পোশাক রপ্তানিতে উৎসে কর ০.৫ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব
আগামী পাঁচ বছরের জন্য তৈরি পোশাক রপ্তানির বিপরীতে প্রযোজ্য উৎসে করহার ১ শতাংশ থেকে হ্রাস করে ০.৫ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করেছে পোশাক খাতের দুই সংগঠন
রফিকুল ইসলাম সেলিম : চট্টগ্রামে মাদকের ভয়াল বিস্তারের দিশেহারা সাধারণ মানুষ। একের পর সাঁড়াশি অভিযানেও রোধ করা যাচ্ছে না মাদকের আগ্রাসন। যে পরিমাণ মাদকের চালান ধরা পড়ছে তার কয়েকগুণ নিরাপদে পাচার হয়ে যাচ্ছে। ভারত থেকে অবাধে আসছে ফেনসিডিল, গাঁজাসহ হরেক মাদক। সাগর, সড়ক ও পাহাড়ি পথে মিয়ানমার থেকে আসছে ইয়াবার চালান। সীমান্ত হয়ে আসছে হরেক রকমের নেশার সামগ্রী।
মাদক ব্যবসাকে ঘিরে গড়ে উঠা সিন্ডিকেটে জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক দলের ক্যাডার-মাস্তান ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর কিছু অসাধু কর্মকর্তা জড়িয়ে যাওয়ায় এদের নেটওয়ার্কও ভাঙ্গা যাচ্ছে না। পুলিশের হিসাবে চট্টগ্রাম বিভাগের ১১ জেলায় মাসে গড়ে অন্তত এক হাজার জন মাদকসহ ধরা পড়ছে। এসব ঘটনায় গড়ে মামলা হচ্ছে ৭শ। তবে মাদক ব্যবসার মূলহোতারা আড়ালেই থেকে যাচ্ছে।
মাদকের নীল ছোবলে ধ্বংসের পথে নতুন প্রজন্ম। তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে শিশু-কিশোররাও মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। এর ফলে পরিবার ও সমাজে অস্থিরতা বাড়ছে। আসক্তের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অপরাধ প্রবণতা। পুলিশের হিসাবে অপরাধীদের ৭০শতাংশই মাদকাসক্ত। বিশেষ করে ছিনতাই, ঝাপটাবাজির সাথে জড়িতদের প্রায় সকলে মাদকাসক্ত। মহানগরী এবং জেলায় মাদক ব্যবসাকে ঘিরেও সংঘাত-সহিংসতা বাড়ছে। প্রশাসনের তরফে বলা হচ্ছে তাদের পক্ষে একক ভাবে মাদক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়-এর জন্য দরকার সামাজিক প্রতিরোধ। তবে এ ক্ষেত্রেও তেমন কোন উদ্যোগ নেই। সমাজ আর জাতি বিধংসী এই মাদকের বিরুদ্ধে নেই কোন সামাজিক আন্দোলন। প্রশাসনের উদ্যোগে স্কুল, কলেজ বা কোন সংগঠনের ব্যানারে কিছু সভা সমাবেশ হলেও নীরব এখানকার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো। সুশীল সমাজের অংশ হিসাবে যারা নিজেদের দাবি করেন তারাও এ বিষয়ে বেখবর।
এ অবস্থায় অনেকটা দিশেহারা হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ। মাদকের বেচাকেনা বেড়ে গেছে। কোন কোন এলাকায় প্রকাশ্যে চলছে মাদক সেবন, বসছে মাদকের হাট। আগে নির্ধারিত কিছু এলাকায় মাদকের বেচাকেনা হলেও এখন ওই সব স্পটের পাশাপাশি চালু হয়েছে মোবাইল কালচার। নির্দিষ্ট ফোনে চাহিদা জানিয়ে দিলে পৌঁছে যাচ্ছে মাদক। হাটের পাশাপাশি ডিজিটাল পদ্ধতিতেও চলছে মাদক কেনাবেচা। পবিত্র রমজান মাসেও র্যাব-পুলিশের অভিযানে ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজাসহ মাদকের বিশাল বিশাল চালান ধরা পড়েছে। নগরীর মাদকের আড়ত হিসাবে পরিচিত কদমতলীর বরিশাল কলোনীতে কয়েক দফা বøক রেইড দিয়ে মাটির নীচ থেকে ফেনসিডিলের কয়েকটি চালান আটক করেছে পুলিশ। ফেনী ও কুমিল্লা সীমান্ত হয়ে ভারত থেকে প্রতিনিয়ত আসছে ফেনসিডিল, গাঁজাসহ হরেক রকমের মাদক। সীমান্ত পথে আসা এমন বেশ কয়েকটি চালান সম্প্রতি র্যাবের অভিযানে ধরা পড়ে। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার সকালে ভাটিয়ারী থেকে একটি ট্রাকবোঝাই ১১শ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার করে র্যাব। মিয়ানমার থেকে আসা ইয়াবার বেশ কয়েকটি বড় চালান ধরা পড়ে সম্প্রতি। পুলিশ ও মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেন, বর্তমানে দেশে ৩০ ধরণের মাদকদ্রব্য পাওয়া যায়। এসব মাদকের প্রায় সবগুলো আসে বিদেশ থেকে। এগুলো হলো গাঁজা, চোলাই মদ, রেক্টিফাইড স্পিরিট, ডিনেচার্ড স্পিরিট, তারি, ভাং, ফার্মেন্টেড ওয়াশ, বাখার, ঘুমের ট্যাবলেট, ডেনড্রাইট বা ড্যান্ডি, দেশি মদ। এর মধ্যে পপি গাছ ও ফল দেশেই উৎপাদিত হয়।
তবে এখন গাঁজার বড় চালানগুলো আসছে ভারত থেকে। এছাড়া বিভিন্ন দেশ থেকে পাচার হয়ে আসা মাদকদ্রব্যের মধ্যে রয়েছে হেরোইন, কোকেন, চরস, বিদেশী মদ, বিয়ার ফেনসিডিল, প্যাথেড্রিন, অ্যালকোহল, ইয়াবা ট্যাবলেট, রিকোডেক্স, কডোকফ সিরাপ, ভায়াগ্রা-সানাগ্রা ট্যাবলেট, এডেগার সিরাপ। চট্টগ্রামে প্রায় সব ধরনের মাদক পাওয়া যাচ্ছে। তবে নেশার রাজ্যে এখন রাজা মিয়ানমারের ইয়াবা আর ভারতীয় ফেনসিডিল ও গাঁজা। এসব মাদক বিশেষ করে ইয়াবা চট্টগ্রাম হয়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় চলে যাচ্ছে।
কক্সবাজার ও বান্দরবান এবং চট্টগ্রাম কেন্দ্রিক সিন্ডিকেটের হাত ধরে এসব মাদক পাচার হয়ে আসছে আর নির্ধারিত গন্তব্যে পৌঁছে যাচ্ছে। মাদক সিন্ডিকেটের সাথে খোদ সরকারি দলের এমপি ও তাদের আত্মীয়-স্বজন এমনকি পুলিশের বেশ কিছু অসাধু কর্মকর্তাও জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে। মাদক পাচার আর বিক্রি করতে গিয়ে র্যাব পুলিশের অনেক সদস্য ধরা পড়েছেন। এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা মাদক বহনের ‘নিরাপদ মাধ্যম’ হিসেবে শিশু ও নারীকে ব্যবহার করছে। এ ক্ষেত্রে মাদক ব্যবসায়ীদের মূল টার্গেট হচ্ছে অসচ্ছল ও প্রান্তিক নারী। পুলিশ-র্যাবের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম নগরীর অর্ধশতাধিক মাদক স্পট নিয়ন্ত্রণ করছে নারীরা। বিভিন্ন সময়ে তারা মাদকসহ ধরা পড়লেও পেশাদার মাদক ব্যবসায়ীরা আড়ালে থেকে যাচ্ছে।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টহল ও তল্লাশীকে ফাঁকি দেওয়ার উদ্দেশ্যেই নারীদের মাদক বহনের কাজে ব্যবহার করা হয়। তাদের বিশেষ ধরনের পোশাক পরিয়ে ফেনসিডিল, গাঁজা, হেরোইন বা ইয়াবা সহজেই এক স্থান থেকে অন্যত্র নেওয়া যায়। মূলত বস্তি এলাকার নারীরা মাদক বহনের কাজ করছে। তাদের বেশির ভাগকেই সামান্য অর্থের বিনিময়ে এ কাজে লাগানো হচ্ছে। আবার মাদক ব্যবসায়ী স্বামীর চাপে বাধ্য হয়েও কেউ কেউ এ কাজ করছে। অনেকে এটাকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করে নিয়েছে। কারাগার থেকে বের হয়েও ফের তারা মাদক ব্যবসায় নামছে।
একের পর এক সাঁড়াশি অভিযানের পরও মাদকের বিস্তার রোধ না হওয়ার কারণ হিসেবে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেন, দীর্ঘদিন ধরে মাদকদ্রব্য পাচারের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে চট্টগ্রাম। চট্টগ্রাম হয়েই এসব চালান দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যাচ্ছে। ভৌগোলিক কারণে চট্টগ্রামে মাদক ঢুকছে অবাধে। নদী, পাহাড় কিংবা সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো প্রায় অরক্ষিত। এটা মাদক পাচারের বড় একটি কারণ। মাদক ব্যবসায়ীদের নেটওয়ার্কের কাছে হার মানছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর সদস্যরা। মাদকদ্রব্য সহজে লুকিয়ে পরিবহন করা যায়। সুনির্দিষ্ট তথ্য ছাড়া এসব চালান ধরার কোন উপায় নেই। কোন যানবাহন বা নৌযানকে সুনির্দিষ্ট তথ্য ছাড়া চ্যালেঞ্জ করা সম্ভব নয়। ফলে অভিযানে মাদক বহনকারীরা ধরা পড়লেও মূল পাচারকারিরা আড়ালে থেকে যায়। তাদের সাথে রাঘব-বোয়ালরা জড়িত থাকায় অভিযানেও তাদের ধরা যায় না।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম সফরকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর একার পক্ষে মাদক নির্মূল করা সম্ভব নয়। এর বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
আইন-শৃঙ্খলা কমিটির প্রায় প্রতিটি সভায় সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে কিছুটা সন্তোষ প্রকাশ করা হলেও মাদকের ভয়াল বিস্তার নিয়ে খোদ প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারাও উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তারাও এর বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধের তাগিদ দেন। তবে সামাজিক সংগঠনগুলো এ ব্যাপারে র্নিলিপ্ত। রাজনৈতিক ইস্যুতে তারা যেভাবে রাস্তায় সরব হচ্ছে, মাদকের মতো জাতি বিধংসী ইস্যুতে তারা রহস্যজনক নীরবতা পালন করছে। রাজনৈতিক দল ও তাদের অঙ্গ এবং সহযোগি সংগঠনগুলো এব্যাপারে একেবাইরে চুপ। ফলে মাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন নেই।
চট্টগ্রামের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন মাদকের বিরুদ্ধে ‘জিহাদের’ ডাক দিয়েছেন। সম্প্রতি নগরীর সদরঘাটে এলাকাবাসীর উদ্যোগে মাদকবিরোধী এক মানববন্ধন কর্মসূচিতে তিনি মাদকের বিস্তারের জন্য পুলিশের কতিপয় সদস্যদের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, যারা মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। নগরীতে মাদক ব্যবসার সাথে জড়িতদের তালিকা তৈরী হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, পুলিশের হাতে এ তালিকা তুলে দেব। তালিকা ধরে ধরে ব্যবস্থা নিতে হবে। স্থানীয়রা অভিযোগ করেন নগরীর অনেক এলাকায় মাদকব্যবসায়ীদের সাথে পুলিশের কতিপয় কর্মকর্তার সখ্যতার কারণে মাদক ব্যবসা ঠেকানো যাচ্ছে না।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।