Inqilab Logo

বুধবার, ২৬ জুন ২০২৪, ১২ আষাঢ় ১৪৩১, ১৯ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

বন্যার গ্রাস ও ভাঙন বৃদ্ধি

| প্রকাশের সময় : ১৪ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

৪৮ ঘণ্টায় পরিস্থিতির মোড় স্পষ্ট হতে পারে : দশ নদ-নদীর ১৪ পয়েন্টে বিপদসীমা অতিক্রম : ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও গঙ্গা-পদ্মায় পানি বেড়েছে : ভাটিতে মেঘনা অবধি প্রচÐ ঘূর্ণিস্রোত : বিস্তীর্ণ জনপদ প্লাবিত, ফেরি ও নৌ চলাচল ব্যাহত : ত্রাণের আশায় বন্যার্তদের হাহাকার : খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির চরম সঙ্কট
ইনকিলাব ডেস্ক : দেশের ১০টি নদ-নদীর পানি ১৪টি পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে বইছে। পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে নদীভাঙন দেখা দিয়েছে। যশোরের কপোতাক্ষ নদের পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বগুড়ায় চরাঞ্চলে তীব্র নদী ভাঙনে ২ দিনে ৪৮০ পরিবার গৃহহীন হয়েছে। কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে, দুর্ভোগ বেড়েছে পানিবন্দী ২ লক্ষাধিক বানভাসী মানুষের, বাঁধ ভেঙে আরো ৫০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। সুন্দরগঞ্জে আশ্রায়ন প্রকল্পে হাঁটু পানি। ইসলামপুরে বানে ভাসছে লাখো মানুষ, ত্রাণের জন্য আহাজারি বাড়ছে। শিক্ষার্থীরা স্কুল, কলেজ, মাদরাসায় যেতে না পেরে হতাশ হয়ে পড়েছে। গঙ্গাচড়ায় ১৭৩ পরিবারের ঘর-বাড়ি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বন্যা কবলিত এলাকায় খাদ্য-পানির অভাবে বানভাসী মানুষের আহাজারিতে বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। দেশের বানভাসী মানুষের দুর্ভোগ নিয়ে আমাদের সংবাদদাতাদের পাঠানো তথ্যের আলোকে ডেস্ক রিপোর্ট-
চট্টগ্রাম থেকে শফিউল আলম জানান, ফুঁসে উঠেছে আরও নদ-নদী। বন্যার গ্রাস অব্যাহত রয়েছে। নতুন নতুন এলাকায় বিস্তৃত হচ্ছে বন্যা। নদীভাঙন ভয়ানক রূপ নিয়েছে। বন্যা কবলিত ১৬টি জেলায় খাদ্য, বিশুদ্ধ খাবার পানি, ওষুধসহ জরুরী ত্রাণ সাহায্যের আশায় লাখো বন্যার্ত মানুষের করুণ হাহাকার অবর্ণনীয়। এ মুহূর্তে খাদ্য ও পানির সঙ্কট চরমে। গত একসপ্তাহে ত্রাণসামগ্রী গেছে নামেমাত্র। তাও ‘ফটোসেশনের রিলিফ’। মাথাগোঁজার ঠাঁই হারিয়ে বানভাসি হাজার হাজার পরিবার বাঁধের উপর কিংবা উঁচু জায়গায় খোলা আকাশের নীচে এমনকি নৌকায় দুঃসহ রাত-দিন গুজরান করছে। বন্যাজনিত রোগ-ব্যাধি বেড়ে যাচ্ছে অনেক এলাকায়। গতকাল নদ-নদীর পানির প্রবাহ আরও বিভিন্ন পয়েন্টে বৃদ্ধি পায়। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও গঙ্গা-পদ্মায় পানিবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। সুরমায়-কুশিয়ারায়ও পানি ফের বেড়েছে। সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চল, দক্ষিণ-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্ব জনপদের ১০টি নদ-নদী ১৪ পয়েন্টে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এরমধ্যে পানিবৃদ্ধিতে নতুন করে বিপদসীমা অতিক্রম করলো সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ি পয়েন্টে আত্রাই-করতোয়া এবং যশোরের ঝিকরগাছায় কপোতাক্ষ নদ। তাছাড়া আরিচা, গোয়ালন্দ, ভাগ্যকুল, শরিয়তপুর, মাওয়া, সুরেশ্বর, ভৈরববাজার, সুনামগঞ্জ, সিলেট, শেরপুর-সিলেটসহ বিভিন্ন জায়গায় নদ-নদী সতর্কতার পর্যায়ে রয়েছে। এর মূল কারণ উজানের পানি হু হু করে ভাটিতে নামছে। ফলে যমুনা পদ্মা মেঘনার মোহনা অবধি সৃষ্টি হয়েছে প্রচÐ ঘূর্ণিস্রোত ও নদীভাঙন। এতে করে আরো শহর-গ্রাম-জনপদ প্লাবিত হচ্ছে। ফেরি ও নৌ চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। ঝুঁকি বৃদ্ধি পাওয়ায় নৌপথের অগণিত যাত্রী সাধারণের মাঝে বেড়েছে উদ্বেগ আর দুর্ভোগ। নৌযান চলাচলে গতকাল থেকে বাড়তি সতর্কতা বজায় রাখতে হচ্ছে।
এদিকে দেশের সামগ্রিক বন্যার অবনতিশীল অবস্থার সূচক বা চিত্র ফুটে উঠে গতকাল সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত এবং পূর্বাভাসের মধ্যদিয়েই। বন্যা ও পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ সূত্রগুলো জানায়, বন্যা পরিস্থিতি সম্ভাব্য কোন দিকে মোড় নিতে পারে তা অনেকটা স্পষ্ট হয়ে উঠবে আগামী সপ্তাহের গোড়াতে। অর্থাৎ আগামীকাল শনিবার অথবা রোববার-সোমবার নাগাদ। আরও অন্তত দুই দিন বা ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বন্যা পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি আশা করা যাচ্ছে না। চলমান গতি-প্রকৃতি বজায় থাকলে বরং কোথাও কোথাও অবনতি ঘটতে পারে। কেননা অন্যতম প্রধান অববাহিকা ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদ এবং সিলেটে সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহের হার (রেট) বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এর পাশাপাশি গঙ্গা-পদ্মা অববাহিকায় পানি বৃদ্ধির দিকেই রয়েছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে। এর কারণ হলো চীন তিব্বত হিমালয়-পাদদেশসহ ভারতের উজানভাগ থেকে পানি ভাটিতে থাকা বাংলাদেশের দিকে আসা অব্যাহত রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় উজানের (বিশেষত উত্তর-পূর্ব ভারতে) ওইসব অঞ্চলে কোথাও কোথাও মাঝারি থেকে ভারী বর্ষণ হয়েছে। ঢল-বানের আকারে উজানের সেই পানি নামছে। বন্যায় প্লাবিত হচ্ছে আরও বিস্তৃত এলাকা। তাছাড়া বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলো বেশিরভাগ ভাঙাচোরা ও অপর্যাপ্ত থাকায় অনেক এলাকায় নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে ‘বন্যার আগেই বন্যার কবলে’ পড়ছে নদীপাড়ের অগণিত অসহায় মানুষ।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, যমুনা-ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা-পদ্মা এবং সুরমা নদ-নদীসমূহের পানির সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে কুশিয়ারা নদীর পানি কখনো হ্রাস কখনো অপরিবর্তিত অবস্থায় আছে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদ-নদীসমূহের পানির সমতল আগামী ২৪ ঘণ্টায়ও সামান্য বৃদ্ধি পেতে পারে। এর পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টায় স্থিতিশীল বা অপরিবর্তিত হয়ে আসতে পারে। গঙ্গা-পদ্মা নদ-নদীসমূহের পানির সমতল বৃদ্ধি আগামী ৪৮ ঘণ্টায়ও অব্যাহত থাকতে পারে। সুরমা-কুশিয়ারা নদ-নদীসমূহের পানির স্তর আগামী ২৪ ঘণ্টায় স্থিতিশীল বা অপরিবর্তিত থাকতে পারে। দেশের ৯০টি নদ-নদীর সমতল পর্যবেক্ষণ পয়েন্টের মধ্যে গতকাল সর্বশেষ তথ্যানুসারে পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল ১৪টি স্থানে। পানি বৃদ্ধি পেয়েছে ৫৭টিতে। অপরিবর্তিত আছে ২টি ও হ্রাস পায় ২৭টি পয়েন্টে। ১৪টিতে নতুন যুক্ত নদ যশোরের ঝিকরগাছায় কপোতাক্ষ বিপদসীমার ৫ সেমি উপর এবং বাঘাবাড়িতে আত্রাই নদী ১৪ সেমি উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
এদিকে অন্যতম প্রধান নদ ব্রহ্মপুত্রের পানিবৃদ্ধি গতকাল বিকেল পর্যন্ত পূর্ববর্তী ৩০ ঘণ্টায় প্রায় অপরিবর্তিত থাকার পরিপ্রেক্ষিতে নুনখাওয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ৪১ সেমি নীচে বজায় রয়েছে। আর চিলমারী পয়েন্টে বিপদসীমার ৩৭ সেমি উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। যা ২০০৭ সাল ও ১৯৯৮ সালের বন্যার তুলনায় ৪০ থেকে ৪২ সেমি নীচের দিকে রয়েছে। তবে যমুনা নদ গতকালও অব্যাহতভাবে ফুলে-ফুঁসে উঠে। যমুনা বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে বিপদসীমার ৮৪ সেমি, সারিয়াকান্দিতে ৫৮ সেমি, কাজীপুরে ৬৬ সেমি, সিরাজগঞ্জে ৭৩ সেমি উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। যমুনা প্রথম দুটি স্থানে বিগত ২০০৭ ও ১৯৯৮ সালের বন্যার পানির স্তরকে আরো অতিক্রম করেছে। যমুনা নদের পানি আরিচায় আরো বেড়ে গিয়ে বিপদসীমার ৩৩ সেমি নীচে রয়েছে। গতকাল সর্বশেষ বিকলে পর্যন্ত বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহ আরো বেড়েছে আত্রাই, ধলেশ্বরী, সুরমা, কুশিয়ারা নদীর পানি। শেরপুর-সিলেট পয়েন্টে কুশিয়ারা নদীর পানি গত কয়েকদিন বিপদসীমার কিছুটা নীচে থাকলেও গতকাল বিকেল পর্যন্ত আবারও বেড়ে গিয়ে বিপদসীমার ১ সেমি উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল। বর্তমানে কুশিয়ারা ৩টি পয়েন্টে বিপদসীমার উপর এবং সুরমা একটিতে উপরে রয়েছে। নেত্রকোনায় কংস নদীর পানি সানান্য কমলেও বিপদসীমার উপরে। অন্যদিকে উত্তর জনপদের অন্যান্য নদ-নদীর মধ্যে কুড়িগ্রামে ধরলা ও গাইবান্ধায় ঘাগট বিপদসীমার উপরে প্রবাহিত হচ্ছে। মধ্যাঞ্চলে ব্রাহ্মনবাড়িয়ায় তিতাস নদীর পানি নীচে থাকলেও বাড়ছে।
ভারতের আবহাওয়া বিভাগ ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাসে জানায়, দেশটির গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা, মিজোরামের বিভিন্ন স্থানভেদে ভারী বৃষ্টিপাত হতে পারে। তবে পরবর্তী ৩ দিনে হালকা বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। এদিকে দেশে আগামী ৭২ ঘণ্টা বা তিন দিনে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা কম থাকার পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান এবং নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ সাজ্জাদ হোসেন গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, অরুণাচল, আসামসহ উত্তর-পূর্ব ভারতে আগের চেয়ে অতিবর্ষণের মাত্রা এখন কমে এসেছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় যমুনা-ব্রহ্মপুত্রে পানি আগের তুলনায় কম বাড়তে পারে। এরপর উজান থেকে পানি নামা স্থিতিশীল হলে পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টায় পানি স্থিতিশীল থাকতে পারে। তবে পদ্মা-গঙ্গায় আরো দু’দিন পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে।
বগুড়া থেকে মহসিন রাজু জানান, বগুড়ায় যমুনা নদীর পানি গতকাল দুপুর পর্যন্ত না বাড়লেও বিপদসীমার ৫৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে চর এলাকায় তীব্র নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে। গত দু’দিনে নদী ভাঙনে বন্যাকবলিত সারিয়াকান্দির চরবেষ্টিত ৩টি ইউনিয়নের ৪৮০ টি পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছে। এসব পরিবারের অনেকেরই বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। অপর দিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে গত ১২ ঘন্টায় যমুনার পানি স্থিতা বস্থায় রয়েছে।
বগুড়ার যমুনাতীবর্তী ৩ উপজেলা সারিয়াকান্দি সোনাতলা ও ধুনটের শতাধিক গ্রামের প্রায় ৭২ হাজার মানুষ বন্যায় ক্ষত্গ্রিস্থ হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত্র হয়েছে সারিয়াকান্দি উপজেলা। এখানে বন্যাকবলিত হয়েছে ৫৮টি গ্রামের ১১ হাজার ৭শ’২০টি পরিবার। বন্যার্তদের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে বাড়ছে বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধের আশ্রয় নেয়া লোকজনের সংখ্যা। এদিকে আকষ্মিক ভাবে সারিয়াকান্দির চরবেষ্টিত ইউনিয়নের ৩টিতে তীব্র নদী ভাঙন দেখা দেয়ায় লোকজন দিশেহারা হয়ে পড়েছে। হাটশেরপুর, চালুয়াবাড়ি ও বোহাইল ইউনিয়েনের কয়েকটি গ্রাম তীব্র নদী ভাঙনে পড়ে। এর মধ্যে হাটশেরপুর ইউনিয়নের চকরতিনাথ ও করমজাপাড়া ও দীঘাপাড় চরের দুইশতাধিক পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছে। ভাঙনে বিলীন হয়েছে বাড়িঘর। অনেকে ঘরবাড়ি ও মালামাল রক্ষা করতে পারেনি। ভাঙনের ভয়াবহতায় লোকজন বিহবল হয়ে পড়ে। হাট শেরপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মতিউর রহমান জানান, ১৭ ঘন্টার মধ্যে ১৪৩টি পরিবার গৃহহীন হয়েছে। এর মধ্যে বেশকিছু পরিবার বাড়িঘর থেকে মালামাল সরাতে পারেনি। বেশির ভাগ লোকজন বাড়ি ঘর ভেঙ্গে অন্যত্র চলে যাচ্ছে। আশ্রয় নিচ্ছে বাঁধ বা স্বজনের বাসায়। এছাড়া, বেড়াপাঁচবাড়িয়া, উত্তর টেংরাকুড়া, পাকুড়িযা ও চরঘাঁগুয়া এলাকায় নদী ভাঙনের কারণে শতাধিক পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভাঙনের কবলে পড়া লোকজন তাদের ঘর-বাড়ী ও মালামাল অন্যত্রে সরিয়ে নিচ্ছে। আবার নৌকা ও লোকজনের অভাবে অনেকে তাদের ঘরবাড়ী থেকে মালামাল ও সরাতে পারছেনা। ঝুঁকি নিয়ে বন্যা ও ভাঙন কবলিত চরেই থাকছেন। বন্যা ও ভাঙন কবলিত চরাঞ্চলের বানভাসী মানুষের চরম দুর্ভোগে দিনাতিপাত করছে।
যশোর থেকে মিজানুর রহমান তোতা জানান, যশোরের কপোতাক্ষ নদের পানি বিপদসীমার উপরে। গত দু’দিনে পানি বেড়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জানান, কপোতাক্ষ নদের ঝিকরগাছা পয়েন্টের তথ্য হচ্ছে, বর্তমানে পানি প্রবাহিত হচ্ছে বিপদসীমার উপরে। ঝিকরগাছা পয়েন্টে গতকাল রেকর্ড হয় ৪ দশমিক ১৬ সেন্টিমিটার। বিপদসীমা হচ্ছে ৪ দশমিক ১১ সেন্টিমিটার। যশোরের ভদ্রা নদীতেও পানি বেড়েছে। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম জানান, এখনো প্লাবিত হয়নি। তবে আশঙ্কা প্রবল। আমরাও সতর্ক দৃষ্টি রাখছি। প্রতিবছরই বর্ষা মৌসুমে কপোতাক্ষ নদের পানি উপচে লোকালয়ে প্রবেশ করে ভয়াবহ অবস্থা হয়। এদিকে, ভবদহে এবারও বিরাট এলাকার মানুষ পানিবন্দি হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে।
কুড়িগ্রাম থেকে শফিকুল ইসলাম বেবু জানান, কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। প্লাবিত হয়ে পড়েছে নতুন নতুন এলাকা। এসব এলাকার পানিবন্দী প্রায় ২ লক্ষাধিক মানুষ মানবেতর জীবন যাপন করছে। স্বাস্থ্য বিভাগের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করে জেলায় ৮৭টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে।
চিলমারী পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ৩৭ সেন্টিমিটার ও সেতু পয়েন্টে ধরলার পানি বিপদসীমার ১৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
অন্যদিকে ব্রহ্মপুত্র নদের প্রবল ¯্রােতে চিলমারী উপজেলার কাঁচকোলে ডানতীর রক্ষা প্রকল্পের ৫০ মিটার বাঁধ ও রৌমারী উপজেলার যাদুর চরে কত্তিমারী বাজার রক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে নতুন করে ৫০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
জেলার ৯ উপজেলার মধ্যে ৭ উপজেলার ৪২ ইউনিয়নের ৫শ গ্রামের ২ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী জীবন যাপন করছে।
অনেক পরিবার বাড়ি-ঘর ছেড়ে উচুঁ জায়গায় আশ্রয় নিলেও এসব এলাকায় খাদ্য ও বিশুদ্ধ খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। ১শ ৫০ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি উঠায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
জেলায় ১ হাজার হেক্টর জমির আউশ, পাট, সবজিসহ বিভিন্ন ফসল বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে।
সরকারীভাবে স্বল্প পরিসরে ত্রান তৎপরতা শুরু হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। কিন্তু এখন পর্যন্ত বেসরকারী কোন ত্রান তৎপরতা চোখে পড়েনি।
কুড়িগ্রামের সিভিল সার্জন ডাঃ এসএম আমিনুল ইসলাম জানান, চরাঞ্চলে ৯টি কমিউনিটি ক্লিনিক তলিয়ে যাওয়ায় পাশ্ববর্তী উচুঁ জায়গায় কার্যক্রম চালু রাখা হয়েছে। জেলার বন্যা কবলিত এলাকা গুলোতে ৮৭টি মেডিকেল টিম কাজ করছে। স্বাস্থ্য বিভাগের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে।
কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক আবু ছালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস খান জানান, জেলার ৯ উপজেলার মধ্যে বন্যা কবলিত ৭ উপজেলায় বন্যার্ত মানুষের মাঝে এপর্যন্ত ৩শ মেট্রিক টন চাল, ৮ লাখ টাকা ও ২ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরন করা হয়েছে। আরো নতুন করে ১শ মেট্রিক টন চাল, ২ হাজার শুকনো খাবারের প্যাকেট ও ৩ লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে যা বিতরনের কার্যক্রম চলছে।
গঙ্গাচড়া (রংপুর) থেকে মোহাঃ ইনামুল হক মাজেদী জানান, রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলায় তিস্তা নদীর পানি কিছুটা কমলেও বন্যা কবলিত এলাকার বানভাসী মানুষের আহাজারি কমেনি। গত ৩ দিনে উপজেলার নোহালী, আলমবিদিতর ও ল²ীটারী ইউনিয়নের ১’শ পরিবারের ঘর বাড়ি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত বন্যা দুর্গত এলাকায় সরকারি ভাবে ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছেনি। গত কয়েক দিনের মৌসুমী বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে তিস্তায় বন্যা দেখা দেয়।
গত মঙ্গলবার উপজেলার নোহালী ইউনিয়নের চর নোহালী, বাগডহরা গ্রামের বানভাসী মানুষের আহাজারি। চর নোহালী গ্রামে অব্যাহত নদী ভাঙনে ১’শ পরিবারের ঘর বাড়ি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় ২ হাজার পরিবার। গত মঙ্গলবার নোহালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ টিটুল নদী ভাঙন এলাকা পরিদর্শন ও বানভাসী মানুষের মাঝে ব্যক্তিগত তহবিল হতে নগদ টাকা, শুকনো খাবার, স্যালাইন ও পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করেন। এসময় বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ, গঙ্গাচড়া শাখার আহবায়ক কমিটির সদস্য বুলবুল আহম্মেদ, নোহালী ইউনিয়ন আওয়ামীলীগ সভাপতি আজিজুল ইসলাম জমিদার, ইউ.পি সদস্য নুরুজ্জামান, আজিজুল ইসলাম, শহিদুল ইসলাম সংরক্ষিত মহিলা সদস্য মিনা বেগম, নোহালী ইউনিয়ন স্বাস্থ্য সহকারি নুর আলম, মনিরা সরকার, রিপোর্টাস ক্লাবের সভাপতি আব্দুল আলীম প্রামানিক, সাংবাদিক নির্মল রায়সহ গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। এদিকে বন্যায় উপজেলার আলমবিদির ইউনিয়নে ৫০ পরিবার ও ল²িটারী ইউনিয়নের ৪৩ পরিবারের ঘর বাড়ি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা বাবুল চন্দ্র বলেন, এখন পর্যন্ত ৩ ইউনিয়নের ১৩৩ পরিবারের ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে বলে তালিকা পেয়েছি। উপজেলা নির্বাহী অফিসার আমিনুল ইসলাম বলেন, সরকারি ভাবে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের জন্য ২০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ পাওয়া গেছে দ্রæত তা বিতরণ করা হবে। সচেতন মহল জানান, সরকারি বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
সুন্দরগঞ্জ (গাইবান্ধা) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, গত কয়েকদিন ধরে অবিরাম বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে তারাপুর, বেলকা, হরিপুর, কঞ্চিবাড়ি, চন্ডিপুর, কাপাসিয়া ও শ্রীপুর ইউনিয়ন গুলোতে বন্যার পানি অপরিবর্তীত থাকায় বানবাসি মানুষরা চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। এতে করে বসতবাড়ি রাস্তাঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এমনকি আশ্রান প্রকল্পতেও বন্যার পানি ঢুকেছে। দেখা দিয়েছে বানভাসি মানুষদের চরম দুর্ভোগ। পানিবন্দি ৩০ হাজার মানুষের মাঝে এখন পর্যন্ত পর্যাপ্ত ত্রাণ সামগ্রী পৌছেনি। গত বুধবার উপজেলা প্রশাসন ৫’শ বানভাসি পরিবারের মাঝে ২০ মেট্রিক টন চাল, শুকনো খাবার ও ওষুধপত্র বিতরণ করলেও তা প্রয়োজনের তুলনা অপ্রতুল। হরিপুর ইউপি চেয়ারম্যান নাফিউল ইসলাম জিমি জানান, সরকার যেভাবে বানভাসি মানুষের মাঝে ত্রাণ দিচ্ছে তার চাহিদার তুলনায় একেবারে অপ্রতুল। উপজেলায় বন্যার সাথে তাল মিলিয়ে নদী ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। তার গোটা ইউনিয়ন এখন বন্যায় নিমজ্জিত। বন্যা দুর্গত মানুষদের আশ্রায় দেয়ার মতো কোন উচু স্থান না থাকায় তারা চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। এখন পর্যন্ত যে পরিমান ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।
ইসলামপুর (জামালপুর) থেকে ফিরোজ খান লোহানী জানান, ইসলামপুরে বানে ভাসছে লাখো মানুষ। বানভাসী মানুষরা চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। প্রয়োজনের তুলনায় ত্রান অপ্রতল বলে জানা গেছে। যমুনার পানি বিপদ সীমার ৮৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পাথর্শী ইউনিয়নের বেড়েগাও এলাকায় নাজিম উদ্দিনের ছেলে আরিফ (২) পানিতে গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে সকলের অজান্তে পানিতে পড়ে নিহত হয়েছে।
এদিকে উপজেলার ৮টি ইউনিয়নের বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণসহ পৌর শহরে খাদ্য গুদাম, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, উপজেলা সংলগ্ন জনতা মাঠে পানি ঢুকে পড়েছে। ইসলামপুরের যমুনা তীরবর্তী চরাঞ্চলের অসংখ্য ঘরবাড়ি বন্যার পানিতে ভেসে যাবার উপক্রম হয়েছে।
সরেজমিন পরিদর্শনে জানাগেছে, ইসলামপুর থেকে ৪ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে পাথর্শী ইউনিয়নের বানিয়া বাড়ি গ্রাম এবং দক্ষিণ পশ্চিমের ৪ কিলোমিটার দুরে আমতলী বাজার। ওই দুটো জায়গা থেকে নৌকা ছাড়া কোথায় যাবার জো নেই। চারিদিকে শুধু পানি আর পানি। অগত্যা বৃহস্পতিবার দুপুরে স্যালো ইঞ্জিন চালিত নৌকা যোগে ইসলামপুরের চিনাডুলি ইউনিয়নের বলিয়াদহ গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, বলিয়াদহ গ্রাম আর নদী একাকার হয়ে গেছে। বলিয়াদহ নদীর দুই পাড়ের দুইটি গ্রাম যেন পানিতে ভাসছে।
চিনাডুলি ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুস ছালাম জানান, তার ইউনিয়নের সবকটি গ্রামের প্রায় ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়েছে। এবারের বন্যায় অর্ধ শতাধিক পরিবারের বাড়িঘর নদী ভাঙনের শিকার হয়েছে। তন্মধ্যে চরনন্দনের পাড়া ও কুকুরমারি গ্রামের ৫০টি পরিবারের বসতভিটা বন্যার পানিতে ভেসে গেছে।
বৃহস্পতিবার দুপুরে যমুনার তীরে উলিয়া পাইলিং ঘাটের পাশে যেতে দেখা গেছে চিনাডুলি ইউনিয়নের বলিয়াদহ, পশ্চিম বামনা, শিংভাঙা, দক্ষিণ চিনাডুলি ও বৌশেরগড় এলাকার সকল বাড়িঘরে পানি আর পানি। এসব গ্রামের হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছে।
ইসলামপুর উপজেলা চেয়ারম্যান নবী নেওয়াজ খান লোহানী বিপুল জানান, ইসলামপুরের ৭টি ইউনিয়নের প্রায় লাখো মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্যা কবলিত মানুষের ঘরে ঘরে রান্না করা খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও গো-খাদ্যের তীব্র সংকট চলছে। বন্যার্তদের জন্য যে পরিমান ত্রাণ সামগ্রী দেওয়া হয়েছে তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবিএম এহছানুল মামুন জানান, সরকারী হিসাবে এ পর্যন্ত ইসলামপুরের ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়েছেন। উপজেলায় ৩টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মেহেদী হাসান জানান, এ যাবত ৬০ মে.টন চাল, ১৩শ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। অন্যদিকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানান, জেলা প্রশাসক আহমেদ কবির বন্যা দূর্গত এলাকা পরিদর্শন শেষে চিনাডুলী ইউনিয়নের বামনা গ্রামে ২শ’ পরিবারের মাঝে শুকনো খাবার বিতরণ করেছেন। খাদ্যমন্ত্রীর আজ ইসলামপুর বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন ও ত্রাণ বিতরণের কথা রয়েছে।



 

Show all comments
  • রাকিব ১৪ জুলাই, ২০১৭, ১২:৫৩ পিএম says : 0
    দ্রুত দুর্গত মানুষদের কাছে ত্রান পৌঁছে দেয়া হোক।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বন্যা

১৫ অক্টোবর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ