পোশাক রপ্তানিতে উৎসে কর ০.৫ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব
আগামী পাঁচ বছরের জন্য তৈরি পোশাক রপ্তানির বিপরীতে প্রযোজ্য উৎসে করহার ১ শতাংশ থেকে হ্রাস করে ০.৫ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করেছে পোশাক খাতের দুই সংগঠন
নড়াইল জেলা সংবাদদাতা : সূর্যি মামা উঁকি দেবার আগেই নড়াইলের নলদী ইউনিয়নের উচ্ছে পল্লীতে তৈরি হয় এক অন্য পরিবেশ। শিশু-কিশোর, নারী-পুরুষ থেকে শুরু করে সব বয়সী মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে উচ্ছে সংগ্রহের কাজ করেন। বিস্তীর্ণ ক্ষেতের মাঝে উচ্ছে সংগ্রহের এ দৃশ্য অন্যরকম। নলদীর ২৩টি গ্রাম এখন উচ্ছেপল্লী হিসেবে খ্যাত। প্রায় ২০ হাজার কৃষক পরিবারেও এসেছে আর্থিক স্বচ্ছলতা। এদিকে এ এলাকার উচ্ছে স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে যাচ্ছে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায়।
চাষিরা জানান, প্রায় ২০ বছর আগে এ অঞ্চলে উচ্ছের আবাদ শুরু হয়। পরীক্ষামূলকভাবে নলদী ইউনিয়নের কানাবিলে প্রথমে উচ্ছে আবাদ হয়। ফলন ভালো পেয়ে উচ্ছে আবাদের প্রতি এ অঞ্চলের কৃষকের আগ্রহ বাড়তে থাকে। বর্তমানে নলদী এলাকার ২৩টি গ্রাম মাঠজুড়ে শুধু উচ্ছে আর উচ্ছে। এমনকি বসতবাড়ির আঙিনা ও আশপাশেও উচ্ছের আবাদ করা হচ্ছে। এ বছর (২০১৬-১৭ মৌসুম) ২১০ হেক্টর জমিতে ৮৭৫ মেট্টিক টন উচ্ছের ফলন হয়েছে। অথচ এক সময় শুষ্ক মৌসুমে এসব জমি অনাবাদি পড়ে থাকত।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও স্থানীয় চাষিরা জানান, ডিসেম্বরের প্রথম দিকে উচ্ছের বীজ বপন করা হয়। একটি তাওয়ায় (একটি স্থানে) ছয় থেকে সাতটি বীজ দেয়া হয়। প্রায় ১০ দিন পরে চারা গজায়। এরপর মাটিতে খড় বিছিয়ে দেয়া হয়। দেড়মাস পর ফলন শুরু হয়। সার, ওষুধ, ভিটামিন ও সেচসহ পরিচর্যার জন্য প্রতি একরে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা খরচ হয় এবং এক লাখ টাকার উচ্ছে বিক্রি করা যায়। ফলন পাওয়া যায় তিন মাস পর্যন্ত। ক্ষেতের আকার ভেদে একজন চাষি প্রতিদিন এক হাজার থেকে শুরু থেকে পাঁচ হাজার টাকার উচ্ছে বিক্রি করতে পারেন। প্রথমে ৮০ টাকা কেজি দরে উচ্ছে বিক্রি হয়। মাঝামাঝি সময়ে প্রতি কেজি ৪০ থেকে ৫০ টাকা এবং বর্তমানে ২০ থেকে ২৫ টাকা পাইকারি দরে বিক্রি হচ্ছে। শেষের দিকে দাম আবার চড়া হয়। বর্তমানে বাজারে ক্রেতাপর্যায়ে প্রতিকেজি উচ্ছে বিক্রি হচ্ছে ৪০ এবং করলা ৩০ টাকা করে।
সরেজমিনে দেখা যায়, নলদী ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে সবুজ পাতা আর হলদে ফুলের মাঝে জড়িয়ে আছে বোল্ডার জাতের উচ্ছে আর উচ্ছে। এসব ক্ষেতে মৌমাছির উড়াউড়িও কম নয়। উচ্ছের হলদে ফুল থেকে মধু আহরণের এ দৃশ্য সহজেই নজর কাড়ে, আকৃষ্ট করে সবাইকে। কানাবিলের উচ্ছেচাষি অনিতা ও ঊষা রানী বলেন, এ অঞ্চলের ঘরে ঘরে উচ্ছে চাষ করা হয়। ভালো ফলনে খুশি আমরা। বিদ্যুৎ জানান, প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিলের আশপাশে উচ্ছে বেচাকেনার বাজার বসে। বাইরের ব্যাপারীরা এখান থেকেই পাইকারি দরে উচ্ছে কিনে নেন। গাছবাড়িয়া গ্রামের আরতী বলেন, আমাদের উচ্ছে যশোর, খুলনা, ঝিনাইদহ, মাগুরা, ফরিদপুর, বরিশাল, ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছে। ল²ণ কুমার জানান, ৩৮ শতক জমিতে উচ্ছে চাষ করেছেন তিনি। প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০ কেজি বিক্রি করেন। কানাবিলের নারীকর্মী লাকি বলেন, সবুজ পাতার ভাজে ভাজে লুকিয়ে থাকা উচ্ছেগুলো একটা একটা করে তোলা হয়। ভোর থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত ৫০ থেকে ৬০ কেজি উচ্ছে তোলা যায়। প্রতি কেজি উচ্ছে তোলার জন্য আমাদের দুই টাকা করে দেয়া হয়। প্রতিদিন ক্ষেতের একেকটি অংশ থেকে উচ্ছে তোলা হয়। সেই হিসেবে প্রতিটি ক্ষেতে থেকে গড়ে প্রতিদিনই উচ্ছে তোলা যায়। ওই বিলের অপরকর্মী সাবানা খাতুন জানান, এ অঞ্চলের প্রতিটি মাঠে অন্তত ৫০ জন নারী উচ্ছে তোলা ও বাজারজাতকরণের কাজ করেন। এ হিসাবে প্রায় এক হাজার নারী এ কাজের সাথে জড়িত আছেন। উচ্ছের বীজ বপন, পরিচর্যা ও তোলার ক্ষেত্রে নারীদের যথেষ্ট ভ‚মিকা রয়েছে। লিটন জানান, এ বছর বোল্ডার জাতীয় উচ্ছে বীজের সাথে করলা বীজের মিশ্রণ থাকায় এ এলাকার চাষিরা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কারণ, উচ্ছের চেয়ে করলার দাম ও চাহিদা কম।
বারইপাড়ার ওহিদুর রহমান (৫৫) বলেন, ১৯৯৬ সালে কানাবিলে আমি প্রথম উচ্ছে চাষ শুরু করি। আমার দেখাদেখিতে অন্যরা শুরু করেন। ক্রমান্বয়ে নলদী এলাকার ২৩টি গ্রামের কৃষকের মাঝে উচ্ছে চাষের আগ্রহ বাড়তে থাকে। চৈত্র-বৈশাখ মাসে উচ্ছে বিক্রির টাকার ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ে প্রতিটি ঘরে। এ এলাকার ২৩টি গ্রাম এখন উচ্ছেপল্লী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। অথচ, এক সময় শুষ্ক মৌসুমে এসব জমি অনাবাদি পড়ে থাকত। নলদী ইউনিয়নের বারইপাড়া গ্রামের সাব্বির শেখ জানান, অন্যান্য সবজি ও ফসলের তুলনায় কম খরচে আবাদ সম্ভব বলে কৃষকেরা উচ্ছে চাষে ঝুঁকেছেন। মাত্র তিন থেকে চারবার সেচ দেয়া লাগে। খুব বেশি সার ও কীটনাশকের প্রয়োজন হয় না। তবে, অতিবৃষ্টি, কুয়াশা ও মেঘলা আবহাওয়া উচ্ছে চাষের জন্য ক্ষতিকর। এদিকে, কচাতলার পাইকারি বাজারে যাতায়াতের প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তা কাঁচা হওয়ায় যোগাযোগের ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে বলে জানান।
কচাতলার খুচরা ব্যবসায়ী বেলায়েত হোসেন বলেন, ২০ বছর যাবত উচ্ছে কেনাবেচা করছি। খুচরা কিনে দূর-দূরান্তের ব্যাপারীদের কাছে পাইকারি দরে বিক্রি করি। নলদী ইউনিয়নে আমার মতো প্রায় তিন হাজার ব্যবসায়ী উচ্ছে কেনাবেচার সাথে জড়িত। ঝিনাইদহের কালিগঞ্জের পাইকারি ব্যবসায়ী দেলোয়ার হোসেন জানান, এখান থেকে প্রতিদিন ৩৫ থেকে ৪০ মণ উচ্ছে কিনে ঢাকা, যশোর, ঝিনাইদহ, খুলনা, মাগুরাসহ বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হয়। ১২ বছর ধরে নলদী থেকে উচ্ছে কিনছেন তিনি। গাছবাড়িয়ার আমিনুর মোল্যা জানান, মৌসুমের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এ অঞ্চলের উচ্ছেচাষি, শ্রমিক, খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের মনেপ্রাণে এক অন্যরকম আনন্দ-আমেজ বিরাজ করে। যেন ঘরে ঘরে শুধু উচ্ছে বিক্রির টাকা আর টাকা। নড়াইল শহরের রূপগঞ্জ বাজারের কাঁচামাল ব্যবসায়ী মুনছুর মোড়ল বলেন, নলদী এলাকার উচ্ছের মান খুব ভালো। ক্রেতা চাহিদা রয়েছে। টাটকা বিক্রি করা যায়। বর্তমানে বাজারে ক্রেতা পর্যায়ে প্রতিকেজি উচ্ছে বিক্রি হচ্ছে ৪০ এবং করলা ৩০ টাকা করে। কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর নড়াইলের উপ-পরিচালক শেখ আমিনুল হক বলেন, উচ্ছে কাঁচা তরকারি পাশাপাশি ওষুধি গুণ রয়েছে। ডায়াবেটিক নিয়ন্ত্রণ ও বসন্ত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা রয়েছে। এ বছর ২১০ হেক্টর জমিতে ৮৭৫ মেট্টিক টন উচ্ছের ফলন হয়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগই নলদী এলাকায়। তবে, নলদী ছাড়াও জেলার অন্যান্য এলাকায় দিন দিন উচ্ছের আবাদ বাড়ছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।