পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
রাজধানীর বনশ্রীতে দুই শিশু সন্তানের লেখাপড়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে মা তাদের একাই হত্যা করেছেন, র্যাবের এমন দাবি অনেকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। একজন উচ্চশিক্ষিত মা, যিনি কলেজে শিক্ষকতাও করেছেন, এ কাজ করতে পারেন তা অবিশ্বাস্য ঠেকছে। দ্বিধা ও সংশয়ের মধ্য দিয়ে অনেকেই বলছেন, এটাও কী সম্ভব! অকল্পনীয় হলেও র্যাব যেভাবে টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে মায়ের স্বীকারোক্তির কথা উল্লেখ করে ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছে, তাতে মানুষ চরম বিভ্রান্তিতে পড়ে গেছে। এর ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া যে মানুষের মনোজগতে পড়ছে, তাতে সন্দেহ নেই। কারণ, পৃথিবীতে সন্তানের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় মা, যিনি নিজের জীবন বিপন্ন করে সন্তানকে আগলে রাখেন। সেই মা-ই যদি হন্তারক হন, তাহলে কারো পক্ষেই সন্তানকে নিরাপদ রাখা সম্ভব নয়। তবে র্যাবের ঘটা করে সংবাদ সম্মেলনে এ ঘটনার বিবরণ দেয়াকে উচিত হয়নি বলে অনেকে মনে করছেন। তাদের মতে, অভিযুক্ত যদি সত্যিকার অর্থে অপরাধী হয়েও থাকেন, তবুও পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শেষ হওয়ার আগে তার স্বীকার-অস্বীকারমূলক কোনো বক্তব্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক প্রকাশ করা উচিত নয়। বিশিষ্ট আইনবিদ শাহদীন মালিক বলেছেন, মামলা হওয়ার আগেই দুই শিশুর বাবা, মা ও খালাকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ এবং সংবাদ সম্মেলন ডেকে স্বীকারোক্তির কথা প্রচার করা আইনগত ব্যবস্থার সাথে সাযুজ্যপূর্ণ নয়। তিনি বলেছেন, মামলা হওয়ার আগে এসব কার্যক্রম ফৌজদারি কার্যবিধি ও অভিযুক্ত ব্যক্তির সাংবিধানিক অধিকারের পরিপন্থী। অভিযুক্ত মা র্যাব বা পুলিশের সামনে যা বলেছেন, তার আইনগত কোনো মূল্যও নেই। কথাগুলো ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে বললে তার আইনগত ভিত্তি থাকত। আমাদের কথা হচ্ছে, স্পর্শকাতর ঘটনা, যা সাধারণ মানুষের কাছে অবিশ্বাস্য ও অকল্পনীয় ঠেকে এবং মানসিক চাপ সৃষ্টি করে, আগেভাগেই প্রকাশ করা সুবিবেচনার কাজ হতে পারে না।
পূর্ণাঙ্গ তদন্ত এবং তদন্ত রিপোর্ট জমা দেয়ার আগেই কোনো চাঞ্চল্যকর হত্যাকা- বা ঘটনার পর অভিযুক্ত ব্যক্তি ও অভিযুক্তদের গ্রেফতার করে সরাসরি মিডিয়ার সামনে হাজির করে দায়ী সাব্যস্ত করার এক ধরনের প্রবণতা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে বেশ প্রকট হয়ে উঠেছে। এর মাধ্যমে বিচারের আগেই আসামীর এক প্রকার বিচার সম্পন্ন হয়ে যায়। অথচ বিচার কাজ একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। তথ্য-প্রমাণ, সাক্ষী-সাবুদের মাধ্যমে নি¤œ আদালত থেকে উচ্চ আদালত পর্যন্ত একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয়। এর মাধ্যমে একজন অভিযুক্ত আসামী শাস্তিও পেতে পারেন, আবার খালাসও পেতে পারেন। শাস্তির হেরফেরের সুবিধাও পেতে পারেন। আমরা লক্ষ্য করছি, অভিযুক্তকে গ্রেফতারের পরপরই মিডিয়ার সামনে হাজির করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অনেকটা ক্রেডিট নেয়ার জন্য আসামী স্বীকার করেছে বা সে দায়ী এমন কথা গড়গড় করে বলে এক প্রকার রায় দিয়ে দিচ্ছে। এটা যে আইনের ব্যত্যয়, তা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী আমলে নিচ্ছে না। সংবিধানেই বলা আছে, সঠিক বিচারের স্বার্থে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আগে তার আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ দিতে হবে। সংবিধানের এ বিষয়টি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অনেক ক্ষেত্রেই মানছে না। দুই শিশু সন্তানের হত্যাকারী হিসেবে অভিযুক্ত মায়ের ক্ষেত্রে যে মানা হয়নি, তা স্পষ্টতই বোঝা গেছে। এমন অনেক নজির আমরা দেখেছি, অভিযুক্ত আসামী ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েও তা প্রত্যাহার চেয়ে আবেদন করেছে। এসব ক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী জোর করে স্বীকারোক্তি আদায় করেছে বলে অভিযুক্তকে আভিযোগ করতে দেখা গেছে। কাজেই, কোনো অভিযুক্তকে গ্রেফতারের পরপরই মিডিয়ার সামনে হাজির করে অভিযোগও স্বীকার করেছে বলে ঘোষণা দেয়া বা স্বীকারোক্তি দেয়ার ঘটনা প্রচার করা অনূচিত, অসঙ্গত ও বেআইনী। শিশু সন্তান হত্যার অভিযোগে গ্রেফতারকৃত মায়ের স্বীকারোক্তি উল্লেখ করে র্যাব যে বক্তব্য দিয়েছে, যদি তা তদন্তকালীন ঘটনা পরম্পরায় পুরোপুরি সত্য না হয়, তবে কি এ ঘোষণা দায়িত্বহীন বলে চিহ্নিত হবে না? আমরা মনে করি, বিষয়টি অনুপংখভাবে খতিয়ে দেখা হবে। র্যাবের তরফে যা বলা হয়েছে তা সঠিক না হলে, সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। আর অবিশ্বাস্য হলেও, তা যদি সত্য হয়, তাহলে বলতে হবে আমাদের পরিবার ও সমাজে মানবিকতা ও মূল্যবোধের ভয়ংকর অবক্ষয়ের এটি একটি নজির। বহুদিন ধরেই আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের বিষয় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে। এ মূল্যবোধ কিভাবে সংরক্ষণ ও ধরে রাখা যায়, এ নিয়ে কার্যকর কোনো উদ্যোগ আমরা রাষ্ট্রীয় পর্যায় তো বটেই সামাজিক পর্যায়েও দেখছি না। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকেও এলাকাভিত্তিক সচেতনতামূলক কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায় না। উদ্যোগহীন এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে সামনে হয়তো আরও অকল্পনীয়-অবিশ্বাস্য ঘটনার মুখোমুখী হতে হবে আমাদের।
মা কর্তৃক সন্তান হত্যার মতো নির্বাক করা অভিযোগ আর কখনো উঠবে না, এমন প্রত্যাশা আমরা মনে প্রাণে করি। এ ব্যাপারে আমাদের অভিভাবকদের সবসময় সচেতন থাকা অপরিহার্য। এটাও মনে রাখা দরকার, অভিভাবকদের অবহেলা বা উদাসীনতায় সন্তান যাতে বিপদগামী বা উচ্ছৃঙ্খল না হয়ে উঠে এবং তারাও যাতে পিতা-মাতার হন্তারক মানসিকতার দিকে ধাবিত না হয়, এ ব্যাপারে সচেষ্ট থাকতে হবে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে যে কোনো ঘটনায় অভিযুক্ত গ্রেফতার হলেই ঘটা করে তাকে মিডিয়ার সামনে হাজির করে বক্তব্য দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। ক্রেডিট নেয়ার চেয়ে এর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার দিকটি বিবেচনা করতে হবে। চূড়ান্ত বিচারের আগে অভিযুক্তর আইনী অধিকারের ব্যত্যয় ও সম্মানহানি হচ্ছে কিনা এবং এর প্রতিক্রিয়া সমাজে কী হতে পারে, বিষয়টি বোধ-বুদ্ধি দিয়ে বিচার করতে হবে। আমরা আশা করব, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সার্বিক দিক বিবেচনা করে সঠিক দিকনির্দেশনার মাধ্যমে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মিডিয়া ট্রায়ালের এ প্রবণতা রোধে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।