নিলেন এবং ধূলি-ধূসর অঞ্চলের দিকে গমন করলেন এবং সেখানে একটি কুরবানগাহ নির্মাণ করলেন।” (১৩-১৭-১৮)
এই শ্রেণীর কুরবানগাহ এবং আল্লাহর ঘর হযরত ইসহাক (আ:), হযরত ইয়াকুব (আ:) এবং হযরত মূসা (আ:)-ও নির্মাণ করেছিলেন। তার পর হযরত দাউদ (আ:) ও হযরত সুলাইমান (আ:) বাইতুল মুকাদ্দাস নির্মাণ করে ছিলেন যা বনী ইসরাঈলের কা’বা এবং কিবলা হিসেবে বরিত হয়।
হযরত ইসহাক (আ:)-এর ঘটনায় বলা হয়েছে যে, যেখানে তাঁর ওপর অহী এবং অঙ্গীকারের বেশারত নাজিল হয়েছিল “সেখানে তিনি কুরবানগাহ তৈরী করে ছিলেন এবং সেখানে ইসহাক (আ:)-এর চাকরগণ একটি কূপ খনন করেছিল।” (পয়দায়েশ : ২৬-২৫)
হযরত ইয়াকুব যেখানে সত্য স্বপ্ন দেখে ছিলেন সে স্থান সম্পর্কে বলা হয়েছে, “এবং ইয়াকুব (আ:) প্রত্যুষে গাত্রোত্থান করলেন। তারপর সে পাথরটিকে খাড়া করলেন যার উপর তিনি হেলান দিয়ে বসেছিলেন এবং এর উপর তৈল ঢেলে দিলেন এবং সেই স্থানটির নাম ‘বাইতে ঈল’ রাখলেন এবং বললেন : আর এই পাথরটি যা আমি দেয়ালরূপে খাড়া করেছি, তা হবে আল্লাহর ঘর। আমাকে প্রদত্ত দ্রব্য-সামগ্রী হতে এক-দশমাংশ তোমাকে (আল্লাহকে) দান করব। (২৮-১৮-২২)
হযরত মূসা (আ:)- কে হুকুম করা হয়েছিল : আর যদি তুমি আমার জন্য পাথরের কুরবানগাহ নির্মাণ কর তাহলে মসৃণ পাথর দ্বারা তা’ নির্মাণ করো না। কেননা এতে তুমি যদি অলংকার সংযোজন কর, তাহলে তাকে অপবিত্র করে দেবে। আর তুমি আমার কুরবানগাহ সিঁড়ি দ্বারা আরোহণ করো না, যাতে তোমার বস্ত্রহীনতা এতে প্রকাশ না পায়।” (নির্গমন : ২০-২৫-২৬)
হযরত মূসা (আ:) আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক “একটি পাহাড়ী উপত্যকায় একটি কুরবানগাহ ও বনী ইসরাঈলের বারটি গোত্রের জন্য বারটি দেয়াল নির্মাণ করলেন। ...এবং শান্তিপূর্ণ কুরবানীর পশু গরুগুলো আল্লাহর নামে যবেহ করলেন। এগুলোর অর্ধেক রক্ত তিনি বিভিন্ন পাত্রে রাখলেন এবং বাকী অর্ধেক কুরবানগাহে ছিটিয়ে দিলেন।”
উপরোল্লিখিত উদ্ধৃতিগুলোতে এই শ্রেণীর নির্মাণ শৈলী অথবা স্থানগুলোর নাম (মাজবাহ বা কুরবানগাহ) বলে দেয়া হয়েছে এবং এবং এর দ্বারা বাইতে ঈল বা বাইতুল্লাহ বা আল্লাহর ঘরের অস্তিত্ব প্রতিপন্ন হয়েছে। হযরত ইব্রাহীম (আ:) এবং তাঁর বংশধরদের মাঝে এ জাতীয় কুরবানগাহ বা বাইতুল্লাহ নির্মাণের প্রচলন ছিল। যা মক্কা মুয়াজ্জমার কা’বা এবং মসজিদে হারাম ও মসজিদে ইব্রাহীম (আ:) নামে আজোও কায়েম আছে। এ সম্পর্কে ইসলামের দাবী হচ্ছে এই যে, দুনিয়ার বুকে এটাই হচ্ছে সর্বপ্রথম নির্মিত আল্লাহর ঘর।
হযরত ইসমাঈল (আ:)-এর কুরবানী এবং শর্তাবলী :
কুরআনুল কারীমের বিবরণ অনুসারে জানা যায় যে, হযরত ইব্রাহীম (আ:) আপন একমাত্র প্রাণপ্রিয় পুত্রকে কুরবানী করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। আর তৌরাতের বর্ণনা অনুসারে জানা যায় যে, যাকে কুরবানী করার হুকুম হয়েছিল তিনি ছিলেন হযরত ইসমাঈল (আ:)। আর এ কথাও সেখানে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তৌরাতের মর্ম অনুসারে কুরবানীর মর্ম হলো : নির্দিষ্ট বস্তু বা প্রাণীকে আল্লাহর ইবাদতগাহের খেদমতের জন্য উৎসর্গ করা। তারা উৎসর্গীকৃত বস্তুু বা প্রাণীর গায়ে হাত রাখতো এবং সেই প্রাণীকে উৎসর্গকৃত সন্তানের পরিবর্তে জবেহ করতো। আর যে সকল ব্যক্তিকে আল্লাহর ইবাদতগাহের খেদমতের নামে উৎসর্গ করা হত তারা কুরবানীর দিনে নিজেদের মাথার চুল কাটতো না। যখন কুরবানীর দিন পুরা হয়ে যেত, তখন নিজেদের মাথা মুড়িয়ে ফেলতো। যে বস্তুু বা প্রাণী কুরবানীর জন্য নির্ধারিত করতো বা উপস্থাপন করতো, সেগুলো প্রথমে কুরবানগাহে ঘুরানো হত। তারপর সেগুলোকে কুরবানী করা হত বা জ্বালিয়ে দেয়া হতো।
কুরবানী : মিল্লাতে ইব্রাহীমের বিশেষত্ব
তৌরাত এবং আল কুরআনের আলোকে জানা যায় যে, মিল্লাতে ইব্রাহীমীর আসল বুনিয়াদ ছিল কুরবানী। আর এই কুরবানীই ছিল হযরত ইব্রাহীম (আ:)-এর পয়গাম্বরী ও রূহানী জিন্দেগীর বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এই পরীক্ষা ও আজমায়েশ উত্তীর্ণ হওয়ার ফলে তিনি এবং তাঁর সন্তান-সন্তুতি সকল প্রকার নিয়ামত এবং বরকতসমূহের দ্বারা সৌভাগ্যমÐিত হয়ে উঠেছিল। তৌরাত কিতাবের আগমনকাÐে বলা হয়েছে যে, “আল্লাহ বলেন, এজন্যই তুমি এমন কাজ সম্পাদন করেছ এবং নিজের একমাত্র ছেলের কথাও ভুলে গিয়ে কুরবানী করতে কুণ্ঠাবোধ করনি। আমি নিজে এই শপথ করেছি যে, যখনই আমি বরকত দেব, তখনই তোমাকেও বরকত প্রদান করব এবং বংশধারাকে বিস্তৃত করে আকাশের তারকাপুঞ্জের মত কিংবা সমুদ্র উপকূলের বালির মত বর্ধিত করে দেব এবং বংশধরগণ শত্রæর দ্বার প্রাপ্ত পর্যন্ত অধিকার করবে। আর তোমার বংশের দ্বারা পৃথিবীর সমুদয় সম্প্রদায় বরকত হাসিল করবে। তা এজন্য যে, তুমি আমার কথা পালন করেছ।” (পয়দায়েশ : ২২-১৬-১৭-১৮)
কুর আনুল কারীমে ইরশাদ হচেছ : “এবং যখন হযরত ইব্রাহীম (আ:)-কে তাঁর প্রতিপালক কতিপয় বাক্য দ্বারা পরীক্ষা করলেন, আর তিনি তা পূর্ণ করলেন, তখন আল্লাহপাক তাঁকে লক্ষ্য করে বললেন, আমি তোমাকে মানুষের জন্য ইমাম নির্ধারণ করব।” (সূরা বাকারাহ : রুকু-১৫)
অপর এক আয়াতে ঘোষণা করা হয়েছে : “আমি ইব্রাহীম (আ:)-কে পৃথিবীতে মনোনীত করেছিলাম এবং পরকালেও সে পুণ্যবানদের অন্তর্ভুক্ত। যখন তাঁর প্রতিপালক বললেন, নিজেকে সমর্পণ কর, তখন সে বললো, আমি বিশ্ব প্রতিপালকের কাছে নিজেকে সমর্পণ করলাম। “(সূরা বাকরাহ : রুকু-১৬) অন্যত্র ঘোষণা করা হয়েছে : “হে ইব্রাহীম (আ:)! তুমি নিজের স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছ এবং অবশ্যই আমি পুণ্যবানদেরকে উত্তম বিনিময় প্রদান করি।” (সূরা সাফফাত : রুকু-৩)
আর এই বরকত ছিল এটাই যা মুসলমানগণ দৈনিক পাঁচবার আল্লাহর সামনে স্মরণ করে থাকেন। “হে আল্লাহ! মুহাম্মদ (সা:)-এর শারীরিক ও রূহানী বংশধরদের উপর বরকত নাজিল করুন, যেভাবে আপনি ইব্রাহীম (আ:) ও তাঁর বংশধরদের উপর বরকত নাজিল করেছিলেন।”
কিন্তুু এই কুরবানী আসলে কি ছিল? এটা শুধুমাত্র রক্ত এবং গোশতের কুরবানী ছিল না। বরং তা ছিল স্বীয় প্রিয়তম বস্তুকে আল্লাহর সামনে উৎসর্গ করা এবং রূহ ও অন্তর উৎসর্গ করা। এছিল আল্লাহর আনুগত্য, উবুদিয়াত এর পরিপূর্ণ দৃশ্য। এ ছিল উৎসর্গ ও সন্তুুষ্টির, ধৈর্য ও শোকরগুজারীর পরীক্ষা। যা পরিপূর্ণ করা ছাড়া দুনিয়ার নেতৃত্ব এবং আখেরাতের পুণ্যময় শুভ ফল লাভ করা যায় না। এ কুরবানী শুধু কেবল পিতার একমাত্র প্রিয় সন্তানের রক্তে পৃথিবীকে রঞ্জিত করা ছিল না; বরং আল্লাহর সামনে নিজের যাবতীয় কামনা-বাসনা, আশা-আকাঙ্খা, চিত্ত তাড়না ও উদগ্র চাহিদার কুরবানী এবং আল্লাহ নির্দেশের সামনে নিজের সকল প্রকার ইচ্ছা ও মর্জিকে বিলীন করে দেয়া। বস্তুুত : বাহ্যিক পশু কুরবানী সেই আভ্যন্তরীণ রূপরেখার জাগতিক ছায়া এবং সেই প্রকৃত সত্য সূর্যের যথার্থ রূপক প্রতিচ্ছবি মাত্র।
ইসলাম মানেই কুরবানী :
ইসলাম শব্দের অর্থ হচ্ছে নিজেকে কাহারো কাছে সমর্পণ করা এবং আনুগত্য ও বন্দেগীর জন্য মস্তক অবনত করা। আর এই বিশেষত্ব ও হাকীকতটি হযরত ইব্রাহীম (আ:) এবং ইসমাঈল (আ:)-এর ত্যাগ, উৎসর্গ ও কুরবানীর দ্বারা বিকশিত হয়েছে। আর এ কারণেই সেই পিতা-পুত্রের আনুগত্য ও আত্মোৎসর্গের অনুপ্ররণাকে সহীফায়ে মুহাম্মাদী আল কুরআনে ‘ইসলাম’ শব্দ দ্বারা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে : “যখন ইব্রাহীম এবং ইসমাঈল নিজেদেরকে সমর্পণ করলেন এবং ইব্রাহীম স্বীয় পুত্রকে উপুড় করে মাটিতে শুইয়ে দিলেন।” (সূরা সাফফাত : রুকু-৩)
অপর এক আয়াতে ঘোষণা করা হয়েছে : “একমাত্র নির্বোধ ছাড়া কেউ ইব্রাহীম (আ:)-এর মিল্লাতকে অপছন্দ করবে না। আমি তাঁকে পৃথিবীতে মকবুল ও গ্রহণীয় করেছিলাম এবং ইব্রাহীম আখেরাতেও পুণ্যবানদের অন্তর্ভুক্ত হবে। এবং যখন তাঁর প্রতিপালক বললেন, “আত্মসমর্পণ কর।” সে উত্তর করল, “বিশ্ব প্রতিপালকের সামনে আমি নিজেকে সমর্পণ করলাম।” (সূরা বাকারাহ : রুকু-২৬) মোটকথা, এই আনুগত্য ও আত্মসমর্পণই হচ্ছে মিল্লাতে ইব্রাহীমীর হাকীকত Ñইসলাম। তিনি নিজেকে আল্লাহর হাতে সঁপে দিয়েছিলেন এবং তাঁরই সকাশে স্বীয় মস্তক অবনত করেছিলেন। আর এটাই হচ্ছে ইসলামের হাকীকত। আর এটাই হচ্ছে ইব্রাহীমী মিল্লাত। আর এই আমানতের বোঝা বহন করার জন্যই হযরত ইব্রাহীম (আ:) বার বার প্রার্থনা করতেন, যেন তার বংশধরদের মাঝে প্রত্যেক যুগে এই দায়িত্ব পালনকারী সত্তার আবির্ভাব হয় এবং পরিশেষে সেই বিশ্বাসী সত্তারও আবির্ভাব হয়। যিনি এই আমানতকে গ্রহণ করে সারা বিশ্বের জন্য তা ওয়াকফ করে দেবেন। আল কুরআনে তাঁর এই প্রার্থনাকে এভাবে বিবৃত করা হয়েছে : “হে আল্লাহ! আমাদের উভয়কে তোমার অনুগত করে নাও এবং আমাদের বংশকে একটি মুসলমান জামাত কর, এবং আমাদেরকে হজ্জের বিধানসমূহ শিক্ষা দাও, এবং আমাদেরকে ক্ষমা করে দাও। অবশ্যই তুমি ক্ষমা ও অনুকম্পাশীল। হে আমাদের প্রতিপালক! এদের মাঝে এমন একজন রাসূল প্রেরণ কর যিনি তোমার আয়াতসমূহ পাঠ করে শোনাবেন, এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেবেন এবং তাদেরকে পাক পবিত্র করবেন। অবশ্যই তুমি বিজয়ী ও প্রজ্ঞাময়।” (সূরা বাকারাহ : রুকু-১৫)
এই প্রার্থনায় বর্ণিত রাসূল ছিলেন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা:)। এখানে পার্থিব কিতাব ছিল কুরআন, আর হেকমত ছিল রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর বক্ষস্থলে রক্ষিত জ্ঞান ও কর্ম প্রবাহের ভাÐার। আর মানাসেক ছিল হজ্জের আহকাম ও আরকান।
(চলবে)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।