পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
ষ গ্যাস বিদ্যুৎ প্লট সঙ্কট : আসছে না বিনিয়োগ
ষ আনোয়ারা ও মিরসরাই অর্থনৈতিক জোন ঘিরে আশার ঝিলিক
শফিউল আলম : ভারী ও মাঝারি শিল্প-কারখানা নিয়ে কর্মচঞ্চল বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। এখানে দেশের প্রথম ইপিজেডসহ আছে বেশকটি শিল্পাঞ্চল। তবে আগের সেই ব্যাপক কর্মচাঞ্চল্য কমে এসেছে। অর্ধশতাধিক বছরের পুরনো বৃহদায়তন শিল্প প্রতিষ্ঠান কর্ণফুলী পেপার মিলস (কেপিএম) ক্রমেই অচলাবস্থার দিকে ধাবিত হচ্ছে। কর্ণফুলী রেয়ন মিলস (কেআরসি) আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। এককালে চাটগাঁবাসীর গর্ব চিটাগাং স্টিল মিলস বন্ধ ও ‘উচ্ছেদ’ হয় অনেক আগেই। চিটাগাং ইউরিয়া সার কারখানা (সিইউএফএল) কিছুদিন পর পর জোড়াতালি মেরামত-সংস্কার করা হলেও ঘন ঘন বিকল হয়ে পড়ছে। নগরীর কালুরঘাট, নাসিরাবাদ, পাহাড়তলী হয়ে সীতাকুন্ড পর্যন্ত বিশাল শিল্প এলাকায় দুই ডজনেরও বেশি পাটকল, বস্ত্রকল, কার্পেট মিলসহ ভারী কল-কারখানা সম্পূর্ণ অচল ও বন্ধ। এর বেশিরভাগই এখন মালামালের গুদাম ও গোচারণভূমিতে পরিণত হয়েছে। নামিদামি অনেক শিল্প-কারখানার জায়গায় নির্মিত হয়েছে এমএস রড তৈরির (স্টিলস রি-রোলিং) মিল। শিল্প কল কারখানার সূতিকাগার চাটগাঁয় আগের সুদিন নেই। একে একে শিল্পকারখানা রুগ্ন অসাড় হয়ে পড়ছে। এভাবে ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসছে চট্টগ্রামের শিল্প-কল, কারখানার বৃহৎ জগত। সমগ্র শিল্প খাতে বিরাজ করছে চরম বেহালদশা। অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান, কল-কারখানা রুগ্ন হয়ে পড়েছে। অথবা উৎপাদন চালু আছে আংশিক।
চট্টগ্রাম অঞ্চলের শিল্পখাতে দুর্দশার পেছনে প্রধান কারণ চাহিদার বিপরীতে গ্যাস, বিদ্যুতের ঘাটতি। এরপর দায়ী শিল্প-কারখানা স্থাপনের উপযোগী প্লট বা স্থান সঙ্কট। তদুপরি সর্বগ্রাসী চোরাচালানের ফলে মার খাচ্ছে দেশীয় শিল্পের উৎপাদন। বিভিন্ন কারণে উৎপাদন খরচও বেড়ে গেছে। এতে করে চট্টগ্রামকে বিনিয়োগের ‘আদর্শ স্থান’ বলা হলেও তেমন আসছে না নতুন কোনো বিনিয়োগ। গ্যাস বিদ্যুৎ সঙ্কটে অনেক শিল্প-প্রতিষ্ঠান নিরবচ্ছিন্ন সচল রাখা যাচ্ছে না। উৎপাদন থমকে গেছে। গুরুতর স্থবিরতা নেমে এসেছে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও। বাড়ছে বেকারত্ব ও ছদ্ম-বেকারত্বের হার।
চট্টগ্রামে শিল্প-কারখানা ও বিনিয়োগ সঙ্কুচিত হয়ে আসছে একথা উল্লেখ করে দেশের বনেদী প্রবীণ শিল্পপতি চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডষ্ট্রির সাবেক সভাপতি মীর্জা আবু মনসুর গতকাল শনিবার ইনকিলাবকে জানান, বিনিয়োগের জন্য যে উপযুক্ত পরিবেশ ও অবাকাঠামো দরকার এখন তা নেই। এরমধ্যে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে শিল্পের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। চট্টগ্রামে সবচেয়ে বড় সঙ্কট গ্যাসের। ৭-৮ বছর যাবত চট্টগ্রাম গ্যাসের ঘাটতিতে ভূগছে। ১০ বছর আগে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বিনিয়োগকারীরা মুখ ফিরিয়ে নেয়। এরমধ্যে অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারীও আসেনি। এতে করে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) হয়নি। তিনি বলেন, চট্টগ্রামকে ‘বাণিজ্যিক রাজধানী’ বলা হলেও এখানে অবকাঠামোর অভাব রয়েছে। কোনো বাণিজ্যিক ব্যাংকের একটি হেড অফিসও চট্টগ্রামে রাখা হয়নি। আমলাতান্ত্রিক জটিলতাও শিল্পায়নে বড় বাধা। সামান্যতম কারণেও ঢাকায় দৌঁড়াতে হয়। বিনিয়োগ ও শিল্পায়ন হয়ে গেছে ঢাকামুখিতা। যদিও ঢাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। অথচ তদানীন্তন পাকিস্তান আমলেও চট্টগ্রামে ‘ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংকে’র (পরে পূবালী ব্যাংক) হেড অফিস চট্টগ্রামে ছিল। ব্যাংক-বীমা, বিনিয়োগ-শিল্পায়ন সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর হেড অফিস চট্টগ্রামে স্থাপিত হলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আকৃষ্ট হতেন। যেহেতু প্রধান সমুদ্র বন্দর দিয়ে শিপমেন্ট সুবিধা থাকার কারণে চট্টগ্রামের মাধ্যমে আমদানি-রফতানি কার্যক্রম পরিচালনা করা সহজ। চেম্বার সভাপতি থাকাকালে (১৯৮৪-৮৬ইং) ব্যবসায়ী-শিল্পপতি ও চট্টগ্রামবাসীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে চা বোর্ডের হেড অফিস চট্টগ্রামে স্থাপনের বিষয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, তখন বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহকে জিএম পদবী দিয়ে কিছু ক্ষমতায়ন করা হয়। কিন্তু হেড অফিস আর আনা হয়নি। তাছাড়া চট্টগ্রাম থেকে বেশকিছু দেশীয় ও বহুজাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়ে গেছে। এখানে শিল্প স্থাপনে জায়গার অভাব রয়েছে।
মীর্জা আবু মনসুরের অভিমত চট্টগ্রামকে শিল্প-কারখানার সমৃদ্ধ ধারায় ঘুরে দাঁড়াতে হলে অন্তত ২-৩ টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের হেড অফিস চট্টগ্রামে রাখা, শিল্পায়ন-বিনিয়োগ-শিপিং সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে চট্টগ্রামে শুধু নয়; দেশের বিভাগীয় শহরগুলোতে বিকেন্দ্রীকরণ, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা অপরিহার্য। তিনি বলেছেন, আনোয়ারায় চায়না বিশেষায়িত শিল্প জোন ও অর্থনৈতিক জোন এবং মিরসরাইয়ে নির্মাণাধীন অর্থনৈতিক জোন দেরিতে হলেও শিল্প-কল-কারখানা স্থাপনে স্থান সঙ্কট নিরসনে সহায়ক হবে। এটি সরকারের অত্যন্ত সময়োপযোগী উদ্যোগ। তিনি বলেন, সেই সাথে নাজিরহাট-ফটিকছড়ি রেললাইন সম্প্রসারণ এবং রামগড়কে কেন্দ্র করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাথে বাণিজ্যিক যোগাযোগ বৃদ্ধির পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে। তাতে উত্তর ফটিকছড়িতে একটি অর্থনৈতিক জোন স্থাপন করা হলে বাংলাদেশের পণ্যসামগ্রী ত্রিপুরা রাজ্যসহ উত্তর-পূর্ব ভারতে রফতানি দ্বার খুলে যাবে।
এদিকে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরকে কেন্দ্র করেই এ অঞ্চলে কালক্রমে শিল্প-কল-কারখানা বিকাশ লাভ করে। এককালে দেশের বনেদী শিল্পপতিরা প্রত্যেকেই এক বা একাধিক শিল্প-প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন চট্টগ্রামেই। দেশের প্রথম ও প্রধান রফতানি শিল্প প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল ইপিজেডের জন্মস্থান চট্টগ্রামেই। এর আগে অসংখ্য বৃহদায়তন শিল্প, কল-কারখানা স্থাপিত হয় এ অঞ্চলে। এরমধ্যে পাট ও পাটজাত দ্রব্যের ভারী শিল্প-কারখানা, কার্পেট মিল, বস্ত্র ও সূতার মিল, রেয়ন মিল, কাগজ কল, সার ও রাসায়নিক খাত, চামড়া, শিপব্রেকিং, স্টিল ও আয়রন শিল্প, জ্বালানি তেল পরিশোধন, গ্যাস প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা, জাহাজ নির্মাণ ও মেরামত শিল্প, চা শিল্প উল্লেখযোগ্য। এছাড়া হরেক ধরনের নিত্য ও ভোগ্যপণ্য তৈরি, রফতানিমুখী শিল্প-কারখানা। শত বছর আগে চট্টগ্রামে বেকারী শিল্পে তৈরি ‘বেলা বিস্কুট’ ব্রিটিশ ও জাপান সেনাবাহিনীর পছন্দের খাদ্যপণ্য হিসেবে ব্যাপকভাবে রফতানি হতো। আজও তা বনেদী চট্টগ্রামের নাম বহন করছে।
চট্টগ্রামে শিল্প কল-কারখানা হারাচ্ছে ব্যস্ততা। শত শত ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান কাঁচামাল এবং উৎপাদিত পণ্য পরিবহনের জন্য কারখানার সামনে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় না। বনেদী শিল্পপতির সংখ্যাও কমে এসেছে। বৃহৎ শিল্পের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। অনেক কারখানা বিভিন্ন মালামালের গুদাম ও আড়ত হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কারখানার জায়গায় ফ্ল্যাট, এপার্টমেন্ট গড়ে উঠছে। কল-কারখানা অচল হয়ে পড়ছে চোরাপথে আসা পণ্যের দামের সাথে উৎপাদন খরচে টিকতে না পেরে। শিল্পপতিরা ‘ট্রেডিং’ ব্যবসায় ঝুঁকছেন। অনেকে রাজধানী ঢাকায় পাড়ি জমিয়েছেন। নিদেন পক্ষে তারা চট্টগ্রামে হেড অফিসের বদলে একটি লিয়াজোঁ অফিস চালু রেখে কোনোমতে কাজকর্ম জিইয়ে রাখতে চান। সপ্তাহান্তে কিংবা দুয়েকদিন পর পর ফ্লাইটে আসছেন চট্টগ্রামে। এ অবস্থায় বড় বড় শিল্পাঞ্চলে বিরাজ করছে সুনসান নীরবতা।
এ কে খান শিল্পগোষ্ঠি, ইস্পাহানি শিল্পগোষ্ঠি, মীর্জ্জাবু এন্ড কোং, ইব্রাহিম মিঞার মতো বনেদী শিল্প পরিবারের উত্থান হয়নি চট্টগ্রামে। ঐতিহ্যবাহী এসব শিল্পপতি পরিবার চট্টগ্রামের উন্নয়নেও নিজস্ব উদ্যোগে যথেষ্ট অবদান রাখেন। পাশাপাশি জনহিতকর কর্মকান্ড, খেলাধূলা ও সামাজিক কাজে তাদের অবদান অবিস্মরণীয়। চট্টগ্রাম অঞ্চলে পর্যটন শিল্পখাত, শিপিং খাত, গভীর সমুদ্রে ট্রলার শিল্পখাতগুলো বিকাশ লাভ করেছে প্রধানত বেসরকারি উদ্যোক্তাদের হাত ধরেই। এমনকি চট্টগ্রাম বন্দরে গোড়ার দিকে বেসরকারি জেটি-বার্থ দিয়ে কার্যক্রম সচল হয়।
এদিকে চট্টগ্রামে শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠায় স্থান সঙ্কট সবচেয়ে প্রকট। চট্টগ্রাম ইপিজেডে নতুন শিল্প স্থাপনের খালি জায়গা নেই। কর্ণফুলী ইপিজেডেও একই দশা। বিনিয়োগ ও শিল্প স্থাপনে এটি বড় বাধা। এ কারণে সা¤প্রতিক সময়ে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এবং স্থানীয় শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের একক কিংবা যৌথ বিনিয়োগে শিল্প স্থাপনের উদ্যোগ বিফল হয়েছে। তবে অবশেষে চট্টগ্রাম অঞ্চলে শিল্প-কারখানা স্থাপনে আশার ঝিলিক দেখা দিয়েছে মিরসরাইয়ে বেজা’র উদ্যোগে নির্মাণাধীন সুবিশাল অর্থনৈতিক জোন এবং আনোয়ারায় চায়না ইকনোমিক জোন এবং বিশেষায়িত শিল্পজোনকে ঘিরে। আনোয়ারায় চায়না অর্থনৈতিক জোন উদ্বোধন করা হয় গত বছরের অক্টোবরে। তাছাড়া সাগর উপকূল বন্দর সুবিধা সামনে রেখে আনোয়ারার গহিরা এলাকায় বিশেষ অর্থনৈতিক জোন স্থাপনের জন্য ৭৭৪ একর জমির অনুমোদন দিয়েছে একনেক। সেখানে শিল্প-কারখানা স্থাপিত হলে ৫৩ হাজার ৪২০ জনের কর্মসংস্থান হবে বলে আশাবাদী কর্তৃপক্ষ। আর মিরসরাইয়ের চরে ১৮ হাজার একর জমিতে নির্মাণাধীন পূর্ণাঙ্গ অর্থনৈতিক জোন বিস্তৃত হবে ফেনীর সোনাগাজী পর্যন্ত। সেখানে বড়সড় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের আগ্রহ ব্যক্ত করেছে চীন। তবে চট্টগ্রাম বন্দর সংলগ্ন কর্ণফুলীর দক্ষিণ তীরে দেয়াং পাহাড়ের কোলে কোরীয় প্রতিষ্ঠান ইয়াংওয়ান কর্পোরেশনের বিনিয়োগে স্থাপিত কোরিয়ান ইপিজেড (কেইপিজেড) এখনও পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়নি। সেখানে শতভাগ রফতানিমুখী দু’টি কারখানা চালু আছে। কেইপিজেডে ভূমির আয়তন ২৫ হাজার ৮৪ একর। শুধুই জমির নামজারি শেষ না হওয়ায় দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে এ শিল্পাঞ্চল স্থবির প্রায়। এটি বিনিয়োগে শুভ বার্তা দিচ্ছে না।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।