Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ব্যাপক ঢল ও বন্যার আশঙ্কা

প্রকাশের সময় : ৩ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১২:২০ এএম, ৩ জুলাই, ২০১৭


‘এল-নিনো’ কেটে বাংলাদেশ ভারতেও মৌসুমি বায়ু জোরদার : প্রধান নদ-নদীর পানি বাড়ছে : জুলাইয়ে অতিবৃষ্টির পূর্বাভাস
শফিউল আলম : এলোমেলো আবহাওয়ার বৈরী আচরণ অব্যাহত রয়েছে। যার সক্রিয় বিরূপ প্রভাব শুরু গত মার্চ মাস থেকে। ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’র (৩০ মে) আঘাতের পরও চলছে দুর্যোগের ঘনঘটা। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আবহাওয়ার ‘এল-নিনো’ অবস্থাটা (বৃষ্টি রোধকারী) কেটে গেছে নীরবে। এরফলে বাংলাদেশ, ভারত, চীনেও বর্ষারোহী মৌসুমি বায়ুমালা ক্রমেই জোরদার হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে এবার মৌসুমি বায়ুর আগমনও বেশ আগেভাগে হয়েছে। মৌসুমি বায়ুর সক্রিয় প্রভাবে চলতি জুলাই (আষাঢ়-শ্রাবণ) মাসে ঢল-বন্যা অব্যাহত থাকার এবং আরো কিছু এলাকায় বন্যা বিস্তৃত হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞমহল। ভারতের বিশেষত পশ্চিমবঙ্গ থেকে শুরু করে উজানের দিকে এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আসাম, ত্রিপুরা, মিজোরাম ও মেঘালয় পাহাড়ি রাজ্যগুলোতে প্রবল বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। ভারত থেকে উজানের ঢল নেমে আসার মাত্রা যদি আরো বেড়ে যায় তাহলে পাহাড়ি ঢল ও বন্যার প্রকোপ বাড়তে পারে। গতকাল (রোববার) পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা তথ্যকেন্দ্র সূত্রে সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে জানা গেছে, দেশের অনেক নদ-নদীর পানি একযোগে বৃদ্ধি পেয়েছে। ৯০টি পয়েন্টের পর্যবেক্ষণে ৪৫টিতেই পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। তিস্তা, সুরমা ও কুশিয়ারা নদী তিনটি বর্তমানে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ৫টি পর্যবেক্ষণ স্টেশনে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা ও সুরমা-কুশিয়ারা নদ-নদীর পানির লেভেল আগামী ২৪ ঘণ্টা থেকে ৪৮ ঘণ্টায় বৃদ্ধির প্রবণতা রয়েছে বলে পূর্বাভাসে জানা যায়।      
এদিকে চলতি জুলাই (আষাঢ়-শ্রাবণ) মাসের প্রথমার্ধে সুরমা, কুশিয়ারা, তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা সহ দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে (বৃহত্তর চট্টগ্রামের পার্বত্য অববাহিকা) ভারী বর্ষণের
সম্ভাবনা রয়েছে। এ মাসে মৌসুমি বায়ুর প্রভাবজনিত বৃষ্টিপাতের কারণে দেশের উত্তরাঞ্চলের (রাজশাহী-রংপুর) কিছু কিছু স্থানে বন্যার আশঙ্কা রয়েছে। তাছাড়া জুলাইয়ে বঙ্গোপসাগরে ১ থেকে ২টি মৌসুমি লঘুচাপ সৃষ্টি হতে পারে। এরমধ্যে অন্তত একটি ঘোর বর্ষার ঘনঘটা সৃষ্টিকারী মৌসুমি নিম্নচাপে পরিণত হতে পারে। দীর্ঘমেয়াদী আবহাওয়া পূর্বাভাস প্রদানের লক্ষ্যে গতকাল বিশেষজ্ঞ কমিটির নিয়মিত বৈঠকে জুলাই মাসের এই পূর্বাভাস দেয়া হয়। ঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্র ঢাকায় অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক ও বিশেষজ্ঞ কমিটির চেয়ারম্যান সামছুদ্দিন আহমেদ। আবহাওয়া-জলবায়ুর তথা-উপাত্ত, ঊর্ধ্বাকাশের আবহাওয়া বিন্যাস, বায়মন্ডলের বিভিন্নস্তরের বিশ্লেষিত আবহাওয়া মানচিত্র, জলবায়ু মডেল, এল-নিনো এবং লা-নিনা অবস্থা ইত্যাদি উপাদান পর্যালোচনা করে বিশেষজ্ঞগণ মাসিক পূর্বাভাস প্রদান করেন।  
পূর্বাভাসে আরও জানানো হয়, এ মাসে বাংলাদেশে ‘স্বাভাবিক’ বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও গত জুন মাসে সারাদেশে স্বাভাবিকের চেয়ে ৩ দশমিক ৭ শতাংশ বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। তবে দেশের বিভিন্ন বিভাগ, জেলাওয়ারি বৃষ্টিপাতের ক্ষেত্রে তারতম্য বা অসঙ্গতি পরিলক্ষিত হয়। যেমন- সিলেট বিভাগে স্বাভাবিকের চেয়ে সর্বোচ্চ ৫০ ভাগ বেশি, চট্টগ্রাম বিভাগে ২১ ভাগ, ঢাকা বিভাগে ২ ভাগ বেশি বর্ষণ রেকর্ড করা হয়। অথচ রাজশাহী বিভাগে স্বাভাবিকের চেয়ে ৩৬ ও রংপুর বিভাগে ২৮ দশমিক ৫ ভাগ কম বৃষ্টিপাত হয়। যা সমগ্র উত্তরাঞ্চলে খরা ও অনাবৃষ্টির প্রকোপ ফুটে উঠছে। গত মে মাসে সারাদেশে স্বাভাবিকের চেয়ে ১৬ দশমিক ১ ভাগ কম বৃষ্টি হয়। আবার এপ্রিলে ১০৬ ভাগ এবং মার্চে ১৫১ ভাগ বেশি বৃষ্টিপাত হয়। যা ৩০ বছরের মধ্যে ওই মৌসুমের জন্য সর্বোচ্চ রেকর্ড।
তবে সঠিক হিসাব-নিকাশ পাওয়া না গেলেও আবহাওয়া-জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তন, পরিবেশ-প্রতিবেশ ব্যাপক দূষণ, বন-জঙ্গল বিশেষ করে উঁচু গাছপালা ধ্বংস করাসহ বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশে বজ্রপাতের দুর্যোগের মাত্রা অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে করে এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত বজ্রপাতে হতাহতের ঘটনা বেড়েই চলেছে। আর একই সাথে বেড়েছে অকালে ও ঠিক সময়ে কালবৈশাখীর ঘনঘটাও।     
গত জুন (জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ়) মাসের আবহাওয়া পরিস্থিতির পর্যালোচনায় জানা গেছে, গত ১ জুন দক্ষিণ-পশ্চিম বর্ষারোহী মৌসুমী বায়ুমালা চট্টগ্রাম উপকূল পর্যন্ত অগ্রসর হয় এবং ৩ জুন বরিশাল, ঢাকা, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগ পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। এরপর কার্যত স্থির থেকে ১৩ জুন সারাদেশে বিস্তার লাভ করে। পশ্চিমা লঘুচাপের সাথে পূবালী বায়ু প্রবাহের সংযোগ ঘটার ফলে ২, ৪, ৫ এবং ১১ জুন ঢাকা, রাজশাহী, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের অনেক স্থানে কালবৈশাখী ঝড়, বজ্র-ঝড়সহ বৃষ্টিপাত হয়। সেই সাথে দেশের কোথাও কোথাও ভারী বর্ষণও হয়। ৩, ৪ এবং ৭ থেকে ১০ জুন খুলনা বিভাগ এবং রাজশাহী, রংপুর, ময়মনসিংহ, ঢাকা ও সিলেট বিভাগের কিছু কিছু স্থানের উপর দিয়ে মৃদু ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যায়। এসময় দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৭.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস (চুয়াডাঙ্গায় ৪ জুন) রেকর্ড করা হয়। এটি ছিল গত মাসের রেকর্ডকৃত সর্বোচ্চ তাপমাত্রা।
গত ৯ জুন পশ্চিম মধ্য-বঙ্গোপসাগর ও সংলগ্ন উত্তর বঙ্গোপসাগর এলাকায় একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হয়। এটি ১০ জুন একই এলাকায় ঘনীভূত হয়ে সুস্পষ্ট লঘুচাপে পরিণত হয়। এটি আরও ঘনীভূত হয়ে ১১ জুন রাতে উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর ও সংলগ্ন এলাকায় মৌসুমি নিম্নচাপে পরিণত হয়। এটি উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে ১২ জুন সকালে ভোলার নিকট দিয়ে বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করে। পরবর্তীতে এটি স্থলভাগের উপর দিয়ে আরও উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে স্থল নিম্নচাপ আকারে কুমিল্লা ও সংলগ্ন এলাকায়, পরে কিশোরগঞ্জ-হবিগঞ্জ হয়ে আরও উত্তর-পূর্ব দিকে ভারতে গিয়ে দুর্বল ও গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। মৌসুমি নিম্নচাপটির প্রভাবে বরিশাল, চট্টগ্রাম, ঢাকা, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগে দমকা থেকে ঝড়ো হাওয়াসহ ভারী থেকে অতিভারী বর্ষণ হয়। এরফলে চট্টগ্রাম বিভাগের পাহাড়ি এলাকায় ভূমিধস সৃষ্টি হয়। সারাদেশে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর (বর্ষা) বিস্তার, বৃষ্টিপাত, বৃষ্টিপাতের দিন সংখ্যা, তাপমাত্রা, তাপপ্রবাহ, মৌসুমী নিম্নচাপ, কৃষি আবহাওয়া এবং দেশের নদ-নদীর অবস্থা জুন মাসের পূর্বাভাসের সাথে সংগতিপূর্ণ ছিল বলে জানায় আবহাওয়া বিভাগ।
নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি
পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা তথ্যকেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত সর্বশেষ পরিস্থিতিতে আরো জানা যায়, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা ও সুরমা-কুশিয়ারা নদ-নদীসমূহের পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদ-নদীর পানির সমতল বৃদ্ধির প্রবণতা আগামী ৪৮ ঘণ্টায় অব্যাহত থাকতে পারে। গঙ্গা-পদ্মা নদ-নদীর পানির সমতল বৃদ্ধির প্রবণতা আগামী ২৪ ঘণ্টায় অব্যাহত থাকতে পারে। অন্যদিকে সিলেট অঞ্চলের সুরমা-কুশিয়ারা নদ-নদীর পানির সমতল বৃদ্ধির প্রবণতা আগামী ২৪ ঘণ্টায় অব্যাহত থাকতে পারে। গতকাল পর্যন্ত তিস্তা নদী ডালিয়া পর্যবেক্ষণ পয়েন্টে বিপদসীমার ৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। সুরমা নদী কানাইঘাটে ৫৯ সে.মি. এবং কুশিয়ারা নদী অমলশিদ, শেওলা ও শেরপুর-সিলেট এই তিনটি পয়েন্টে বিপদসীমার ৮৩, ৭২ ও ২৪ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য দিকটি হচ্ছে, দেশের অনেক নদ-নদীর পানি একযোগে বেড়ে যাচ্ছে। ৯০টি পর্যবেক্ষণ পয়েন্টের মধ্যে ৪৫টিতে অর্থাৎ অর্ধেক স্থানেই পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এরমধ্যে তিস্তা, সুরমা ও কুশিয়ারা নদী তিনটির পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ৫টি পর্যবেক্ষণ স্টেশনে। অন্যান্য নদীর পানি অপরিবর্তিত ৭টি পর্যবেক্ষণ পয়েন্টে, তথ্য পাওয়া যায়নি ৬টিতে আর হ্রাস পেয়েছে ৩২টি পয়েন্টে। গতকাল সকাল ৯টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় উত্তরাঞ্চলের চিলমারী ও রংপুরে যথাক্রমে ৭২ এবং ৬১ মিলিমিটার হারে ভারী বর্ষণ হয়েছে।     
পাহাড়ধসের সতর্কতা        
সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে গতকাল রোববার সন্ধ্যা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় রংপুর, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের কোথাও কোথাও ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণ হতে পারে। এ কারণে সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের পাহাড়ি এলাকার কোথাও কোথাও ভ‚মিধসের আশঙ্কা রয়েছে বলে সতর্ক করে দিয়েছে আবহাওয়া বিভাগ।  
আবহাওয়া বিভাগ সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানায়, মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের উপর সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে মাঝারি অবস্থায় বিরাজ করছে। আজ সোমবার রাজশাহী, রংপুর, ময়মনসিংহ, ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় অস্থায়ী দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টিপাত হতে পারে। সেই সাথে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে ভারী বর্ষণ হতে পারে। সারাদেশে দিনের তাপমাত্রা ১ থেকে ৪ ডিগ্রি সে. হ্রাস পেতে পারে। রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টায় আবহাওয়ার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই। বর্ধিত ৫ দিনে আবহাওয়ার সামান্য পরিবর্তন হতে পারে।
গতকাল সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের রেকর্ড ফেনীতে ৯৬ মিলিমিটার। এ সময় ঢাকায় ৫, ময়মনসিংহে ৬, চট্টগ্রামে ৪১, সিলেটে ২৪, খুলনায় ১৩, বরিশালে ২৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বন্যা

১৫ অক্টোবর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ