পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
পুলিশের অপরাধপ্রবণতা নিয়ন্ত্রণ করা বা কমিয়ে আনা যাচ্ছে না। একের পর এক গুরুতর সব অভিযোগ উঠছে পুলিশের একশ্রেণীর সদস্যের বিরুদ্ধে। দায়িত্ব পালনকালে নানা ধরনের বেআইনী, দুর্নীতিমূলক কর্মকা- ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে গত বছর পুলিশ বাহিনীর প্রায় ১০ হাজার সদস্যকে বিভাগীয় শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়েছে। গত ৫ বছরে পুলিশ বাহিনীর কনস্টেবল, এএসআই, এসআই, ইন্সপেক্টর, এএসপি, এসপি এবং ঊর্ধ্বতন পর্যায় পর্যন্ত সাড়ে ৭৬ হাজারের বেশী সদস্যের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তি হয়েছে। তবে ২০১৪ সালে যেখানে ১৪ হাজার ৪০০ জন লঘুদ-, ৭৬২ জন গুরুদ-, ৭৩ জন চাকরিচ্যুত এবং সাতজন বাধ্যতামূলক অবসরে যাওয়ার মত বিভাগীয় শাস্তির সম্মুখীন হয়েছে সেখানে ২০১৫ সালে বিভাগীয় শাস্তিপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্যের সংখ্যা অনেকটাই কমে এসেছিল। এর মানে কি এই যে, পুলিশ বাহিনীতে অপরাধপ্রবণতা কমছে? প্রকাশিত তথ্য ও সামগ্রিক পরিস্থিতি বরং সম্পূর্ণ উল্টো। পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের অপরাধপ্রবণতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনকে দেশের নাগরিক সমাজ এবং দেশী-বিদেশী মানবাধিকার সংস্থাগুলো অন্যতম উদ্বেগজনক বিষয় হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় এ বছরের শুরু থেকেই পুলিশ বাহিনীর একশ্রেণীর সদস্যকে আরো বেশী বেপরোয়া, অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে। পুলিশের বিরুদ্ধে ছিনতাই, ডাকাতি, মাদক ব্যবসা, মানব পাচার, চাঁদাবাজি, অপহরণ ও টার্গেটেড কিলিংয়ের মত গুরুতর অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ ক্রমেই বাড়ছে। পুলিশের এই অপরাধপ্রবণতা পুরো সমাজকেই নিরাপত্তাহীন করে তুলছে।
নতুন বছরের প্রথম মাসের প্রথম ২০ দিনে শুধুমাত্র রাজধানী ঢাকা শহরেই পুলিশের হাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তা ও সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তাকে নির্যাতন এবং নারীর শ্লীলতাহানির মত চাঞ্চল্যকর অভিযোগ উঠেছে। মোহাম্মদপুর থানার এসআই মাসুদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা গোলাম রাব্বীকে নির্যাতনের ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতা পরিদর্শক বিকাশ চন্দ্র দাসকে মারধর করে হাসপাতালে পাঠিয়েছে যাত্রাবাড়ী থানার পুলিশ। গত বুধবার পল্টনে একজন বাসযাত্রী ব্যাংক কর্মকর্তা পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত খবরে জানা যায়। এ ছাড়া যাত্রাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অবণী শংকরসহ আরো ৫ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে জনৈক নারী শ্লীলতাহানির অভিযোগ এনে ঢাকার একটি আদালতে মামলা দায়ের করেছেন বলে জানা যায়। নারীর শ্লীলতাহানি, সাধারণ পথচারীদেরকে মাদক ও মিথ্যা মামলার ভয় দেখিয়ে সর্বস্ব লুটে নেয়ার অভিযোগও আছে পুলিশের বিরুদ্ধে। সাধারণ মানুষকে ডাকাত, ছিনতাইকারী, সন্ত্রাসীদের হাত থেকে রক্ষার পাশাপাশি সামাজিক-রাজনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই রাষ্ট্র পুলিশ বাহিনীর উপর দায়িত্ব দিয়েছে। সেখানে পুলিশ বাহিনীর একশ্রেণীর সদস্য নিজেরাই ডাকাত, কিলার, ছিনতাইকারী, অপহরণকারী, চাঁদাবাজ, মানব ও মাদক পাচারের মত গুরুতর অপরাধে লিপ্ত হয়ে পড়ছে। গত বছরের ২১-শে জুন পুলিশের স্পেশাল বিভাগের একজন এএসআই ফেনিতে ৬ লাখ ৮০ হাজার ইয়াবা ট্যাবলেটসহ র্যাবের হাতে আটক হওয়ার সংবাদ ছাপা হয়েছিল।
নারায়ণগঞ্জে ৭ খুনের ঘটনায় র্যাব কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততা, লিমনের পায়ে গুলি করে তাকে পঙ্গু করে দেয়া, অসংখ্য মানুষের নিখোঁজ হওয়া, বন্দুকযুদ্ধের নামে বিনাবিচারে মানুষ হত্যার মত মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আছে পুলিশের বিরুদ্ধে। কিছুসংখ্যক অপরাধী র্যাব-পুলিশ সদস্যের বেপরোয়া কর্মকা-ের দায় ও বদনাম বহন করতে হচ্ছে পুরো বাহিনীকে। এর ফলে একদিকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, মানবাধিকার লঙ্ঘনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাব-মর্যাদা বিনষ্ট হচ্ছে। বৈদেশিক সম্পর্ক এবং বৈদেশিক বাণিজ্যেও এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। ইতিপূর্বে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের কেউ কেউ পুলিশের কারণে মামলা নিষ্পত্তি বিলম্বিত এবং অপরাধীরা পার পেয়ে যাওয়ার অভিযোগ তুলেছেন। বিদেশী হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার পাশাপাশি মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের তরফ থেকেও বাংলাদেশ পুলিশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলতে দেখা গেছে। সর্বশেষ গত বুধবার ঢাকায় নিযুক্ত নতুন ব্রিটিশ হাইকমিশনার এলিসন ব্লেইক তার প্রথম সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অব্যাহত মানবাধিকার লঙ্ঘনে তার দেশের উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। একই সাথে তিনি বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবনতির প্রেক্ষাপটে তার দেশের উদ্বেগের কথাও পুনর্ব্যক্ত করেছেন ব্রিটিশ হাইকমিশনার। দেশের মানুষ, আদালতের বিচারক, আন্তর্জাতিক সংস্থা, বিদেশী কূটনীতিক মহল কেউই পুলিশ বাহিনীকে আস্থায় নিতে পারছে না। পুলিশের আভ্যন্তরীণ অপরাধ দমন, আইন-শৃঙ্খলা ও জননিরাপত্তার উন্নয়নের মধ্য দিয়েই পুলিশ বাহিনীকে সকলের আস্থা অর্জন করতে হবে। রাজনৈতিক কারণে পুলিশকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অপরাধ থেকে দায়মুক্তি দেয়া হলে, অথবা সরকার তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনে পুলিশ নির্ভর হয়ে পড়লে অবশেষে তা’ সরকারের জন্য বিব্রতকর বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তারই প্রতিফলন দেখা গেছে। পুলিশের একশ্রেণীর সদস্যের বেপরোয়া দুর্বৃত্তপনার দায় কেন পুরো বাহিনী এবং সরকারকে বহন করতে হবে? পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ও সরকারের সর্বোচ্চ মহলকে এ বিষয়ে অবশ্যই প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে জনবান্ধব বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পুলিশের পেশাদারিত্ব এবং সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছাই যথেষ্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।