Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইত্যাদির মিশন এবং ভিশন

| প্রকাশের সময় : ১ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

ডিলান হাসান:‘পুঁথিগত বিদ্যা আর পর হস্ত ধন, নহে বিদ্যা নহে ধন হলে প্রয়োজন।’ একটা সময় স্কুল-কলেজে ব্যাকরণে এই ছত্রটির ভাব সম্প্রসারণ করতে গিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের এর সম্প্রসারণকৃত বিবরণ মুখস্ত করতে হতো। মুখস্ত করে তারপর পরীক্ষায় লিখতে হতো। ছাত্র-ছাত্রীরা পুস্তকীয় সম্প্রসারণ কতটা হৃদয়ঙ্গম করতো, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যেত। নিজ বোধ ও বুদ্ধির মাধ্যমে এর মমার্থ খুব কম ছাত্র-ছাত্রীই উদ্ধার করতে পারত। বাস্তব জীবনে কথাগুলো কতটা কাজে লাগবে বা লাগবে না, তা খুব কম ছাত্র-ছাত্রীই উপলব্ধি করত। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পড়তে হবে, মুখস্ত করতে হবে, নম্বর পেতে হবেÑএই লক্ষ্য থাকত। অথচ আমরা যদি ছত্রখানির মর্মার্থ যথাযথভাবে উপলব্ধি করে, সেই অনুযায়ী নিজেদের জীবনে কাজে লাগাতে পারতাম, তাহলে ভিন দেশী, পরদেশী সম্পদ, সংস্কৃতি ও আচার-আচরণের উপর নির্ভরশীল হতাম না। আত্মমর্যাদাশীল একটি জাতি হিসেবে আরও অনেকদূর এগিয়ে যেতাম। হানিফ সংকেত তার এক ইত্যাদির মাধ্যমে আমাদের পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের অজ¯্র অসঙ্গতির কথা প্রতিনিয়ত তুলে ধরছেন। আমাদের পরিবার ও সমাজের ভেতরে বিদ্যমান অসঙ্গতিগুলো চোখে আঙ্গুল দিয়ে বারবার দেখিয়ে দিচ্ছেন, দেখাচ্ছেন। আমরা দেখি, আনন্দ পাই, তারপর ভুলে যাই। আমাদের সহজাত এই প্রবৃত্তির বিষয়টি হানিফ সংকেত জানেন এবং বোঝেন বলেই তিনি বারবার অসঙ্গতিগুলো মনে করিয়ে দেন এবং তা বাস্তব জীবনে প্রতিফলিত করার জন্য নিরলসভাবে আহŸান জানিয়ে যাচ্ছেন। এখনতো শুধু নাট্যাংশের মাধ্যমেই নয়, বাস্তব জীবনের অসঙ্গতি এবং মানুষের মহতি উদ্যোগগুলো প্রতিবেদন আকারে তুলে ধরে আমাদের বোধে বিদ্ধ করার চেষ্টা করছেন। আমাদেরকে প্রাণিত, অনুপ্রাণিত এবং শানিত করার তার এই প্রয়াস অব্যাহতভাবেই এগিয়ে চলেছে। তা নাহলে, দেশি-বিদেশি মিলিয়ে শত শত টেলিভিশন অনুষ্ঠানের মধ্যে এক ইত্যাদি দেখার জন্য কেন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে হবে? এ কথা অনস্বীকার্য, দেশ ও জাতির কল্যাণে ইত্যাদি যেমন হানিফ সংকেতের একটি মিশন, তেমনি সাধারণ থেকে অতি সাধারণ মানুষের কাছে এটি ভিশনে পরিণত হয়েছে। আমরা দেখছি, হানিফ সংকেত তার মিশন নিয়ে মানুষের কল্যাণে কীভাবে প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রান্তিক মানুষের কাছে ছুটে চলেছেন। বিশ্বে এমন কোনো টেলিভিশন অনুষ্ঠান নেই, যা এভাবে সুবিধা বঞ্চিত মানুষের কাছে ছুটে যায়। কাউকে কাউকে প্রান্তিক মানুষদের নিয়ে অনুষ্ঠান করতে দেখা যায়। তবে তা ঐসব মানুষদের কল্যাণের জন্য নয়, বরং মানুষগুলোর দুঃখ-দুর্দশাকে পুঁজি করে বিনোদনের উপাদান জোগাড় করে। তাদের পাশে দাঁড়িয়ে কিছু একটা করে দেয়ার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে দেখা যায় না, নিজেরাই তাদের পাশে দাঁড়িয়ে আনন্দ করে। এটা প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষদের সাথে এক ধরনের তামাশা করা ছাড়া কিছুই নয়। এর বিপরীতে আমরা দেখেছি, হানিফ সংকেত প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের উদ্যোগের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে, তাদের একটু এগিয়ে দিতে হাত বাড়াতে, তাদের অবদানকে মানুষের সামনে বড় করে তুলে ধরতে। প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষদের নিয়ে আনন্দ করতে নয়, তাদের আনন্দের যোগান দিতে তিনি নিরন্তর ছুটে বেড়াচ্ছেন। আমরা যদি বাংলাদেশের পারিবারিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করি, তবে বলতে হবে ইত্যাদি এসবের আধার, যেখানে মাটি ও মানুষের সৌরভ বিদ্যামান। আমাদের বুঝতে হবে, ইত্যাদি নিছক কোনো বিনোদনমূলক একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠান নয়। এটা পরিবার, সমাজ ও দেশের নিজস্বতার এক উচ্চ মার্গীয় অনুষ্ঠান। এর বিষয়বস্তু সাজানোই হয় দেশমাতৃকার কল্যাণের লক্ষ্যে। শিক্ষা, তথ্য এবং এ দুইয়ের মাধ্যমে আনন্দ সৃষ্টি করা। কাজটি অত্যন্ত জটিল। যুগের পর যুগ ধরে সৃজিত হতে হতে অনুষ্ঠানটি পরিণত হয়েছে। এর ভীত এবং প্রাচীর অত্যন্ত মজবুত। এই ভীত এবং প্রাচীর অতিক্রম করা কোনো টেলিভিশন অনুষ্ঠানের পক্ষে এখন সম্ভব নয়। এক ইত্যাদিতে যত ধরনের ধারণা ও জ্ঞানের উপাদান সৃষ্টি করা হয়, তা দেশের আর অন্য কোনো অনুষ্ঠানে দেখা যায় না। দেশের যদি একটি নিজস্ব অনুষ্ঠানের নাম নিতে হয়, তবে ইত্যাদির নামই নিতে হবে। বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে যদি জানতে হয়, তবে এক ইত্যাদিই যে কারো জন্য যথেষ্ট। এর পর্বে পর্বে, পরতে পরতে রয়েছে, বাংলাদেশের সংস্কৃতির নির্যাস। বিদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসন থেকে দেশীয় সংস্কৃতিকে রক্ষা এবং একই সঙ্গে উপস্থাপন করার এমন প্ল্যাটফর্ম আর একটিও নেই। এবারের ঈদের ইত্যাদিতে দর্শক পর্বে যেভাবে বিদেশি চ্যানেলের প্ল্যাকার্ড দর্শক উঁচিয়ে ধরেছিল, তা যে আমাদের দেশে এসব চ্যানেলের আগ্রাসন চলছে, তার একটি চিত্র নিমেষেই ফুটে উঠে। বড়ই অস্বস্তি এবং আফসোসও হচ্ছিল। আবার প্ল্যাকার্ডগুলো যখন নামিয়ে ফেলা হয় এবং আমাদের বিটিভির লগোটি উর্ধে তুলে ধরা হয়, তখন স্বস্তি, প্রশান্তি ও গর্বে বুক ভরে উঠে। দেশীয় সংস্কৃতির প্রতি এমন অসাধারণ উপস্থাপনা আর কী হতে পারে! দর্শক পর্বে ভিনদেশি সিরিয়ালের যে বিদ্রæপাত্মক নাট্যাংশ উপস্থাপন করা হয়, তা শুধু বিনোদন ছিল না, ছিল দেশের সংস্কৃতির প্রতি সুতীব্র আহŸান। চারজন দর্শককে উপহারস্বরূপ যে বই ও বৃক্ষ চারা উপহার দেয়া হয়, এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে জ্ঞান ও গর্বের বিষয়। বৃক্ষ উপহার দেয়ার মাধ্যমে দেশকে সবুজায়ন করার এমন নজির আর কী হতে পারে! আমরা যখন বিদেশি সংস্কৃতির প্রতি প্রবল বেগে ছুটছি, তখন হানিফ সংকেত বিদেশিদের দিয়েই আমাদের সংস্কৃতি উপস্থাপন করে দেখিয়ে দিচ্ছেন আমাদের সংস্কৃতি কতটা সমৃদ্ধ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ট্যালেন্ট খুঁজে বের করার অনুষ্ঠান করা হয়। আমাদের দেশেও এ ধরনের প্রতিযোগিতা রয়েছে। ইত্যাদির ট্যালেন্ট হান্টে প্রতিযোগিতা করতে হয় না। প্রত্যন্ত গ্রাম-গঞ্জে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে ট্যালেন্টদের ইত্যাদি নিজে গিয়ে খুঁজে বের করে মূল্যায়ণ করে। নিঃস্বার্থ এমন প্রতিযোগিতা আর কোথায় আছে? ইত্যাদির মানবীয় গুণাবলীর প্রকাশ আমরা বিভিন্নভাবে দেখেছি। ভিক্ষুককে ভিক্ষা দেয়ার মানবীয় গুণাবলী নয়, বরং কর্ম উৎসাহী মানুষদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের পথকে প্রসারিত করে দেয়ার মানবীয় গুণাবলীর দৃষ্টান্ত প্রতিনিয়ত ইত্যাদি স্থাপন করছে। কয়েক বছর আগে বিনোদন প্রতিদিনে আমরা একটি বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলাম। প্রতিবেদনের শিরোনাম অনেকটা এরকম ছিলÑ ‘হানিফ সংকেতকে কেন নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া হবে না?’ কেন দেয়া হবে না, তার যুক্তি যথাযথভাবে তুলে ধরে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল। ভারতের কৈলাশ সত্যর্থী ও পাকিস্তানের মালালা যদি নোবেল শান্তি পুরস্কার পেতে পারে, তবে হানিফ সংকেত শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার যোগ্যতা অনেক আগেই অর্জন করেছেন। কারণ এক ইত্যাদি দিয়ে শান্তি পুরস্কার পাওয়ার জন্য যে উপযুক্ততা প্রয়োজন, হানিফ সংকেত এ উপযুক্ততা অনেক আগেই অর্জন করেছেন।



 

Show all comments
  • কবির ১ জুলাই, ২০১৭, ৪:২১ এএম says : 0
    লেখাটা খুব ভালো লেগেছে।
    Total Reply(0) Reply
  • harun ur rashid ১ জুলাই, ২০১৭, ১০:৫৯ এএম says : 0
    Novel prize not a big award compare to public passion and respect. Novel prize is already politicalised. Mr Hanif is king of our heart so, no need any western prize. He already gain an extra height compare to novel prize winner.
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইত্যাদি

১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ