Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সুকঠিন বাধা মোকাবেলা করে যেভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

| প্রকাশের সময় : ৬ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ আবদুল গফুর : গত শনিবার ১ জুলাই চলে গেল দেশের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৬তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। যদিও এ উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল, কোন কোন গণমাধ্যমে এ বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। অথচ আমাদের জাতির ইতিহাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদানকে খাটো করে দেখার কোন অবকাশ নেই। আজ আমরা বাংলাদেশে নামের যে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের গর্বিত নাগরিক, সে রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পেছনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদানকে অস্বীকার করা আর ইতিহাসকে অস্বীকার করা একই কথা।
এ অবদান এতটাই বহুমাত্রিক ও গুরুত্বপূর্ণ যে জাতির অগ্রগতির ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদানের কথা বাদ দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস রচনা একেবারেই অসম্ভব। বৃটিশ-বিরোধী যে স্বাধীনতা সংগ্রামের ফলশ্রæতিতে ১৯৪৭ সালে আমরা বৃটিশ সা¤্রাজ্যবাদের পরাধীনতার শৃংখল ছিন্ন করে পাকিস্তান অর্জন করি সে আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্র সমাজের যেমন ঐতিহাসিক অবদান ছিল, তেমনি পরবর্তীকালে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল ভিত্তি ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের মর্মবাণী বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সূচিত ভাষা আন্দোলন ও স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের সৃষ্ট স্বাধিকার চেতনা সৃষ্টিতেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান ছিল ঐতিহাসিক। তবে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জাতির অগ্রগতিতে এমন অতুলনীয় অবদান রেখেছে, তার প্রতিষ্ঠা যে মোটেই সহজ ছিল না, সে কথা অনেকেরই জানা নেই। জানার কথাও নয়। কারণ সেদিন আর এদিনের অবস্থা অনেক ফারাক। আর সে ফারাকের কথা বুঝতে হলে আমাদের যেতে হবে আমাদের ইতিহাসের গভীরে।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ১৭৫৭ সালে কতিপয় কুলাঙ্গারের বিশ্বাস ঘাতকতার কারণে পলাশীতে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় বরনের মধ্য দিয়ে এদেশে সা¤্রাজ্যবাদী বৃটিশ শাসন শুরু হলে প্রথম দিকে বহু দিন পর্যন্ত নব্য শাসকদের একটা নীতিই হয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রশাসন, প্রতিরক্ষা, জমিদারী-আয়মাদারী, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-সংস্কৃতি প্রভৃতি প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হতে বেছে বেছে মুসলমানদের উৎখাত করে সে সব স্থানে ইংরেজ-অনুগত হিন্দুদের বসানো। পলাশী বিপর্যয়ের মাত্র কয়েক দশকের মধ্যে ১৭৯৩ সালে পূর্বতন ভূমি-নীতি বদলিয়ে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নামের নতুন ভূমি-নীতির মাধ্যমে সরকার যে ইংরেজ-অনুগত নব্য জমিদার গোষ্ঠী গড়ে তোলে তার সিংহ-ভাগই ছিল হিন্দু।
মুসলমানরাও কিছুতেই সাত সমুদ্র তের নদীর ওপাড় হতে আসা বিদেশী ইংরেজদের শাসন মেনে নিতে পারছিল না। তারা পলাশী বিপর্যয়ের পর একশত বছর পর্যন্ত ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকে স্বাধীনতা ফিরে পাবার লক্ষ্যে। এসব সংগ্রামের মধ্যে ছিল মজনু শাহের নেতৃত্বাধীন ফকির আন্দোলন, তিতুমীরের বাঁশের কেলা খ্যাত যুদ্ধ, হাজী শরীয়তুল্লাহ -দুদু মিয়ার ফরায়েজী আন্দোলন, মহীশূরের হায়দার আলী-টিপু সুলতানের লড়াই, সৈয়দ আহমদ ব্রেলভীর জিহাদ আন্দোলন প্রভৃতি। কিন্তুু বৃহৎ প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের বিরোধিতা ও ইংরেজ পক্ষ অবলম্বনের কারণে এরসব সংগ্রামই ব্যর্থ হয়। সর্বশেষ ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবেও মুসলমানদের পরাজয় বরনের ফলে ইংরেজ ভক্ত হিন্দু বুদ্ধিজীবিরা উল্লাসে ফেটে পড়েন এবং গদ্যে-পদ্যে গদগদ ভাষায় আনন্দ প্রকাশ করে বৃটিশ সরকারের প্রতি তাদের আনুগত্য নিবেদন করেন। সাহিত্য স¤্রাট বঙ্কিমচন্দ্র ‘সংবাদ ভাস্কর’ লিখলেন, হিন্দু সকল দেবালয়ে পূজা দেও, পাঠক সকল জয় জয় বলিয়া নৃত্য কর, আমাদের রাজ্যেশ্বর শত্রæজয়ী হইলেন। আর কবি ঈশ্বরগুপ্ত লিখলেন
চিরকাল হয় যেন বৃটিশের জয়
বৃটিশের রাজলক্ষী স্থির যেন রয়।
এমন সুখের রাজ্য আর নাহি হয়
শাস্ত্রমতে এই রাজ্য রামরাজ্য কয় \
বৃটিশ সরকার সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের আনুগত্য লাভ করে পরাজিত মুসলমানদের দমনে কঠিন হতে কঠিনতর কার্যক্রম হাতে নিতে থাকে। জাতির এ ঘোর দুর্দিনে উত্তর ভারতের স্যার সৈয়দ আহমদ খান এবং বাংলার নবাব আবদুল লতিফ প্রমুখ তদানীন্তন মুসলিম নেতৃবৃন্দ মুসলমানদের ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার লক্ষ্যে সাময়িকভাবে হলেও ইংরেজ সরকারের সাথে সহযোগিতার নীতি গ্রহণ করে মুসলমানদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার প্রশ্নে একমত হন। এই সহযোগিতা যুগের অন্যতম নেতা নবাব সলিমুল্লাহর আমলে প্রধানত প্রশাসনিক কার্যের সুবিধার্থ বাংলা বিহার উড়িষ্যা নিয়ে গঠিত বিশাল বেঙ্গল প্রেসিডেন্সীকে বিভক্ত করে ১৯০৫ সালে ঢাকা রাজধানীসহ ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম’ নামে একটি নতুন প্রদেশ সৃষ্টি করা হলে কলিকাতা প্রবাসী হিন্দু জমিদাররা পূর্ব বঙ্গে অবস্থিত তাদের জমিদারীতে তাদের প্রভাব হ্রাস পাবার আশঙ্কায়-এর বিরুদ্ধে বিরাট আন্দোলন গড়ে তোলেন। যে হিন্দু নেতৃবৃন্দ এদেশে ইংরেজ শাসন শুরু হওয়ার পর সব সময় সরকারের প্রতি একটানা সমর্থন দিয়ে আসছেন, তাদের আকস্মিক এ রুদ্র মূর্তিতে সরকার অত্যন্ত বিস্মিত ও বিচলিত হয়ে ওঠে। ফলে মাত্র ছয় বছরের মাথায় দিল্লী দরবারে বৃটিশ স¤্রাট পঞ্চম জর্জ বঙ্গভঙ্গ রদের ঘোষণা দিয়ে তাদের পুরাতন মিত্রদের মন জয়ের ব্যবস্থা নিশ্চিত করেন। এই পটভূমিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে বৃটিশ স¤্রাট পঞ্চম জর্জের প্রশংসায় রচিত হয় তাঁর বিখ্যাত সঙ্গীত “জনগণমন অধিনায়ক জয়হে ভারত ভাগ্য বিধাতা”।
বঙ্গভঙ্গ এবং ঢাকা রাজধানীসহ পুর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ সৃষ্টির ফলে দীর্ঘ অবহেলিত পূর্ববঙ্গের উন্নতির কিছুটা সম্ভাবনায় দেখা দেয়ায় এর প্রতি সমর্থন ছিল পূর্ববঙ্গের দীর্ঘ অবহেলিত জনগণের এবং তাদের নেতা নবাব সলিমুল্লাহর। বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে সে সম্ভাবনা বিলীন হয়ে যাওয়ায় নবাব সলিমুল্লাহ খুবই বিক্ষুব্ধ হন। তাঁর এ ক্ষোভ প্রশমনের লক্ষ্যে তাঁর অন্যতম দাবী ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রæতি দেয় বৃটিশ সরকার। এর বিরুদ্ধেও কলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীরা ব্যাপক বিক্ষোভ প্রকাশ শুরু করেন।
খলের জন্য ছলের অভাব হয় না এই প্রবাদ সত্য প্রমাণিত করে তারা বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে যুক্তি (কুযুক্তি!) দেখিয়ে ছিলেন, এর দ্বারা নাকি বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদের মত পাপ হবে। এবার তারা যুক্তি দেখালেন, ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় হলে তার দ্বারা নাকি বঙ্গ-সংস্কৃতি বিভক্ত হয়ে যাবে। তারা শুধু এই কুযুক্তি দেখিয়েই বসে থাকলেন না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যাতে প্রতিষ্ঠিত হতে না পারে সে লক্ষ্যে রীতিমত আন্দোলন শুরু করে দিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে ড. রাস বিহারী ঘোষের নেতৃত্বে একটি ডেপুটেশন লর্ড হার্ডিঞ্জের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানাল। কলিকাতার বিডন স্কোয়ারে সুরেশ চন্দ্র সমাজপতির সভাপতিত্বে এক প্রতিবাদ সভায় ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করা হলো। ১৯১২ সালের ২৬ মার্চ কলিকাতার টাউন হলে ব্যারিস্টার ব্যোমকেশ চক্রবর্তীর সভাপতিত্বে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার বিরোধিতা করে প্রস্তাব গৃহীত হল।
এ ব্যাপারে সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভূমিকা। ১৯১২ সালের ২৮ মার্চ কলিকাতা গড়ের মাঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়, সে সভায় সভাপতিত্ব করেন স্বয়ং কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, পূর্ববঙ্গের সাজাহাদপুর ও কুষ্টিয়ার শিলাইদহ প্রভৃতি যেসব-এলাকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জমিদারী ছিল, সেসব এলাকা ছিল মুসলিম অধুষ্ঠিত। এসব এলাকার মুসলমান প্রজাদের খাজনার টাকায় তাঁর বিত্ত-বৈভব বৃদ্ধি পেলেও এসব এলাকায় তিনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা তো দূরের কথা, একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ও তিনি প্রতিষ্ঠা করেননি। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন ঠিকই। তার জমিদারীর অন্তর্গত মুসলমান প্রজাদের টাকা নিয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন বর্ধমান বিভাগের হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা বোলপুরে।
শুধু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা কলিকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীরাই নন, খোদ ঢাকা শহরের নেতৃস্থানীয় হিন্দুরাও সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে আন্দোলনে মেতে উঠে ছিলেন। ১৯১২ সালের ৩১ জানুয়ারী লর্ড হার্ডিঞ্জ ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ঘোষণা প্রদান করায় এখানকার হিন্দু আইনজীবীগণ ১৯১২ সালের ৫ ফেব্রæয়ারী ও ১০ ফেব্রæয়ারী ঢাকা বার লাইব্রেরীতে পর পর দুটি প্রতিবাদ সভা করে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেন। এসব প্রতিবাদ সভায় সভাপতিত্ব করেন বাবু ত্রৈলোক্যনাথ বসু। এসব সভায় গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়, ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় হলে শিক্ষার অবনতি হবে। তাই প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন প্রয়োজন নেই। শুধু ঢাকাই নয়, পূর্ব বাংলার অন্যান্য স্থানেও হিন্দু নেতৃবৃন্দ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার প্রতিবাদ জানান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে অবশ্য সবচেয়ে বড় বাধা সৃষ্টির প্রয়াস পায় কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যয়ে। এ ব্যাপারে সবচেয়ে সক্রিয় ছিলেন তিনি এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জনক বলে খ্যাত সাম্প্রদায়িক রাজনীতিবিদ সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম তাঁর ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ ‘শীর্ষক গ্রন্থে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদারের “ঢাকার স্মৃতি” শীর্ষক রচনার বরাত দিয়ে এ বিষয়ে বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় কবির কারণ শুধু প্রথম মহাযুদ্ধ বা ভারত সরকারের লালফিতার দৌরাত্ম নয়, অবিভক্ত বাংলার দ্বিতীয় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরোধিতা ও প্রতিকূলতা তার জন্য বিশেষভাবে দায়ী।
শুধু হিন্দু বুদ্ধিজীবি ও নেতৃবৃন্দই নন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করে হিন্দু মালিকানাধীন পত্রপত্রিকাও। মোট কথা বাংলার সমগ্র হিন্দু সমাজই সেদিন উঠে পড়ে লাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে। হিন্দু বুদ্ধিজীবী ও নেতৃবৃন্দ বড় লাট লর্ড হার্ডিইঞ্জের কাছে মোট ১৮ বার স্মারকলিপি প্রদান করে অনাকাংখিত চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলে তার দ্বারা বঙ্গ-সংস্কৃতি বিভক্ত হয়ে পড়বে বলে তারা যে যুক্তি দেখিয়েছিলেন, সে কথা ইতোপূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। তবে তাদের মনের আসল কথা প্রকাশ হয়ে পড়ে তাদের আরেকটি বক্তব্যে। সেটি ছিল : পূর্ববঙ্গের অধিকাংশ মানুষ অশিক্ষিত মুসলমান চাষা-ভূষা, তাই তাদের উচ্চ শিক্ষার জন্য ঢাকায় কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন নেই। এ কথার আসল অর্থ হলো, পূর্ববঙ্গের জনগণ অশিক্ষিত আছে, তাই থাকুক। তাদের শিক্ষা বা উচ্চ শিক্ষার জন্য ঢাকায় কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন নেই। পূর্ববঙ্গের অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর প্রতি তাদের এই বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে তারা বহুদিন পর্যন্ত ‘মক্কা বিশ্ববিদ্যালয়’ বলে উপহাস করতেন। তবে তাদের জন্য দুর্ভাগ্যের কথা এই যে, তাদের এসব উপহাসকে অগ্রাহ্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অল্প দিনের মধ্যে অক্সফোর্ড অব দি ইষ্ট ‘‘তথা’’ প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ বলে খ্যাতিলাভ করতে সক্ষম হয়, যা ১৮৫৭ সালে স্থাপিত কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে কখনো সম্ভব হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে যারা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, তাদের কথা বলার পর এবার এতসব প্রতিবন্ধতা মোকাবেলা করে যাদের প্রচেষ্টার ফলে কিছুটা বিলম্বে হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা সম্ভবপর হয়, তাদের সম্পর্কেও সংক্ষেপে আলোকপাত করা প্রয়োজন। এদের মধ্যে প্রথমেই যাঁর নামোল্লেখ করতে হয় তিনি ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ। তিনি শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্নদ্রষ্টাই ছিলেন না, তাঁর এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য তাঁর জমিদারীর বিরাট এলাকাকেও এই লক্ষ্যে দান করে যান। এছাড়া তাঁর উদ্যোগে ১৯০৬ সালের অল ইন্ডিয়া মোহামেডান এন্ডুকেশনাল কনফারেন্সের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত বিশেষ অধিবেশনই গঠিত হয় মুসলমানদের সর্ব প্রথম সর্ব ভারতীয় রাজনৈতিক সংস্থা নিকিল ভারত মুসলিম লীগ। এই মুসলিম লীগের আন্দোলনের ফলশ্রæতিতেই ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান বিদেশী ইংরেজ শাসনের অবসানে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন এই মুসলিম লীগের একাংশের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলনেই গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ যা পরবর্তী কালে আওয়ামী লীগে রূপান্তরিত হয় এবং স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পেছনে আর যে দুই মহান ব্যক্তির উল্লেখযোগ্য অবদান ছিলো তারা হচ্ছে ধনবাড়ীর জমিদার নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী ও তদানীন্তন উদীয়মান জননেতা শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক। দুর্ভাগ্যবশত: নওয়াব সলিমুল্লাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অপূরিত স্বপ্ন বুকে নিয়েই ১৯১৫ সালে ইন্তেকাল করেন। তাঁর অবর্তমানে প্রবল প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করে তাঁর অপূরিত স্বপ্ন বাস্তবায়িত করেন সৈয়দ নওয়াব আলী ও শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক। সে দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে আমাদের আজকের বাংলাদেশ নামের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ যাঁরা সুগম করেন তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন আমাদের পবিত্র জাতীয় কর্তব্য।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


আরও
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ