Inqilab Logo

রোববার, ১৬ জুন ২০২৪, ০২ আষাঢ় ১৪৩১, ০৯ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

অপ্রাসঙ্গিক থেমিস মূর্তি : ঘোলা পানিতে স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা

| প্রকাশের সময় : ৩১ মে, ২০১৭, ১২:০০ এএম


জামাল উদ্দিন বারী : হাজার বছরে এ দেশে যে বির্বতন সংঘটিত হয়েছে সেখানে হিন্দু-বৌদ্ধ ও মুসলমানের একটি ধারাবাহিক রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাস রয়েছে। প্রাগৈতিহাসিক বৈদিক যুগের সনাতন হিন্দু মিথলজি থেকে বৌদ্ধধর্মের উত্থান- পতন, ইসলাম ও মুসলমানদের আগমন, বিস্তৃতি এবং অষ্টাদশ শতকে ইংরেজের আগমন ও শাসনক্ষমতা দখল পর্যন্ত ইতিহাসের প্রতিটি স্তরেই রয়েছে বাহির থেকে চেপে বসা রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাস। খৃষ্টপূর্ব দেড়হাজার বছর আগে প্রাচীন পারস্য থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে আর্যদের আগমনের মধ্য দিয়ে ভারতের সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল খৃষ্টীয় সপ্তম শতকে আরবদেশ থেকে বাণিজ্য পোতের মাধ্যমে প্রথমে পীর-দরবেশ, ওলি আউলিয়াদের আগমন, অত:পর মুহম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়ের মধ্য দিয়ে ভারত এক নতুন মহাবিবর্তনের ধারায় পর্দাপণ করেছিল। এ উপমহাদেশের চার হাজার বছরের ইতিহাসে কখনো প্রাচীন-গ্রীক বা রোমান সাম্রাজ্যের প্রভাব এখানে কোন স্থায়ী আঁচড় বসাতে পারেনি। ইংরেজরা প্রায় ২ শতাব্দীর ঔপনিবেশিক শাসন চালানোর পাশাপাশি শত শত মিশনারী তৎপরতা চালিয়েও খৃষ্ট ধর্মীয় সংস্কৃতিকে এখানকার সমাজ মানসে প্রতিস্থাপিত করতে পারেনি। শত শত বছর ধরেই আমাদের এই ভ’-খন্ডে মাটি-জলে ফুল-ফলের ঐর্শ্বযের পাশাপাশি চরম দারিদ্র্য, অশিক্ষা ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সংখ্যাও কম ছিলনা। এই সুবিধা বঞ্চিত মানুষদের টার্গেট করে পশ্চিমা মিশনারীরা এখানে যে ধর্মান্তরকরণের স্বপ্ন দেখেছিল তার সাফল্য খুবই সামান্য। অথচ এর আগে মুসলমানদের আগমনের সাথে সাথেই সিন্ধু-গঙ্গা উপকুলে এক নতুন ধর্মীয় সাংস্কৃতিক বিপ্লব সংঘটিত হয়ে গিয়েছিল। সে ধর্মীয় সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ফসল আজকের বাংলাদেশ। তবে হাজার বছরে এখানে যে ধর্মীয়-সামাজিক-সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন ও সম্প্রীতির ইতিহাস গড়ে উঠেছে তা সমগ্র বিশ্বে অনুকরণীয়।
বাংলাদেশের হাইকোর্ট চত্বরের সামনে কথিত গ্রীক মূর্তি স্থাপন ও তা’ সরিয়ে নিয়ে সম্প্রসারিত হাইকোর্ট ভবনের সামনে প্রতিস্থাপনের ঘটনাবলী নিয়ে দেশের রাজনীতিতে যে নাটকীয়তা চলছে সে বিষয়ে আলোকপাত করতে গিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বিবর্তনের ইতিহাসকে কিছুটা রোমন্থন করতে হল। আমাদের জানা আছে, আরবে ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে খোদ কাবা ঘরের অন্দরেই তিনশতাধিক কল্পিত দেবদেবির মূর্তি ছিল। ইসলামের ধর্মীয় সংস্কৃতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মূর্র্তি পূজাকে নিরুৎসাহিত করা এবং সমূলে ধ্বংস করা। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, মূর্তি পূজা ও ভাস্কর্য শিল্প এক কথা কিনা। আমাদের পক্ষ থেকে এর জবাব, এক নয়। এ কারণেই শতকরা ৯৩ ভাগ মুসলমানের এই দেশের আনাচে কোনাচে অনেক ভাষ্কর্য শোভা পাচ্ছে। এসব ভাস্কর্যের সাথে জড়িত আছে আমাদের জাতীয় ইতিহাস, শিল্প-সাহিত্য ও ঐতিহাসিক ব্যক্তিবর্গ এবং আমাদের প্রাণ-প্রকৃতির ঐতিহ্য। এই রাজধানী শহর ঢাকার প্রধান প্রধান চত্বরগুলোতে শাপলা, দোয়েল, বলাকা, কদমফুল, মিশুক, ঘোড়ার গাড়ির ভাস্কর্যে সুশোভিত আছে। এ ছাড়া আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের অসংখ্য স্মারক স্তম্ভ ও ভাস্কর্য রয়েছে। এ দেশের সাধারণ মুসলমান ও আলেম ওলামারা নীতিগতভাবে ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপনের বিরোধি হলেও তারা কখনো এসব ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলার ফতোয়া দেয়নি বা সরকারের কাছেও দাবী জানায়নি। কয়েক বছর আগে ঢাকার হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরের প্রবেশপথে একটি স্টাচু স্থাপন করতে গিয়ে একশ্রেনীর ধর্মীয় গোষ্ঠির প্রতিবাদের মুখে তা’ প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছে সংশ্লিষ্টরা। এখন সুপ্রীম কোর্টের সামনে গ্রীক নারীমূর্তির নামে যা’ বসানো হয়েছে তা’ কথিত থেমিস মূর্তি নয়। থেমিস মূর্তিকে লেডি জাস্টিস নাম দিয়ে এর হাতে একটি নাঙা তলোয়ার এবং তুলাদন্ড ধরিয়ে দেয়া হয়েছে বটে, গ্রীক মূর্তি বা ভাস্কর্যের গায়ে যেমন গাউন বা ঢিলেঢালা আলখেল্লা পরানো থাকে, এখানে পরানো হয়েছে বাঙ্গালী নারীর শাড়ী। গ্রীক পৌরাণিক নারীমূর্তির গায়ে শাড়ীর বেঢপ অঙ্গাচ্ছাদন তেমন সৌকর্যমন্ডিত হয়নি। বিষয়টি খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই মিডিয়ায় তুলে ধরেছিলেন। সুপ্রীম কোর্টের মূল ভবনের খিলানের ওপর ন্যায়বিচারের প্রতিক হিসেবে দাড়িপাল্লার ছবি উৎকীর্ণ আছে। এটি সারাবিশ্বেই ন্যায়বিচারের প্রতিক হিসেবে স্বীকৃত। প্রধানমন্ত্রী কথিত থেমিস মূর্তিতে শাড়ী পরানো এবং কেন্দ্রীয় ঈদগাহের পাশে এ ধরনের মূর্তি বসানোর সিদ্ধান্তের বিপক্ষে নিজের নীতিগত ভিন্নমত তুলে ধরে প্রধান বিচারপতিকে তা সরিয়ে নেয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন বলেও মিডিয়ায় জানিয়েছিলেন।
 সুপ্রীম কোর্টের সামনে থেমিস মূর্তি স্থাপনের জন্য কেউ কখনো দাবী তুলেছে বলে আমাদের জানা নেই। আমরা জানি আমেরিকার গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতিক হিসেবে স্বীকৃত নিউ ইয়র্কের লিবার্টি আইল্যান্ডে স্থাপিত স্টাচু অব লিবার্টি ভাস্কর্যটি উনবিংশ শতকে ফ্রান্স সরকার আমেরিকাকে উপহার দিয়েছিল। আমাদের সুপ্রীম কোর্ট চত্বরে স্থাপিত থেমিস মূর্তি কেউ দান করেছে বলেও আমরা শুনিনি। থেমিস মূর্তি স্থাপনের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীও জানতেননা, তার সাথে কোন পরামর্শ না করেই তা সেখানে স্থাপন করা হয়েছিল বলে জানা যায়। এ থেকে কেউ কেউ হয়তো উচ্চ আদালতের স্বাধীনতার বিষয়টিকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইবেন। আমরাও একমত, তবে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চেতনা বিরোধি এ ধরনের বিতর্কিত সিদ্ধান্তের পেছনে প্রধান বিচারপতির অতি উৎসাহী ভ’মিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা কোন অর্থেই মঙ্গলজনক নয়। ধর্মীয় সহিষ্ণুতা এবং সম্প্রীতির কারনে এদেশের মানুষ আন্তর্জাতিকভাবেও মডারেট মুসলিম হিসেবে পরিচিত। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের সামনে এবং জাতীয় ঈদ গা’র পাশে একটি অপ্রয়োজনীয় বেঢপ নারীমূর্তি স্থাপনের মধ্য দিয়ে দেশের ধর্মপ্রান মুসলমানদের চেতনায় আঘাত করা হয়েছে, যা’ থেকে হেফাজতে ইসলামসহ কোন কোন ধর্মীয় গোষ্ঠি মূর্তি বিরোধি, ভাস্কর্য বিরোধি আন্দোলনে রূপ দিতে সচেষ্ট রয়েছে। ইসলাম এবং ইসলামি রাজনীতি পশ্চিমা দুনিয়ায় সব সময়ই মিস ইন্টারপ্রেটেড বা ভুল বুঝার শিকার হয়ে আসছে। এখন বাংলাদেশের সুপ্রীম কোর্টে কথিত থেমিস মূর্তি প্রতিস্থাপন নিয়ে যদি হাজার হাজার ধর্মপ্রান মানুষ রাস্তায় নামে সেটাও বর্হিবিশ্বে ভিন্ন রং চড়িয়ে প্রচারিত হবে। এ ধরনের প্রচারনা কখনো বাংলাদেশের জনগনের প্রত্যাশা ও সত্যিকারের মানস চেতনাকে প্রকাশ করেনা। এ দেশে যারা রাজনীতিবিদ, বিচারক বা পেশাজীবি তারা এ দেশের ধর্মপ্রান মানুষের চেতনা অনুধাবন করতে পারছেননা, এমনটা ভাবা যায়না। সুপ্রীম কোর্টে কথিত গ্রীক দেবি মূর্তি স্থাপন ও প্রতিস্থাপনের যে নাটকীয় বেহুদা কর্মকান্ড চলছে, এ যেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত চত্বরকে ইচ্ছাকৃতভাবেই বিতর্কিত করে তোলার বালখিল্য প্রয়াস। দেশে এখন সামাজিক অবক্ষয় চরম আকার ধারণ করেছে, বিচারহীনতার সংস্কৃতি রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করছে। পাবলিক সেক্টরের দুর্নীতি ও  সামাজিক অপরাধ প্রবণতা অতীতের যে কোন সময়ের মাত্রা অতিক্রম করে গেছে। দেশের নাগরিক সমাজ এসব বিষয়ে তাদের মতামত প্রকাশ করবে, প্রয়োজনে রাজপথে নামবে, এটাই প্রত্যাশিত। সে সব জনগুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ইস্যুকে পাশ কাটিয়ে দেশের মানুষকে পক্ষে-বিপক্ষে একটি উটকো মূর্তির পেছনে ছোটানো হচ্ছে।  
খৃষ্টপূর্ব ১৫শ শতক থেকে খৃষ্টীয় তৃতীয় শতকের মধ্যে প্রায় ২ হাজার বছর স্থায়ী গ্রীক সভ্যতা রোমানদের হাতে পরাভ’ত ও পদানত হওয়ার পর গ্রীক সংস্কৃতির সবকিছু মুছে ফেলাই ছিল রোমান সা¤্রাজ্যের অন্যতম রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক লক্ষ্য। এমনকি প্রাচীন অলিম্পিক গেমসও চিরতরে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। ঊনবিংশ শতকে আধুনিক বিশ্ব অলিম্পিক শুরুর মধ্য দিয়ে ইউরোপীয় শক্তিগুলো নিজেদের গ্রীক- সভ্যতা ও দর্শনের উত্তরাধিকারি হিসেবে দাবী করলেও গ্রীক মিথলজি কখনো মানুষের চেতনায় স্থান লাভ করতে পারেনি। দুইশ বছরের ইংরেজ শাসনের সময়ও বৃটিশরা আমাদের বিচারাঙ্গন বা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে গ্রীক-দেবদেবির মূর্তি বা ভাস্কর্য প্রতিষ্ঠা করেনি। বিংশত শতকের শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সময় যদি এখানে  গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিস বা অ্যারিস্ট্যাটলের ভার্স্কয স্থাপন করা হলে তা’ অস্বাভাবিক হতো না। তবে বৃটিশরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের বৈশিষ্ট্যকে সামনে রেখেই গড়ে তোলতে সচেষ্ট ছিল। যদিও আমাদের শাসকরা এ সেই লক্ষ্য অর্জনে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। মুসলিম বিশ্বের বাইরেও বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের স্বর্ণযুগের ইবনে খালদুন, ইবনে সিনা, আল রাজি, আল জাবিরের মত   দার্শনিকদের ভাস্কর্য স্থাপনের অনেক নজির আছে। যদিও যারা মূর্তির বিরোধিতা করেন তারা দেশি বিদেশি, জাতীয় বিজাতীয় কোন মূর্তিকেই সমর্থন করেননা।
সুপ্রীম কোর্ট চত্বরে কথিত গ্রীক নারীমূর্তি স্থাপনের মধ্য দিয়ে আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের সাড়ে চার দশক পরে বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা প্রথম প্রধান বিচারপতি হিসেবে অভিষিক্ত হয়েছেন যিনি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মীয় সম্প্রদায়ভুক্ত নন। তার হাত দিয়ে সুপ্রীম কোর্ট প্রাঙ্গনে গ্রীক দেবি মূর্তি স্থাপনের সিদ্ধান্ত এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছে একটি ভিন্ন সাম্প্রদায়িক মেসেজ তুলে দিয়েছে। দেশের সাধারণ মানুষ মনে করছে, বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বোধ ও বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নন। তিনি দেশের ধর্মীয় ও সেক্যুলার মৌলবাদিদের হাতে পরস্পর বিরোধ-বিস্বম্বাদের খড়গ তুলে দিয়েছেন, যা’ এখন প্রতিদিনের সংবাদ শিরোনাম হয়ে উঠছে। সুপ্রীম কোর্ট চত্বরে থেমিসের বিকৃত মূর্তি স্থাপনের পর থেকেই থিতিয়ে পড়া হেফাজতে ইসলাম আবার সক্রিয় হয়ে উঠতে দেখা যায়। এ সময়ে হেফাজতের সাথে আওয়ামি লীগের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য যোগাযোগ ও সমঝোতার বিষয়টিও নতুনভাবে উঠে আসে। গত এপ্রিলে কওমি মাদরাসা সনদের সরকারী স্বীকৃতি প্রদানের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা প্রদানকালে প্রধানমন্ত্রী সকাশে হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ নেতাদের উপস্থিতিতে অনেকেই বিষ্ময় প্রকাশ করেছেন। ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলাম ঘোষিত শাপলা চত্বরে অবস্থান কর্মসূচি ভন্ডুল করতে মধ্যরাতে যৌথ বাহিনীর অভিযানের পর সম্ভবত: এটিই ছিল হেফাজত নেতাদের সাথে সরকারের শীর্ষমহলের আনুষ্ঠানিক কোন বৈঠক। সেই অনুষ্ঠানেই প্রধানমন্ত্রী হাইকোর্ট চত্বরে কথিত গ্রীক দেবিমূর্তি বসানোর বিষয়ে বিষ্ময় প্রকাশ করে তা অপসারনে প্রধান বিচারপতির হস্তক্ষেপ কামনা করেন। অবশ্য তিনি মূর্তিটিকে জাতীয় ঈদগার কাছাকাছি স্থান থেকে সরিয়ে বা পর্দা দিয়ে ঢেকে দেয়ার মত বিকল্প প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। মহামান্য হাইকোর্ট তার সে সব প্রস্তাবকে গ্রাহ্য করেই এখন ভাস্কর্যটিকে এনেক্স ভবনের সামনে প্রতিস্থাপন করেছেন। তবে তাদের এ সিদ্ধান্ত যে মূর্তি বিষয়ক বিতর্কের আপাত সমাধান হচ্ছেনা গত কয়েক দিনে প্রকাশিত খবরাখবর থেকে তা’ অনেকটা স্পষ্ট হয়ে গেছে। চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামি আন্দোলন মূর্তি প্রতিস্থাপনের বিরুদ্ধে তাৎক্ষনিক প্রতিবাদ বিক্ষোভ করেছে। হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে তাদের নেতা আল্লামা আহমদ শফী সাহেব এক বিবৃতিতে গ্রিক দেবীর মূর্তি পুন:স্থাপনকে হতাশাজনক এবং জাতির বিশ্বাস ও আবেগের সাথে তামাশা বলে উল্লেখ করেছেন। তবে সবচে গুরুত্ববহ ইস্যু হচ্ছে আল্লামা আহমদ শফী তার বিবৃতিতে আমাদের আধুনিক রাষ্ট্র ধারনার সাথে থেমিসের ডিভাইন অর্ডার অব ল’ এবং তথাকথিত সেক্যুলার বামদের থেমিস মূর্তির জন্য অযৌক্তিক মায়াকান্নার চমৎকার বিশ্লেষন তুলে ধরেছেন। মূর্তি সামনে কি পিছনে সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হচ্ছে বাংলাদেশের ধর্মীয় ও জাতিগত বিশ্বাসের আঙিনায় দেশের কোথাও থেমিস মূর্তি প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারেনা। এটাই হেফাজতে ইসলামের দাবী। কেউ ধর্মপ্রান মুসলমান না হয়েও তাদের এ যুক্তির মানদন্ড অস্বীকার করতে পারবেনা। গত সপ্তাহে একটি মামলার শুনানীতে অংশ নিয়ে আদালতের পক্ষ থেকে দাবী করা হয়েছিল, দেশের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষের উচ্চ আদালতের প্রতি পূর্ণ আস্থা রয়েছে। গ্রীক দেবী থেমিসের মূর্তি স্থাপনের পর গণদাবীর মুখে তা সরিয়ে নেয়া, অত:পর সুপ্রীম কোর্টেরই ভেতরের আঙিনায় তা পুন:স্থাপনের চাতুর্যপূর্ণ ভ’ুমিকা সুপ্রীম কোর্টের প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসকেই যেন প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
হেফাজতে ইসলামের আমীর আল্লামা আহমদ শফী’র বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘থেমিস মূর্তি জনগনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্থাপিত হয়েছিল, তাকে বাংলাদেশের কোথাও স্থান দেয়া যাবেনা। থেমিস মূর্তি সুপ্রীম কোর্টের সামনে থাকবে নাকি পিছনে থাকবে এটা তাদের কোন ইস্যু ছিলনা। নামাজের সময় থেমিস কাপড়ে ঢেকে দেয়া হবে কিনা  এটাও ইস্যু ছিল না। ইস্যু ছিল থেমিস থাকবে কি থাকবেনা, এখানে মধ্যপন্থা নেয়ার কোন সুযোগ নেই। ইসলামে ইনসাফ বা ন্যায়ের ধারনা একটি মৌলিক ধারনা বা গুরুত্বপূর্ণ বিধান। এমনকি ইনসাফ কায়েম ছিল বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধেরও লক্ষ্য।  সেই ন্যায়ের বা ইনসাফের কোন প্রতিকায়ণ যদি গ্রীক ঐতিহ্য থেকে ধার করা হয়, তবে প্রকারান্তরে এটাই ধরে নেয়া হয় যে, আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্যে ও ধর্মে ন্যায়ের কোন ধারনা বা অবস্থান ছিলনা। এটা ঔপনিবেশিক ভাবাদর্শ। হেফাজতের আমীর আরো বলেছেন, আমরা আমাদের ঈমান ও আক্বীদার জমিনে দাড়িয়ে এই ঔপনিবেশিক ভাবাদর্শের বিরুদ্ধেই বলেছি। তাদের যুক্তিগুলোকে সেক্যুলার মিডিয়া বার বার উপেক্ষা করেছে বলেও তিনি অভিযোগ করেছেন। হেফাজতে ইসলামের বিবৃতিতে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ন ও অকাট্য যুক্তি ও প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে, যে সব আমলে নিলে যে কোন সাধারণ মানুষও বুঝবে বাংলাদেশের তথাকথিত সেক্যুলার ও প্রগতিশীলদের গ্রীক দেবী থেমিসের মূর্তির পক্ষে নামার কোন যৌক্তিক বা আদর্শিক কারণ নেই। দেশের মানুষ বাংলাদেশে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার অবসান দেখতে চায়। সেই সাথে হেফাজতে ইসলামের মত একটি শিথিল ধর্মীয় সামাজিক সংগঠনকে কোন ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতিতে যুক্ত দেখতে চায়না। গ্রীক দেবিমূর্তি সরিয়ে নেয়ার খবর শুনে এক শ্রেনীর বামপন্থী সংগঠনের কর্মীদের রাজপথে নেমে আসতে দেখা গেছে। মূর্তিটি সুপ্রীম কোর্টের এনেক্স ভবনের সামনে প্রতিস্থাপিত হওয়ার পর তারা বাড়ি ফিরে গেলেও একই ঘটনায় কয়েকটি ইসলামী সংগঠন প্রতিবাদে মধ্যরাতে রাজপথে নেমে এসেছে। তারা প্রেসক্লাবের সামনে ফুটপাতে রুটি-কলা খেয়ে পবিত্র রমজান মাসের প্রথম রাতের সেহেরি সেরেছেন। তাদের অনেককে পুলিশ আটক করে নিয়ে গেছে। এ থেকে ধরে নেয়া যায়, থেমিস মূর্তি নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা ও রাজনৈতিক উত্তাপ এক্ষুণি শেষ হচ্ছে না। এক শ্রেণীর মানুষ উত্তাপের ঘরপোড়া ও ঘোলাপানি থেকে স্বার্থ হাসিলের নতুন মওকার জন্য অপেক্ষা করছে। সুপ্রীম কোর্ট একটি স্বাধীন ও রাজনীতি নিরপেক্ষ এলাকা হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের যৌক্তিক প্রতিবাদ ও ভাবাবেগের মূল্য দেশের সরকার যেমন বিবেচনায় রাখতে বাধ্য, একইভাবে প্রধান বিচারপতিকেও এ বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্তে আসতে হবে। এরই মধ্যে দেশে একটি নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করেছে। হঠাৎ করে উড়ে আসা অপয়া টাইটানিক দেবী মূর্তি যেন দেশের রাজনৈতিক পরিবেশকে আর ঘোলাটে করে তুলতে না পারে সে দিকে সকলকেই সতর্ক থাকতে হবে।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মূর্তি

২৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬

আরও
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ