পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
পর্যাপ্ত ত্রাণ এখনও পায়নি ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা : হাওর এলাকাকে দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবি : দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের
উমর ফারুক আলহাদী : চিরচেনা হাওর এলাকা এখন যেন এক অচেনা জগৎ। সরকারের হাওর মহাপরিকল্পনার হিসাবে দেশের মোট ধানের ১৮ শতাংশ এবং উন্মুক্ত উৎসের মাছের ২৮ শতাংশ আসে হাওর থেকে। দেশের জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে (জিডিপি) হাওরের অবদান ৬ শতাংশ। সেই হাওর বিধ্বস্ত বিরানভূমি। সবকিছু হারিয়ে বিপর্যয়কর অবস্থার মুখে পড়েছে কয়েক লাখ আদমসন্তান। সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনার হাওরাঞ্চলের সর্বত্রই চলছে হাহাকার। ঘরে ঘরে চাপা কান্না। উজানে ভারত থেকে আসা বানের পানিতে সারা বছরের শ্রমের ফসল হারিয়ে লাখো কৃষক পরিবার দিশেহারা। সারা বছরের জীবিকার একমাত্র অবলম্বন ফসল হারিয়ে দেখছেন শুধুই অন্ধকার আর অন্ধকার। একের পর এক বাঁধ ভেঙে পানি এসে ঘরবাড়ি, জমির ধান ভাসিয়ে দিচ্ছে; আর ভেঙে যাচ্ছে কৃষকের হৃদয়। নিত্যদিন ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও বেড়েই চলায় বিপন্ন মানুষের আহাজারি থামছেই না। ইতোমধ্যেই ৩ লাখ ৩০ হাজার পরিবারের ২ লাখ হেক্টর জমির ফসল গেছে। ৬ উপজেলার ৫৫টি ইউনিয়নের ১৮ হাজার ২০৫টি ঘরবাড়ি হয়েছে বিধ্বস্ত। মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাবে পানি দূষণে ৪১ কোটি টাকার ১ হাজার ২৭৬ টন মাছ মারা গেছে। হাঁস মারা গেছে ৩ হাজার ৮৪৪টি। এগুলো কেতাবের হিসাব। বাস্তবে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ। আর্থিকভাবে এ ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত দিয়েছেন। তারা হাওরের বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর দাবি তুলেছেন।
প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকার হাওরের ধান পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। সুনামগঞ্জ জেলার শনির হাওর এবং মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওরের পর গতকাল সুনামগঞ্জের শেষ সম্বল জামালগঞ্জ উপজেলার উড়ার বন বাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেছে পাকনার হাওরের সাড়ে ৯ হাজার হেক্টর বোরো ফসল। এলাকাবাসী অনেক চেষ্টা করেছে বাঁধ রক্ষার। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। গতকাল সকাল ৬টার দিকে কৃষকের শ্রম আর ঘামকে উপেক্ষা করে বাঁধটি ভেঙে যায়। এলাকাবাসী বলছেন, হাওরের মানুষ এখন ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেন। তাদের ধান পানির নিচে, মরছে হাওরের মাছ, খামারের হাঁস-গবাদিপশুও বিক্রি করতে পারছেন না। মানুষের পাশাপাশি গো-খাবারেরও চরম সংকট দেখা দিয়েছে। গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবে হাওর অঞ্চলকে জাতীয় দুর্যোগপূর্ণ এলাকা ঘোষণা করার দাবি জানিয়েছেন মানবাধিকার নেতা সুলতানা কামাল। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের রক্ষায় দ্রæত রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ নেয়ার দাবিও জানিয়েছেন তিনি। ‘হাওরে মহাবিপর্যয় উদ্বিগ্ন নাগরিকবৃন্দ’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে সুলতানা কামাল এ কথা বলেন। সুলতানা কামাল বলেন, হাওরে ২৪ লাখ কৃষক বোরো ধানের ওপর নির্ভরশীল। তাদের সব ধান তলিয়ে গেছে। দেশের অনেক মাছ নষ্ট হয়ে গেছে। তাদের সবার জন্য সহযোগিতা দরকার।
দেশের বিশিষ্টজনেরা মনে করছেন, হাওরাঞ্চলে ফসলহানি অর্থনীতির বড় ক্ষতি। এতে করে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষতির আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এর প্রভাব পড়বে সারা দেশেই। গতকাল পর্যন্ত এর আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে বলে জানা গেছে। বন্যায় নষ্ট হওয়া ১০ লাখ টন চাল, ২ হাজার মেট্রিক টন মাছ ও ১১ হাজার ৩০৫ টন গো-খাদ্যের বাজারমূল্য ধরে এই হিসাব বের করেছে হাওর অ্যাডভোকেসি প্ল্যাটফর্ম। হাওর নিয়ে কাজ করা ৩৫টি আন্তর্জাতিক ও দেশীয় সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত ওই সংগঠনটি বলছে, মূলত সরকারি উৎস থেকে নেয়া তথ্য নিয়ে তারা এই হিসাব তৈরি করেছে। তবে স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলে তারা যে তথ্য পেয়েছে, তাতে মোট ক্ষতির পরিমাণ ১০ হাজার কোটি টাকা ছুঁয়ে যাবে। এতে সন্দেহ নেই কারও এমনটি মনে করছেন সংশ্লিষ্ট সংস্থার কর্মকর্তারা। অন্যদিকে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ক্ষয়ক্ষতির যে হিসাব তৈরি করা হয়েছে, তাতে ৩ লাখ ৩০ হাজার পরিবারের ২ লাখ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। ৬টি উপজেলার ৫৫টি ইউনিয়নের ১৮ হাজার ২০৫টি ঘরবাড়ি পরিপূর্ণ ও আংশিকভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে। তবে মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সৈয়দ আরিফ আজাদ বলেন, হাওরের পানি দূষণে প্রায় ৪১ কোটি টাকার ১ হাজার ২৭৬ টন মাছ মারা গেছে বলে জানিয়েছে পানি সম্পদ অধিদপ্তর। এছাড়া মারা গেছে ৩ হাজার ৮৪৪টি হাঁস। পানিতে অক্সিজেন একেবারেই কমে যাওয়ায় এবং অ্যামোনিয়া ও অ্যাসিডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণে মাছ মারা গেছে। গতকাল সোমবার মৎস্য অধিদপ্তর হাওরের পরিস্থিতি নিয়ে পাঠানো প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানিয়েছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।
হাওরের উন্নয়ন ও গবেষণা নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলো বলছে, এই ক্ষতির প্রভাব পড়বে জাতীয় অর্থনীতির ওপর। সরকারের হাওর মহাপরিকল্পনার হিসাবে দেশের মোট ধানের ১৮ শতাংশ এবং উন্মুক্ত উৎসের মাছের ২৮ শতাংশ আসে হাওর থেকে। দেশের জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে (জিডিপি) হাওরের অবদান ৬ শতাংশ।
আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা কেয়ার, অ্যাকশনএইড, অক্সফাম কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড, ওয়াটারএইড, সেন্টার ফর ন্যাচারাল রিসোর্স স্টাডিজসহ (সিএনআরএর) ৩৫টি সংস্থা মিলে এই প্ল্যাটফর্ম গঠিত। সংগঠনগুলো হাওরকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা করার দাবি জানিয়ে বলছে, সর্বাধিক জাতীয় গুরুত্ব দিয়ে হাওরের সংকট মোকাবিলায় সরকারের এগিয়ে আসা উচিত।
এদিকে জামালগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শামছুল ইসলাম তালুকদার ছুনা মিয়া জানান, গতকাল ২৫ দিন ধরে পাগনার হওরের বাঁধটি টিকিয়ে রাখার জন্য কৃষকরা প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। অবশেষে কৃষক-জনতার শ্রম আর ঘামকে উপেক্ষা করে সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে সকালে বাঁধটি ভেঙে যায়।
স্থানীয়রা বলছেন, কৃষকরা সব হারিয়ে এখন দিশেহারা। নেই সরকারি পর্যাপ্ত ত্রাণ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কঠোর নির্দেশনার পরেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং জেলা উপজেলা কর্মকর্তারা এ ব্যাপারে তেমন একটা তৎপর নেই বলে অভিযোগ করেছেন এলাকাবাসী। তাঁরা বলছেন, কোনো কোনো এলাকায় ত্রাণ বিতরণ কিছুটা শুরু হলেও তা খুবেই ধীরগতিতে চলছে।
গতকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অকাল বন্যায় ফসল হারানো হাওর অঞ্চলে পর্যাপ্ত ত্রাণ পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী এই নির্দেশনা দেন বলে জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব শফিউল আলম। তিনি জানান, ত্রাণ পাঠানোর পাশাপাশি বিতরণেও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বলেছেন, ত্রাণ বিতরণে যারা গাফিলতি করবে তাদেরকেও ছাড় দেয়া হবে না। তিনি জানান প্রধানমন্ত্রীর কড়া নির্দেশ রয়েছে একজন মানুষও যেন না খেয়ে কষ্ট না পায়।
এদিকে হবিগঞ্জে টানা বৃষ্টিপাতের ফলে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বড় বড় হাওরের ফসল নষ্ট হয়েছে। গতকালও কয়েকটি হাওরের ধান পানির নিচে তলিয়ে গেছে। হবিগঞ্জ কৃষি বিভাগের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে হবিগঞ্জের ৪৫ হাজার ২৬৫ হেক্টর জমির ধান নষ্ট হয়ে গেছে। তবে স্থানীয় সূত্র দাবি করছে, প্রায় ৭৫ হাজার হেক্টর জমি তলিয়ে গেছে। কৃষকরা তলিয়ে যাওয়া জমিগুলোর কিছু পাকা ও আধা পাকা ধান কেটে এনেছিলেন। কিন্তু টানা বৃষ্টির জন্য সেগুলো খলার মধ্যে আঁটি বাধা অবস্থায় পচন ধরেছে। রোদ না থাকায় সেগুলো শুকানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে কৃষকরা এখন হাহাকার করছেন। দিশেহারা হয়ে পড়ছেন অনেকে। নিজদের খাদ্য সংকট ও হালের বলদের খাদ্য সংকটে কৃষকরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। আবার অনেকে মহাজনের ঋণ পরিশোধ কীভাবে করবেন তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।
তাহিরপুর রতনশ্রী গ্রামের আকমল হোসেন বলেন, আমরা এখন সব হারিয়ে পথের ভিখারি। ঘরে খানা নাই। সরকারি ত্রাণও এখন পর্যন্ত পাইনি। কীভাবে বাঁচব, দু চোখে শুধু অন্ধকার দেখছি। একই গ্রামের বাসিন্দা নজরুল বলেন, ডিলারের সংখ্যা আরও বাড়িয়ে ইউনিয়নের প্রতিটি ওয়ার্ডে চাল ও আটা বিক্রির উদ্যোগ নিলে সবাই খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আসত।
সাহেবনগর গ্রামের আকিক মিয়া বলেন, হাওর এলাকার মানুষ বছরের ৬ মাস কর্মহীন থাকে। তার উপর এবার ফসল তলিয়ে যাওয়ায় বিকল্প কাজের খোঁজে অনেকেই রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরগুলোতে যাওয়া শুরু করেছে।
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. হারুন অর রশীদ বলেন, সরকার এখনো তৃণমূল পর্যায়ে ত্রাণ কার্যক্রম শুরু করেনি। ফসল হানির ঘটনায় জেলার হতদরিদ্র মানুষ সবচেয়ে বেশি অসুবিধায় পড়েছে। তাদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য তৃণমূল থেকে ত্রাণকার্যক্রম শুরু করা জরুরি প্রয়োজন। এছাড়া কৃষকদের কৃষি ঋণ ও এনজিও ঋণের কিস্তি মওকুফ করতে হবে। তাদের সহযোগিতায় সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহŸান জানিয়ে তিনি বলেন, আগামী বোরো মৌসুমে কৃষকদের সহজ শর্তে কৃষিঋণ ও উপকরণ সহযোগিতা দিতে হবে। তাহলে কৃষকরা তাদের কিছুটা ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবেন।
ত্রাণের পরিধি ও পরিমাণ আরও বাড়ানো হবে জানিয়ে জেলা প্রশাসক শেখ রফিকুল ইসলাম বলেন, উপজেলা পর্যায়ে এখন ৩ টন চাল ও ৩ টন আটা খোলা বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। এখানকার লোকজনের মধ্যে আটার চাহিদা না থাকায় আটা বাদ দেয়ার কথা বলা হয়েছে। আটার পরিবর্তে চাল দেয়ার কথা বলা হয়েছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে খোলা বাজারে চাল বিক্রির কথাও বলা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য মন্ত্রণালয় থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার ভিজিএফ কার্ড বরাদ্দ করা হয়েছে। তালিকায় থাকা ক্ষতিগ্রস্তরা প্রতিমাসে ৩০ কেজি চাল ও ৫০০ করে টাকা পাবে। এটি তিনমাস চলবে। এছাড়াও বিশেষ খাদ্য বান্ধব কর্মসূচির আওতা বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে। এগুলো তিনগুণ করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। যাতে আগামী বোরো মৌসুম পর্যন্ত চালানোর কথা বলা হয়েছে। মেডিক্যাল টিম গঠন করা হয়েছে। জেলেদেরও ভিজিএফ-এর আওতায় নিয়ে আসা হবে। ১১টি উপজেলা সদরে সীমিত আকারে খোলাবাজারে চাল ও আটা বিক্রি করা হচ্ছে। যে কারণে গ্রামের সিংহভাগ জনগোষ্ঠী ত্রাণ সহযোগিতার বাইরে রয়েছেন। অন্যদিকে উপজেলা সদরে থেকে চাল ও আটা কিনতে আসা অনেকেই সারাদিন লাইনে দাঁড়িয়ে কষ্ট করার পর খালি হাতে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন।
একই অবস্থার শিকার বদরপুর গ্রামের আমির আলী বলেন, ‘সর্বশেষ সম্বল হালের বলদও গো খাদ্যের অভাবে অনেক আগেই বিক্রি করে দিয়েছি। সরকার বলছে কাউরে না খেয়ে মরতে দেবে না। কিন্তু সময়মত চাল না পেলে তো বাঁচার আশা দেখি না।’
ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা হয়েছে উল্লেখ করে জেলা প্রশাসক শেখ রফিকুল ইসলাম বলেন, এই মুহূর্তে জেলায় কোনও খাদ্য সংকট নেই। কাজেই সুষ্ঠুভাবে ত্রাণ বণ্টনের জন্য সবার সহযোগিতা কামনা করেছি।
এদিকে নতুন করে সুনামগঞ্জের শনির হাওরে বাঁধ ভেঙে ২২ হাজার হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কত দাঁড়াবে, তা এখনো নিশ্চিত করে বলতে পারছে না কেউ। তবে সব হারানোর কষ্ট আর ঘরবাড়ি হারানোর দুর্ভোগ অনেক দিন হাওরবাসীকে ভোগাবে বলে স্থানীয়রা মনে করছেন।
সরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে হাওর অ্যাডভোকেসি প্ল্যাটফর্মের ক্ষয়ক্ষতির হিসাবে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। গতকাল ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে হাওর পরিস্থিতি নিয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে কৃষি সচিব মোহাম্মদ মঈনউদ্দিন আবদুল্লাহ জানান, চালের হিসাবে মোট ক্ষতির পরিমাণ ৬ লাখ টন। আর মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, মাছের ক্ষতি ১ হাজার ২৭৫ টন এবং হাঁস মারা গেছে ৩ হাজার ৮৪০টি।
এ ব্যাপারে হাওর অ্যাডভোকেসি প্ল্যাটফর্মের সদস্যসচিব আনিসুল ইসলাম বলেন, হাওরে কাজ করার প্রায় ১৫ বছরের অভিজ্ঞতায় এত বড় বিপর্যয় তিনি দেখেননি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সীমাহীন গাফিলতির কারণে এই ক্ষতি হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ত্রাণমন্ত্রী জানান, হাওরের ৩ লাখ ৩০ হাজার পরিবারকে আগামী ১০০ দিন প্রতি মাসে ৩০ কেজি করে চাল দেয়া হবে। আর ৫০০ টাকা করে নগদ দেয়া হবে। এ জন্য ইতিমধ্যে ৩৫ হাজার মেট্রিক টন চাল ও ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
হাওরে পরমাণু শক্তি কমিশন দল
সিলেট, সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজার এলাকার হাওরে পানিদূষণ, দুর্গন্ধ, মাছ ও হাঁস মরে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধানে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের তিন সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ দল সুনামগঞ্জে অবস্থান করে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছে। দূষিত পানি, মাটি, বালু, মরে যাওয়া মাছ, হাঁস ও জলজ উদ্ভিদের নমুনা সংগ্রহ করে সেগুলো ঢাকায় তাদের পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে। দু-এক দিনের মধ্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ দলের সদস্যরা।
গত রোববার বিশেষজ্ঞ দলের প্রধান বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের ভৌতবিজ্ঞান বিভাগের সদস্য দিলীপ কুমার সাহা জানিয়েছেন, তাঁদের পাঠানো নমুনা রোববার সকাল থেকে ল্যাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়েছে। বিশেষজ্ঞ দলের অন্যরা হলেন কমিশনের প্রধান দুই বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা দেবাশীষ পাল ও বিলকিস আরা বেগম।
হাওরের পানিদূষণের কারণ কাঁচা ধানগাছ পচে যাওয়া নাকি অন্য কিছু? এ বিষয়ে দিলীপ কুমার সাহা বলেন, ইউরেনিয়ামের কারণে হাওরে পানিদূষণ হয়েছে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সে রকম কিছু পাওয়া যায়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের নেতৃত্বাধীন একটি প্রতিনিধিদলও গতকাল বিভিন্ন হাওর ঘুরে পানি পরীক্ষা করেছেন। অধ্যাপক মনিরুজ্জামান বলেন, হাওরে সাত ফুট পানির নিচে আলো প্রবেশ করছে। তার মানে পানি পরিষ্কার। পানিতে অন্য কোনো ক্ষতিকর দ্রব্য মিশে থাকলে পানি এত পরিষ্কার থাকার কথা নয়। তাই উদ্বিগ্ন হওয়ার তেমন কিছু নেই। ধীরে ধীরে সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
সুনামগঞ্জের শেষ সম্বল পাকনার হাওর ডুবছে
সুনামগঞ্জ থেকে, আজিজুল ইসলাম চৌধুরী জানান : শনির হাওরে পর এবার সুনামগঞ্জের পাকনার হাওর ডুবে গেছে। গতকাল (সোমবার) ভোরে বাঁধ ভেঙ্গে হাওরে স্রোতের মত পানি ডুকছে, ডুবছে ফসল। হাওর বলতে আর রইলো না। এটিই ছিল এ জেলার শেষ সম্বল। এ হাওরটি রক্ষার জন্য এলাকার শত শত মানুষ দিন-রাত কাজ করেছেন বাঁধে। গত ২৫ দিন থেকে হাওরের বাঁধে কাজ করে শেষ রক্ষা করতে পারলেন না তারা। আক্ষেপ করে হাওর পাড়ে বসে অনেক কৃষক কেঁদে ফেলেন। তারা কেঁদে কেঁদে বলেন, কয়েকদিন থেকেই খেয়ে না খেয়ে এ বাঁধে কাজ করেছি। কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারলাম না। সব বিফলে গেল।
ফেনারবাক ইউনিয়নের চেয়ারম্যান করুনা সিন্দু তালুকদার ইনকিলাবকে বলেন, এ এলাকার একমাত্র ফসলী হাওর পাকনার হাওরটিও ডুবে গেল। এখন হাওর বলতে রইলো না। ফসল হারিয়ে মানুষ অসহায় হয়ে পড়েছে। আমারও এ হাওরে জমি ছিল। কিন্তু ধান তুলতে পারিনি। তিনি বলেন, এ হাওরটি রক্ষার জন্য অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু রক্ষা হলো না। নিজের পকেটের টাকা দিয়ে কাজ করিয়েছি বাঁধে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিভিন্ন সময়ে হাওরটি রক্ষার জন্য সহায়তা করেছেন। কিন্তু সোমবার ভোরে ‘উড়ার বাঁধ’ ভেঙ্গে পানি ঢুকতে শুরু করে। যেভাবে পানি ঢুকছে কোন উপায়ে রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। তিনি বলেন, এ হাওরের বিভিন্ন পয়েন্টে ঠিকাদাররা সময় মত কাজ করেনি। যা করেছে তাও ঠিকমত করেনি। ফলে বাঁধে ভাঙন দেখা দেয়। নিমিষেই হাওর তলিয়ে যেতে থাকে। হাওর ডোবার আগে অবস্থা বেগতিক দেখে কিছু কৃষক কিছু সামান্য পরিমাণ কাঁচা ধান কেটেছিল। তাও আবার পচে যাচ্ছে। প্রতিদিন বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এ অবস্থায় ধান মাড়াই দিতে ও শুকাতে পারছে না। টেঁকির (স্তূপের) মধ্যেই ধান পচে গন্ধ ধরে যাচ্ছে। তিনি বলেন, এ এলাকায় সরকারের ১০ টাকা কেজির চাল এবং ১৫ টাকা কেজির চাল এবং আটা সরবরাহ একেবারেই অপ্রতুল। এলাকায় চাল কিনতেও পাওয়া যায় না। অভাবীর সংখা অনুযায়ী সরকারের সকল সহায়তা না বাড়ালে অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে যাবে।
জামালগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) প্রসূন কুমার চক্রবর্তী বলেন, ‘হাওরটি রক্ষায় এলাকার মানুষ প্রচুর শ্রম দিয়েছেন। কষ্ট করেছেন, কিন্তু সবার চেষ্টা ও শ্রম ব্যর্থ হয়ে গেল। এখন হাওরটি তলিয়ে যাচ্ছে। হাওরে যেভাবে পানি ঢুকছে, তাতে মনে হয় ২৪ ঘণ্টায় সব ফসল তলিয়ে যাবে।’
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক শেখ রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এই হাওরটি ছিল আমাদের শেষ ভরসা। কিন্তু সেটিও টিকলো না। সকালে খবর এল বাঁধ ভেঙে গেছে। প্রবল পানির চাপে বাঁধ ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়ে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।