Inqilab Logo

বুধবার, ০৩ জুলাই ২০২৪, ১৯ আষাঢ় ১৪৩১, ২৬ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

অরক্ষিত বাণিজ্যিক নগরী

| প্রকাশের সময় : ৭ জুন, ২০১৭, ১২:০০ এএম


জোয়ারে ডুবছে বিশাল এলাকা : আগ্রাবাদে পানিবদ্ধতায় ‘দুঃখের বার মাইস্যা’ : আজও হলো না স্থায়ী শহর রক্ষা বাঁধ
শফিউল আলম : ভাঙা বেড়িবাঁধ ও খাল-নালা দিয়ে জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যায় বিশাল এলাকা। জোয়ারের সাথে বর্ষণ হলে পরিস্থিতি হয় আরও জটিল। ব্যবসা-বাণিজ্য, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, আমদানি-রফতানি ও শিপিং-সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি অফিস পাড়া, মসজিদ, হাসপাতাল-ক্লিনিক, মার্কেট, শো-রুম, কমিউনিটি সেন্টার, গার্মেন্টস কারখানা, গুদাম, আড়ত, গ্যারেজ-ওয়ার্কশপ, আবাসিক এলাকা, রাস্তা-ঘাট সড়ক মাঠ সবকিছুই ভেসে যায়। এই চিত্র বন্দরনগরীর সবচেয়ে বনেদী ঐতিহ্যবাহী বাণিজ্যিক এলাকা আগ্রাবাদ ও এর আশপাশের বিশাল এলাকার। এখানকার জনদুর্ভোগ অর্থাৎ ‘দুঃখের বার মাইস্যা’ অবর্ণণীয়। জোয়ার ও বৃষ্টির পানি গত কয়েকদিনে কমে গেছে। কিন্তু অনেক জায়গাতেই জমে থাকা পানির সাথে নালা-নর্দমা ও ডাস্টবিনের গলিত ময়লা-আবর্জনা, মশার রাজত্ব, যোগাযোগ ও বিদ্যুৎহীনতা মিলে এক নারকীয় অবস্থা বিরাজ করছে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও উৎপাদনে সরাসরি ক্ষতি হচ্ছে দৈনিক কোটি কোটি টাকা। বছরের প্রায় ৫ মাস জুড়েই জোয়ার ও পানিবদ্ধতার কারণে বহুমুখী সঙ্কটের মুখে পড়েছে গোটা আগ্রাবাদ হালিশহর। গত ৩-৪ বছর যাবত এ সমস্যা-সঙ্কট ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। তবে কর্তৃপক্ষ বরাবরের মতোই নির্বিকার। অথচ পরিহাসের দিক হচ্ছে, আগ্রাবাদ এলাকাটি সমুদ্র উপকূলের সাথে ঠিক লাগোয়া নয়; যথেষ্ট দূরেই অবস্থিত।
এমনকি মূল আগ্রাবাদের আরও পূর্ব দিকে অনেকটা উঁচু জায়গায় স্থাপিত দেশের প্রথম ও একমাত্র সুরম্য ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার, চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজ রোড, হোটেল আগ্রাবাদ সড়ক পর্যন্ত ডুবে যাচ্ছে জোয়ারে। আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা, মধ্যম ও উত্তর-মধ্যম
হালিশহর, গোসাইলডাঙ্গা, বেপারিপাড়া, হাজিপাড়া, কুসুমবাগ, বন্দর কলোনী, বড়পুল ও ছোটপুল এলাকাসহ আশেপাশের বিরাট এলাকা প্লাবিত হয়। মজবুত ও স্থায়ী শহর রক্ষা বেড়িবাঁধ না থাকায় নিয়মিত সামুদ্রিক জোয়ারের পানিতে এসব এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। আবার ভাটার সময়ও পানি নামছে না, বরং আটকে থাকছে। বিস্তীর্ণ এলাকায় পানিবদ্ধতা স্থায়ী সমস্যায় রূপ নিয়েছে। শহর রক্ষা বাঁধ না থাকার সাথে আরও দায়ী, দখল-ভরাট-দূষণে বিপর্যস্ত মহেশখাল। তদুপরি খালটির উপর ২০১৫ সালে দেড় কোটি টাকায় নির্মিত অপরিকল্পিত বাঁধ, যা এখন ‘দুঃখের ফাঁদ’।
এদিকে আগ্রাবাদ ছাড়াও পতেঙ্গা, কাটগড়, দক্ষিণ হালিশহর থেকে শুরু করে সাগরিকা, কাট্টলী-ফৌজদারহাট উপকূল পর্যন্ত সামুদ্রিক জোয়ারে নিমজ্জিত হচ্ছে। এতে করে দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত বন্দরনগরী চট্টগ্রামের পশ্চিম, দক্ষিণ-পশ্চিম ও দক্ষিণ ভাগজুড়ে বিস্তীর্ণ এলাকার অন্তত ২০ থেকে ২৫ লাখ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হচ্ছে। অনেকেই দীর্ঘদিনের বসতি, ব্যবসা-বাণিজ্য গুটিয়ে নিয়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে।     
গত ৩০ মে (মঙ্গলবার) ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ চট্টগ্রাম-কক্সবাজার উপকূল অতিক্রম করে। ‘মোরা’র আঘাতের সময়ে (সকাল ৬টা-দুপুর ১২টা) সাগরে ছিল ভাটা। এর সুবাদে জলোচ্ছ¡াসের যে আশঙ্কা ছিল তা হয়নি। তবে ঝড় অতিক্রমের পর বিকেল থেকে নিয়মিত জোয়ার শুরু হয়। আর সন্ধ্যায় হয় ভারী বর্ষণ। বৃষ্টি ও জোয়ারে সমগ্র আগ্রাবাদ-হালিশহর এলাকা হাঁটু থেকে কোমর সমান পানিতে তলিয়ে যায়। ‘মোরা’র পরের ক’দিন তলিয়ে থাকা আগ্রাবাদ সিডিএ সড়কে যানবাহনের পরিবর্তে এলাকাবাসী জরুরি প্রয়োজনের তাগিদে চলাচল করতে বাধ্য হয় সাম্পান-নৌকাযোগে। সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় দিকটি হচ্ছে, ‘মোরা’ পার হয়েছে গতকাল (মঙ্গলবার) ৭ দিন। কিন্তু আগ্রাবাদ সিডিএসহ আশপাশের অনেক এলাকায় জমে থাকা কাদা-পানি, আবর্জনায় বিষিয়ে উঠেছে পরিবেশ। আগ্রাবাদ এক্সেস রোড ও আশপাশের প্রায় ১১শত দোকান-পাট, শো-রুম, মার্কেটে বেচাকেনা থমকে আছে। সর্বত্র অসহনীয় পূতিগন্ধময় পরিবেশ।              
অরক্ষিত চট্টগ্রাম : হলো না শহর রক্ষা বাঁধ            
দেশের ‘বাণিজ্যিক রাজধানী’ খ্যাত বন্দরনগরী চট্টগ্রামের আদি ব্যবসা-বাণিজ্যের নাভি হচ্ছে বৃহত্তর আগ্রাবাদ এলাকা। আগ্রাবাদ ও এর সংলগ্ন বৃহত্তর হালিশহর, পতেঙ্গা, কাট্টলী এলাকাগুলো বর্ষণ ও জোয়ারে ঘন ঘন পানিবদ্ধতা ‘ক্রনিক’ সমস্যায় পরিণত হয়েছে। এর মূলে রয়েছে চট্টগ্রাম শহর রক্ষা বাঁধের দীর্ঘদিনের অত্যন্ত নাজুকদশা। বেড়িবাঁধ মাঝেমধ্যে জোড়াতালি মেরামত করা হলেও তা খুবই অপর্যাপ্ত। চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসা-বাণিজ্য, দেশের প্রথম ইপিজেড, বেসরকারি কর্ণফুলী ইপিজেড, বন্দর-শিপিং ও প্রতিরক্ষা স্থাপনাসমূহের অবস্থান এই এলাকায়। এসব গুরুত্বের প্রেক্ষাপটে বন্দরনগরীর উত্তর-পশ্চিমে ফৌজদারহাট থেকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমে হালিশহর হয়ে পতেঙ্গা পর্যন্ত সামুদ্রিক জোয়ারের আনুপাতিক হার অনুসারে যথেষ্ট উঁচু ও মজবুত একটি যুগোপযোগী শহর রক্ষা বাঁধের দাবিটি বহু পুরনো। অথচ তা এখনও উপেক্ষিত রয়ে গেছে। এ বিষয়ে ১৯৯১ সালের সাইক্লোনের পর প্রাথমিক সমীক্ষা করা হয়। তা আর বেশি অগ্রসর হয়নি। এ অবস্থায় আজও হলো না দীর্ঘ প্রত্যাশিত স্থায়ী ও মজবুত শহর রক্ষা বেড়িবাঁধ। পরবর্তী সময়ে যে দায়সারা গোছের বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার করা হয়, তার কাজের মান সঠিক ছিল না। কোনো বালাই ছিল না উপযুক্ত তদারকি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা। বরং সীমাহীন দুর্নীতি অনিয়ম, নয়-ছয়, শুভঙ্করের ফাঁকি হয়েছে। এতে করে সেই বেড়িবাঁধ টেকেনি। বিরান হয়ে গেছে সাগরের পেটে। যা আছে নড়বড়ে ও জরাজীর্ণ অবস্থায়। তাও সামুদ্রিক জোয়ারের সমানুপাতে খুব কাছাকাছি। এতে করে নিয়মিত জোয়ার হলেই নগরীর দক্ষিণ ও পশ্চিমের উপকূলীয় এলাকাগুলোর ভাঙাচোরা বেড়িবাঁধ দিয়ে পানি হু হু করে আগ্রাবাদ এলাকা পর্যন্ত ডুবে যায়। পানি আটকে গেলে ৫-৭ দিন ধরেই পানিবদ্ধতা কাটে না।  
আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকাসহ বন্দরনগরীর গুরুত্বপূর্ণ অংশের কার্যকর সুরক্ষায় স্থায়ী ও মজবুত চট্টগ্রাম শহর রক্ষা বাঁধ বা রিং-বাঁধ নির্মাণের জন্য অনতিবিলম্বে উদ্যোগ গ্রহণ করার বিষয়ে তাগিদ দিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এরজন্য সরকারের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ‘ফাস্ট ট্র্যাক’ পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন প্রয়োজন। অন্যথায় বন্দরনগরী চট্টগ্রামের ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনৈতিক কর্মকান্ড, শিল্পায়ন ও বিনিয়োগ সম্ভাবনা সঙ্কটের মুখে পড়বে। এ প্রসঙ্গে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন (আইইবি) চট্টগ্রামের সাবেক চেয়ারম্যান বিশিষ্ট নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক এম আলী আশরাফ বলেছেন, দেশের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক এলাকা হিসেবে আগ্রাবাদ ও আশপাশের ব্যাপক এলাকায় জোয়ার ও পানিবদ্ধতা সঙ্কটের একটা স্থায়ী সমাধান জরুরি। এরজন্য স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করে সমাধানের উপায় খুঁজতে হবে। স্থায়ী সমাধানের জন্য চট্টগ্রাম শহর রক্ষা বাঁধ মজবুত ও যথেষ্ট উঁচু করে নির্মাণ করতে হবে। তিনি বলেন, আগ্রাবাদ অঞ্চল পর্যন্ত জোয়ার ও পানিবদ্ধতার ভয়াবহ রূপ আগে তো দেখা যায়নি। এরজন্য আমরাও দায়ী। অপরিকল্পিত নগরায়ন, মহেশখালসহ সবক’টি খাল, নালা-নর্দমা, দখল ভরাট ও দূষণ ইত্যাদি কারণে দিনে দিনে সমস্যা তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, নগরীর গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক এলাকাকে যেমন জোয়ারের কবল থেকে সুরক্ষা করতে হবে। এর পাশাপাশি সুষ্ঠু পানি নিষ্কাশনের পথ বাধামুক্ত রাখতে হবে।  
এদিকে আগ্রবাদের পানিবদ্ধতা প্রসঙ্গে গত ১ জুন চট্টগ্রাম সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেছেন, পানিবদ্ধতা নিরসনে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা জাইকা’র অর্থায়নে ৪৫ কোটি ৮৩ লাখ টাকা ব্যয়ে আগ্রাবাদ এক্সেস রোডের উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এ প্রকল্পে এক্সেস রোড উঁচু করা হবে এবং নালা-নর্দমা সংস্কার করা হবে। অন্যদিকে বিতর্কিত ‘ফাঁদ’ মহেশখালের বাঁধ অপসারণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় গত বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও সিটি কর্পোরেশনের ত্রিপক্ষীয় সভায়। বন্দরের নিজস্ব তহবিল থেকে দেড় কোটি টাকারও বেশি ব্যয়ে বন্দর স্টেডিয়ামের পাশে মহেশখালের উপর ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে বাঁধটি নির্মিত হয়। এর উদ্দেশ্য আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকাসহ আশপাশকে জোয়ারের পানি থেকে রক্ষার কথা তখন বলা হলেও ভ্রান্ত পরিকল্পনার ফলে এ বাঁধটির কারণেই মহেশখালের উজান এবং ভাটি দু’দিকেই জোয়ারের পানি জমে থাকে। ভাটায়ও নামতে পারে না। সড়কের উপর দিয়ে নৌকা সাম্পান চলে। জনদুর্ভোগ বেড়ে চলে দিনের পর দিন। এর বিরুদ্ধে এলাকাবাসীর ক্ষোভ-বিক্ষোভের পর বাঁধ অপসারণের সিদ্ধান্ত হলো। চসিক বলেছে, সেখানে একটি সুইচ গেইট নির্মিত হবে।



 

Show all comments
  • Ashfaq Hossain ৭ জুন, ২০১৭, ১২:৪৯ এএম says : 0
    আগ্রাবাদ বা/ এ হচ্ছে চট্টগ্রাম এর গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসা-বাণিজ্যিক এলাকা। শত শত বছর পূবে এখানকার ব্যবসা বিকাশ লাভ করে। অথচ আজ জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে কেন আগ্রাবাদ সেটা সরকারকে সমাধান করতে হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • Md. Kamal Uddin Chy Arju ৭ জুন, ২০১৭, ৪:১৫ এএম says : 0
    SAVE CHITTAGONG CITY... SAVE AGRABAD. Agrabad na thakle Chittagong er gurutto & ostittto thakbe na
    Total Reply(0) Reply
  • Tutul Ahmed ৭ জুন, ২০১৭, ১:৩৮ পিএম says : 0
    Take immediate plan to remove waterlogged problem in Agrabad & adjacent area. Ring embankment is immediate solution.
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চট্টগ্রাম

৩০ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ